জ্যোতিষ শাস্ত্রের ভাগ্যে কী লিখেছে করোনাভাইরাস?

সেটা ২০১৯ সালের শেষ সন্ধ্যা; পুরো বিশ্ব তখন নতুন বছরকে বরণ করার আয়োজনে ব্যস্ত।

হ্যালি পেলাননিউ ইয়র্ক টাইমস
Published : 29 May 2020, 03:24 AM
Updated : 29 May 2020, 03:24 AM

সেই সন্ধ্যায় সিবিএস নিউ ইয়র্কে হাজির হলেন বিখ্যাত মার্কিন জ্যোতিষ সুসান মিলার। বললেন, “২০২০ সাল হবে দারুণ এক বছর, বয়ে আনবে অতুল সমৃদ্ধি।” 

সবাই খুব মন দিয়েই শুনছিলেন। সুসান মিলার ভবিষ্যদ্বাণী করছিলেন, বছর জুড়ে বৃহস্পতি তুঙ্গে থাকবে মকরের। কর্কটের জন্য গাঁটছড়া বাঁধার শুভলগ্ন উঁকি দিচ্ছে। তুলা রাশির জাতক-জাতিকারা আবাসন ব্যবসায় তরতর করে সাফল্য পেতে যাচ্ছেন। আর বৃষের জন্য বছরজুড়ে থাকছে নানা দেশে ভ্রমণ।

কিন্তু কদিন বাদেই মানুষের ভ্রু কুঁচকে উঠল, কারণ চোখে না দেখা এক ভাইরাস এসে এলোমেলো করে দিল নক্ষত্রের এই ভাগ্যলিপি।

সুসান মিলারের ফ্রি অ্যাপের একজন সাবস্ক্রাইবার দিব্যা বাব্বার বৃশ্চিক রাশির জাতিকা। ভবিষ্যতবাণী অনুযায়ী এ বছর ব্যবসায় লাভের কড়ি গোনার কথা তার। 

সে সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যাওয়ার পর দিব্যা বললেন, “গত মাসেও আমি ভাবছিলাম, সবাই কি এরইমধ্যে তাদের জ্যোতিষীকে বাদ দিয়েছেন?”

দিব্যার মত আরো অনেকেই অভিযোগ বর্ষণ করে চলেছেন সুসান মিলারের ইউটিউব আর ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে।

একজন তো বেশ কড়া ভাষাতেই লিখেছেন, “সুসান, আপনি একজন ভালো লেখক, সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনি কোভিড-১৯ আর এর প্রভাবে মানুষের চাকরি হারানোর কথা লিখতে ভুলে গেছেন।”

আরেকজন লিখেছেন, “আপনার ভবিষ্যদ্বাণীতে এটা কেন এল না সুসান? কোভিড-১৯ এতটাই বড় ঘটনা, যেটা গণনায় না আসার কথা নয়।”

জ্যোতিষ শাস্ত্রের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন, গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান আর চলাচল মানুষের প্রতিদিনের জীবনের নানা ঘটনায় সরাসরি প্রভাব ফেলে।

তবে বিজ্ঞান সব সময়ই এ বিশ্বাসকে খারিজ করে এসেছে। 

অধিকাংশ মনস্তত্ববিদ এ বিষয়ে একমত যে, জ্যোতিষ শাস্ত্রের এই আবেদনের মূলে রয়েছে নিজের জন্য সুবিধাজনক তথ্য খোঁজার প্রবণতা, যাকে বলে ‘কনফরমেশন বায়াস’। নিজের বিশ্বাস আর আদর্শের সঙ্গে মেলে, সেরকম তথ্য খোঁজা, যে কোনো ঘটনাকে সেভাবে ব্যাখা করা কিংবা সমর্থন দেওয়া মানুষের সহজাত প্রবণতা।

 

নিন্দুকেরা বলেন, জ্যোত্যিষরা এমনভাবে রাশিফল লেখেন, যা পড়ে যে কেউ এর সাথে নিজের কোনো না কোনো মিল খুঁজে পান। আর যারা রাশিফলে বিশ্বাস করেন, তাদের বেলায় তো কথাই নেই।

এসবের মধ্যে চলে এলো মার্চ; মহামারী কায়েম হল বিশ্বজুড়ে। এর ব্যাপ্তি এতটাই সার্বজনীন চেহারা পেল যে জ্যেতিষশাস্ত্রের ভবিষ্যদ্বাণী তো ব্যর্থ হলই, সেইসঙ্গে রাশিতে রাশিতে ভাগ্যের পার্থক্যও যেন ঘুঁচে গেল।

সব মিলিয়ে কেউ ভাবতে পারেন, রাশিচক্র থেকে এবার বুঝি ভক্তদের বিশ্বাস উবে যাবে। তবে বাস্তবতা হল, জ্যেতিষশাস্ত্রের জনপ্রিয়তা এখন যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে।

আর কতদিন এভাবে চলবে? আগের মত সবকিছু কি স্বাভাবিক হবে? যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের ওপর কি ভরসা করা যায়? প্রতিদিনের জীবনে এরকম নানা প্রশ্ন মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।

আবার অনেকে প্রশ্ন করছেন একেবারে শাস্ত্রের ভাষায়। বুধ কী এখন বক্রগতিতে চলছে? শেষ কবে শনি আর প্লুটো এক রেখায় এসেছিল?    

সংস্কৃতির বিবর্তন নিয়ে কাজ করেন লুসি গ্রিন। তা পর্যবেক্ষণ বলছে, এই সময় অনলাইনে রাশিফল নিয়ে আর্টিকেল পড়ার হিড়িক পড়ে গেছে। অনলাইন লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন ড্যাজড বিউটির রাশিচক্রের পাতায় গত তিন মাসে আগের চেয়ে ২২ শতাংশ পাঠক বেড়ে গেছে।

এপ্রিলের শুরুতে পূর্ণিমার রাতে আকাশে যে অতিকায় গোলাপী চাঁদ দেখা দিয়েছিল, তা তুলা রাশির জাতক-জাতিকাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সুখবর বয়ে আনবে বলে এক প্রতিবেদনে দাবি করেছিল বিনোদন ম্যাগাজিন রিফাইনারি২৯ ডটকম। সেটা ছিল এপ্রিলে তাদের সবচেয়ে বেশি পঠিত আর্টিকেলগুলোর একটি।

মিডিয়া বিশ্লেষক কোম্পানি কমস্কোর বলছে, মার্চ মাসে অ্যাস্ট্রো, ক্যাফেঅ্যাস্ট্রোলজি আর সুসান মিলারের ওয়েবসাইট অ্যাস্ট্রোলজিজোনের পাঠকের আনাগোনো ফেব্রুয়ারির চেয়ে অনেকটা বেড়েছে।

বাসল, এলিট ডেইলি, রম্পার, নাইলন ও দ্য জো রিপোর্টের কনটেন্ট ও স্ট্রেটেজির দিকটি দেখেন বাসল ডিজিটাল গ্রুপের এমা রোজেনবাম। তিনি এই গ্রুপের লাইফস্টাইল বিভাগের প্রধান সম্পাদকও।

তিনি বলেন, যতগুলো ওয়েবসাইট তাদের আছে, সেগুলোতে রাশিচক্র বিভাগ সব সময়ই জনপ্রিয়।

“ধর্মচর্চা ও আধ্যত্মবাদের পর, আমার মতে, এরকম অনিশ্চিত একটা সময়ে কিছু মানুষ আরো বেশি করে রাশিচক্রের দিকে ঝুঁকছে।”

এমনিতেতে রাশিফল ছিল মোটামুটিভাবে অরাজনৈতিক একটি বিষয়। এতে ভ্রমণভাগ্য নিয়ে বলা হয়, বেতন বাড়ার সম্ভাবনার কথা থাকে, আবার সকালে অফিস যাওয়ার পথে বাসে কিংবা মোট্রাতে চোখাচোখি থেকে জীবনসঙ্গী মিলে যাওয়ার পূর্বাভাসও থাকে।

বিশ্ব অর্থনীতি, সমাজের অসমতাসহ অন্য অনেক কিছু- যা নিশ্চিতভাবে মানুষের ‘ভাগ্যে’ প্রভাব রাখে, সেসব উহ্যই থাকে রাশিচক্রের ভবিষ্যদ্বাণীতে।

তবে ইদানিং জ্যোতিষ শাস্ত্রের চর্চায় বড় পরিবর্তন এসেছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলোও সেখানে আসতে শুরু করেছে।

চ্যানি নিকোলাস অনুসারীদের কাছে পরিচিতি পেয়েছেন ‘সোশাল জাস্টিস অ্যাস্ট্রোলজার’ হিসেবে। তার দাবি, ২০২০ সাল যে একটা কঠিন বছর হবে, তা তিনি আগেই বুঝেছিলেন। তবে শুধু নক্ষত্রের অবস্থান থেকে তিনি সেটা বুঝেছিলেন, তা নয়।

আগুয়ান এক মন্দার পূর্বাভাসের সঙ্গে নিজের জ্যেতিষ শাস্ত্রের অংক মিলিয়ে তিনি বলছেন, “এটা (যুক্তরাষ্ট্রে) নির্বাচনের বছর। আর ভোটের বছরগুলো সবসময় বেশ কঠিন হয়ে দেখা দেয়।”

জ্যোতিষ শাস্ত্রকে সময়োপযোগী সেবা দিতে হবে। আমরা এ বছর যতটুকু বিপদের কথা আমরা ভাবতে পেরেছিলাম, এই মহামারী তার চেয়েও বড় সঙ্কট হয়ে সামনে এসেছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এখন আমাদের করণীয় কী? এখন সেই সময় যখন আমরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে আছি। আমরা কেউ গ্রহ নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে নেই।”

এদিকে সুসান মিলারের ভবিষ্যদ্বাণী ভুল হওয়ায় ইনস্টাগ্রামে তাৎক্ষণিকভাবে যারা ক্ষোভ ঝেরেছিলেন, তারা এখন শান্ত হয়ে আবার ফিরছেন সেই জ্যোতিষের কাছেই। তারা এখন জানতে চান, এই মহামারী কতদিন চলবে, সুসান মিলার কী ভাবছেন? 

মেলানি সৈয়দ-ইসমাইল তেমনই একজন। তিনি বলছেন, মার্চের মাঝামাঝিতে প্রকাশিত করোনাভাইরাস নিয়ে সুসান মিলারের বিশেষ প্রতিবেদন পড়ে রাশিচক্রে তার আস্থা আবার ফিরে এসেছে।

ইনস্টাগ্রামে কটূ কথা বলার জন্য অনুতপ্ত ইসমাইল বলেন, “সেদিন আমি আসলে বিক্ষিপ্ত ছিলাম। আমার অবশ্যই তার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিৎ।”

মিলারের ওই প্রতিবেদনে প্লুটোর অবস্থানকে এই মহামারীর জন্য দায়ী করা হয়। জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে, আকারে ছোট কিন্তু শক্তিশালী এই গ্রহ অর্থনৈতিক দশা, গণজমায়েত এবং ভাইরাস ‘নিয়ন্ত্রণ’ করে।

কেন কোনো দেশে সংক্রমণ বেশি আর কোনো দেশে কম- তার ব্যাখ্যায় ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, “ইতালির নিয়ন্ত্রক হল মিথুন রাশি, কারণ এ দেশের মানুষ ইতালির একীভূত হওয়া উদযাপন করে জুন মাসে। মিথুন রাশির ক্ষেত্রে ফুসফুস আবার হয় স্পর্শকাতর। আর সে কারণেই ইতালিতে এ ভাইরাস এত প্রবলভাবে আঘাত হেনেছে, কারণ ফুসফুসই এ ভাইরাসের সংক্রমণের শিকার হয়।”

কর্কট রাশির যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কী ঘটছে তাহলে?

সুসান মিলারের ভবিষ্যদ্বাণী বলছে, সেখানে মার্চ, এপ্রিল আর মে মাসে সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী থাকবে। তারপর গ্রীষ্মে এই ভাইরাস দুর্বল হতে থাকবে। তবে এই সঙ্কট ফিরে আসবে হেমন্তে, সম্ভবত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলবে।”

মজার বিষয় হল, অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও ভাইরাসের ভবিষ্যত নিয়ে একই ধরনের পূর্বাভাসের কথা বলে আসছেন। সুতরাং এমন হতে পারে যে সুসান মিলারের মত নতুন প্রজন্মের জ্যোতিষরা শুধু গ্রহ-নক্ষত্র থেকেই লক্ষণ বিচার করছেন না।

অবশ্য তার একনিষ্ঠ অনুসারীদের কাছে ভবিষ্যদ্বাণীর বক্তব্যের চেয়ে মাধ্যম, অর্থাৎ জ্যোতিষ শাস্ত্রই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

[ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন আইরিন সুলতানা]