মহামারীর ফাঁদে ঘটকের বাণ

নতুন এক করোনাভাইরাস যখন দুনিয়াজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম শুরু করল, এর ফলাফল যে সুদূরপ্রসারী হবে, তা বোঝা যাচ্ছিল তখনই। তবে অতশত না ভেবে মার্চের শুরুতে সুস্থ দেহে নির্বিঘ্নে চেন্নাই থেকে দেশে ফিরতে পেরেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন তিনি।

সাবরিনা করিম মুর্শেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 May 2020, 05:45 AM
Updated : 16 May 2020, 05:45 AM

রুহুল আমিনের সেই স্বস্তি উবে যেতে শুরু করল, যখন গ্রাহকরা তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন।

আরও একজনের সঙ্গে মিলে ‘বিবাহ বন্ধন’ নামে একটি ঘটকালির এজেন্সি চালান রুহুল আমিন। উচ্চ মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারগুলোই মূলত তাদের গ্রাহক।

কিন্তু বিয়ের ভাবনা যাদের মাথায় ছিল, এই ছেঁয়াচে রোগের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে তা শিঁকেয় তুলে রাখতে শুরু করলেন সবাই।

রুহুল আমিনরা ব্যবসার বিপদ টের পেতে শুরু করলেন মোটামুটি ৫ মার্চ থেকেই। ততদিনে চারপাশে আতঙ্ক শুরু হয়ে গেছে।

এরপর দেশের ভেতরেই সংক্রমণ আর মৃত্যুর খবর আসতে শুরু করল। মাসের মাঝামাঝি এসে স্কুল-কলেজও বন্ধ হয়ে গেল।

মার্চের শেষে এসে সরকার যখন অফিস-আদালত আর যানবাহন বন্ধের ঘোষণা দিল, সেই লকডাউনে ঘটকালিতে সর্বনাশের ষোল কলা যেন পূর্ণ হল।

লকডাউনের মেয়াদ ধাপে ধাপে বেড়ে হয়েছে ৩০ মে পর্যন্ত। তবে এরপর যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তেমন সম্ভাবনা এখনও দেখা যাচ্ছে না।

রুহুল আমিনদের ‘বিবাহ বন্ধন’ এর অফিস ঢাকার মহাখালী ডিওএইচএসে। দুই অংশীদার বাদে কর্মী আছেন দশজন। সবার ভাগ্যে এখন কী ঘটবে, এই প্রতিষ্ঠান কীভাবে টিকিয়ে রাখবেন, সেই ভাবনায় কুলকিনারা পাচ্ছেন না রুহুল। 

রুহুল আমিন ও কামরুল হাসান, তারা দুজনে মিলেই চালান ‘বিবাহ বন্ধন’

সময় যখন ভালো ছিল, প্রতিমাসে গড়ে শ খানেক গ্রাহক ‘বিবাহ বন্ধন’ এর সেবা নিতেন। মাসে অন্তত পাঁচটি বিয়ে তারা ঘটিয়ে দিতে পারতেন সাফল্যের সঙ্গে।

কিন্তু মহামরীর এই দিনে বিবাহ এক বিরল ঘটনা। গত তিন মাসে মাত্র একটি যুগলের মধ্যে গাঁটছড়া বেঁধে দিতে পেরেছে `বিবাহ বন্ধন’। কর্মচারীদের মার্চ পর্যন্ত বেতন দিতে পারলেও এরপর কী হবে জানেন না রুহুল।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা বিরাট সঙ্কটে পড়ে গেছি। আমাদের দশজন কর্মচারী আছে, মানে দশটা পরিবার আমাদের এই ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল।”

২০০৫ সালে যাত্রা শুরুর পর ভালোই চলছিল রুহুল আমিনদের। তাদের সেবা পেতে হলে প্রথমে `বিবাহ বন্ধন’ এর সদস্য হতে হয়, সেজন্য লাগে ১০ হাজার টাকা।

এর বিনিময়ে সেই সম্ভাব্য পাত্র বা পাত্রীর সামনে হাজির করা হয় অসংখ্য বায়োডাটা, যাতে তিনি মনের মত কাউকে খুঁজে নিতে পারেন জীবনসঙ্গী হিসেবে।

এই তালাশের কোনো পর্যায়ে যদি দুই পক্ষের মিলে যায়, তখন দুই পরিবারের কাছ থেকে একটি অংক ঘটকালির ‘ফি’ হিসেবে পায় `বিবাহ বন্ধন’।

কেউ কেউ যে ফাঁকি দেন না, তা নয়। পাত্র-পাত্রী পছন্দ হয়ে গেলে কেউ হয়ত নিজেরা যোগাযোগ করে বিয়ে করে ফেলেন ঘটকের পয়সা না দিয়েই।

কিন্তু এবারের সঙ্কট আঘাত করেছে একেবারে গোড়ায়, কারণ তাদের ব্যবসায় ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল থাকে খুবই কম। মক্কেলদের ফি দিয়েই অফিস ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন দিতে হয়।   

“আমাদের হাতে এমন সঞ্চয় নেই যে সেটা ভেঙে চলব। আমাদের ব্যবসা অনেকটা তরকারিওলার মত, প্রতিদিনের ইনকামে চলতে হয়,” বলেন রুহুল। 

‘বিবাহ বন্ধনের’ গ্রাহকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশে থাকেন। টরন্টো, নিউ ইয়র্ক, সিডনি, মেলবোর্নের প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকে তাদের সেবা নিতে নিবন্ধন করেছেন। কিন্তু সঙ্কট তো এখন সব দেশেই।

“এখন যদি আমি বিদেশে তাদের কাউকে ফোন করে পাত্র-পাত্রীর কথা বলি, তারা আমাকে পাগল ভাববেন।”

রুহুল আমিন বলেন, এক গ্রাহক তাকে এ কথাও বলেছেন যে, জান বাঁচানো ফরজ, বিয়ে তো আর তা না।  

আজকের দুনিয়ায় মনের মত সঙ্গী খোঁজার জন্য অনেক আধুনিক ব্যবস্থা আছে। নানা রকম ওয়েবসাইট যেমন সেবা দিচ্ছে, বিভিন্ন ডেটিং অ্যাপও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

তারপরও বাংলাদেশে অনেকে এখনও সনাতনি ঘটকালির ওপর নির্ভর করেন ঘটকের ব্যক্তিগত পরিচয়ের সূত্রে ‘আস্থা’ রাখা যাবে, এই ভাবনা থেকে; অন্তত রুহুলের সেরকমই ধারণা।

কিন্তু এ কাজের যে অপ্রাতিষ্ঠানিক ধরন, তাতে সরকার বা অন্য কেউ এই বিপদের সময় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেবে- তেমন আশা তিনি করতে পারছেন না।

“এটা অসম্ভব, কে আমাদের টাকা দেবে, বলেন?”

রুহুল আমিনদের তাই আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। একদিন হয়ত এই ভাইরাসের বিপদ দূর হবে, অর্থনীতি আবার সচল হবে, মানুষও আবার বিয়ে করার সাহস ফিরে পাবে।

“আমি আশা নিয়ে আছি, সব আবার একদিন স্বাভাবিক হবে। আমরাও আগের মত ঘটকালি করতে পারব।”