একটু নিঃশ্বাসের আশ্বাসে নেপালে

চেনাজানা পরিবেশ থেকে কিছুটা দিনের জন্য পালিয়ে বাঁচার তাগিদে হুট করেই নেপাল যাওয়া।

হুমায়রা সুলতানাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 May 2020, 02:49 PM
Updated : 10 May 2020, 02:49 PM

প্রথম গন্তব্য কাঠমান্ডু। অন অ্যারাইভাল ভিসা। ঢাকায় ইমিগ্রেশন পার করে, নাশতা সেরে ডিউটি ফ্রি শপগুলোর পাশে বসে আছি। ১১টায় ফ্লাইট। এখন ৯টা ৪২মিনিট। পালাতে হবে চেনা আকাশ ছেড়ে। পকেট একেবারে করুণ, কিন্তু যেতেই হবে।

ভাবছি অনেক কথা, যেগুলো ঘুরপাক খায় বা খেতেই থাকে, তার সঙ্গে যোগ হয় নতুন অনেক কিছু। কিছু মিশে যায়, কিছু ঢেকে যায়, কিছু নতুন কথা হয়ে নতুন করে ভাবতে শেখায়। কাঠমান্ডু কলিং।

কাল লাগেজ গোছাবার সময় খুব প্রিয় মানুষের ফোন পেয়েছিলাম। আমি তখন কারও অভ্যেস আয়ত্ব করবার প্রচেষ্টায় রোল করছি কাপড়। কিছু অভ্যেস স্বভাবে থেকে যাক। আচ্ছা ভ্রমণ বিলাস লিখব ভাবছিলাম, তার মধ্যে কী কী সব লিখছি?

পাশের প্যাসেঞ্জার দেখছি ল্যাপটপ খুলে বসলো। কী যেন পড়বে। আমি পড়ালেখার মাঝে নাই। বিগ ব্লকেড। আরও একঘণ্টা বাকি।

১০টা ৪৫ মিনিট। অন বোর্ড, এফ সিরিজের সিট। জানালার পাশে। আকাশে কিছুটা বেশি সময় ঘুরপাক দিতে হল। ৪৫ মিনিট এর মতন। বিমান অবতরণ এর জায়গা নেই। তাতে কী? ‘আই অ্যাম ওয়াচিং মাউন্টেইনস উইথ গ্লিটারিং আইজ’।

আচ্ছা, এটা কি অন্নপূর্ণা নাকি কাঞ্চনজঙ্ঘা? হবে কিছু একটা। অসম্ভব শুভ্র।

নামার সময়ের ধাক্কাটা বরাবরের মতোই ভালো লাগলো। ছোট্ট একটা এয়ারপোর্ট। হিসেব কষে বের হলাম হোটেলের পথে। প্রিপেইড ট্যাক্সি সার্ভিস। দেশটা আমার দেশের মতোই। কেবল পথে জটলা কম। গন্তব্যের আগেই নামতে হল। রাস্তা কাটা। অগত্যা লাগেজ নিয়ে হাঁটা।

দু'পাশে অসংখ্য ছোট বড় দোকান। অসম্ভব সুন্দর মূর্তি, মুখোশ আরও অনেক কিছু। আকাশটা ঢাকা ‘প্রেয়ার ফ্ল্যাগ’ দিয়ে। সবুজ, লাল, হলুদ, সাদা, নীল।

থাকার জায়গাটা ভালো। চার তলায়, ছোট একটা ব্যালকনি। জানালা খুলে বাইরে তাকাতেই পুরানো গোছের একটা বাড়ি। তিনতলায় তিনটা বাচ্চা খেলছে। দুইজন ভদ্রমহিলা - হেঁশেলের কিছুই করছে বুঝি।

‘নামাস্তে ক্যাফেৎ। বি ৫২। বিকেল। সন্ধ্যেও গড়ালো। বাইরে আঁধার নামছে, বাড়ছে রঙিন বাতির ছটা। বাইরে খোলা বারান্দায় না বসে ভেতরেই বসলাম। গদিতে। পাশেই কাঠের ফ্রেমে কাঁচের জানালা। একটা অদ্ভূত মৃদু আলো মেখে যাচ্ছে গায়ে। মনটা উদাস হল।

বেরোলাম। হেঁটে একটু সামনে যেতেই স্যাম'স বার। সামবুকা, জ্যাগামাস্টা রাত। সঙ্গে পপকর্ণ। দোতালা, দেয়াল জুড়ে অনেক লেখালিখি। চোখ পড়লো নোটিশে- ‘উই ডোন্ট সার্ভ উইমেন, ব্রিং ইওর ওউন’।

স্যামকে বিদায় দিয়ে হোটেল এর পথে। ওয়ান স্টপ শপ। এখানে দুষ্টু পানির বিশাল কালেকশন। অবশ্য কোণার দোকানে দোকানেও তাই। ওল্ড দরবার ব্ল্যাক চিমনি, কালো গর্জাস।

আরেকটা সকাল। পর্দার মাঝ দিয়েই জোর করে ঢুকে পরা সোনালি আলো। প্রেমে পড়বার মতো আলো। পড়লামও বোধ হয়। নিচে নেমে ‘কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট’। ফিরলাম আবারও। প্রেমিক আলোকে বুড়াঙ্গুল দেখিয়ে গা এলিয়ে দিলাম কম্বলের নিচে। নিকুচি প্রেমের, ঘুম একমাত্র সত্য! ওম শান্তি ওম!

বেলা গড়িয়ে প্রায় দেড়'টা। বেরোলাম কম্বল ফেলে। হেঁটে খাবার খোঁজে। মমো নেওয়া হল চিকেন আর বুল। উইংস, মাশরুম আর টফু স্টিক। ঝাল সস আর টমেটো সস। খেয়েই আগে বারলাম, গন্তব্য পশুপতি নাথ টেম্পল। থামেল থেকে ৪শ’ রুপি।

ট্যাক্সি থামতেই চোখ আটকালো ছোট ছোট সব ক্রাফটশপগুলোয়। শিভা, বুদ্ধ, তারাদেবী, গাণেশ-এর মুখোশ, রুদ্রাক্ষের মালা, অর্চণার ফুল, সিঁদুর। হবে, হবে তিতলি। ধৈর্য্যে মিলায় বস্তু অস্থিরতায় বহুদূর।

মন্দিরে ঢুকতেই চোখ পড়লো শিবলিঙ্গ। আরেকটু হেঁটে হাতের বামে ঝাঁক বাঁধা কবুতরের দল। গাইড আসলো। বাংলাদেশ শুনে বলল- বাংলায়, ভালো আছে? ভাঙা বাংলায় কথোপকথন চালিয়ে গেল।

বুঝলাম মন্দিরের এপাশটা হিন্দুদের জন্য উন্মুক্ত, টুরিস্টদের জন্য টিকিট প্রযোজ্য এবং সীমা নির্ধারিত। ঠাকুর দেখে ভেতরে, আরও ভেতর যাচ্ছি। নাকে পোড়া মাংসের গন্ধ, বুঝলাম দাহ্য হচ্ছে। সঙ্গে আরও কিছু নিথর শরীর- অপেক্ষায়। দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ।

মানুষ মরে গেলে ফিরে আসে না। তার দেখা মিলতে পাড়ি দিতে হয় একটা জীবন, জীবন ছাপিয়েও নানান ‘ফর্মালিটি’। একেই বলে নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায়?

ফেরার পথে গণেশ নিয়ে তবেই ফিরলাম। সুন্দর মেয়েদের মন কঠিন হয় নাকি? হয় বুঝি। শিব এর ‘চিজল্ড ফেইস’-এর মুখোশটা নেওয়া হলনা। দোকানী দিদি এক চুল নামবেনা পয়সার হিসাব এ।

গাইরিধারা রোড, কানকাচো বিনায়ক ছাড়িয়ে ট্যাক্সি শীতাপাইলাতে। পাহাড় দেখছি অবাক হয়ে। কত ক্ষুদ্র আমি বা আমরা। চন্দ্রগীরী হিল এ। ছবি তুলতে মন চাচ্ছে না। কিছু মুহূর্ত না হয় মনেই প্রদর্শিত হোক চিরকাল।

কেবল-কার’য়ের লাইন। সাতজন উঠলাম। তারে চড়ে পাহাড় এর চূড়োয়। রোদ আর হিমেল বাতাসের অদ্ভূত খেলা।

চোখ পড়ল মন্দিরে। মন্দির বরাবরই কেনো যে টানে খুব। এটা বালেশ্বর মন্দির। ছিমছাম। দূরে মেঘ জমছে, বাতাসের দাপট বাড়ছে। ফিরতে হবে। সাঁঝ বেলায় সূর্য স্যারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট, যেতে হবে নাগরকোট। তার বেয়ে নেমে আসছি।

নাগরকোট যাওয়ার পথে উথাল পাথাল ঘুম হল। ঘড়িতে ৫টা ২০মিনিট। ২২০ টাকার টিকিট (জন প্রতি) কেটে পাহাড় বাইছি- জিপে চড়ে। পাহাড়ের মাঝ দিয়ে ভ্যালি, সবুজ আর হলুদের অদ্ভূত সব শেইড। কেমন যেন পাগল পাগল লাগছে। মানে অত্যাধিক মন ভালো হওয়ার পাগলা ভাব।

মনে হচ্ছে এটাই এই পাহাড়ের শেষ সীমা। পথটা সরু হচ্ছে আর চোখ ঈর্ষালু হচ্ছে সৌন্দর্যের মাধুর্যতায়। উফ! সত্যিই উফ বলার মতোই। পাহাড়ি ছন্নছাড়া গাছগুলো অসম্ভব সুন্দর! আহা! আরেকটু আগে আসতাম!!

ক'টা সিড়ি বেয়ে হাতের বামে অভ্যর্থনা। তার আগেই বিরাজ আছেন শিব। আমি ‘রিসিভড উইথ কেয়ার বাই দ্যা হোটেল অথরিটি’, তারপর আরও কিছু সিঁড়ি বেয়ে দো'তালায় প্রথম ঘরটা আমার জন্য বরাদ্দ। সন্ধ্যে ঘনিয়েছে, জল রংয়ের মতো ঢলে পড়ছে কালো। রুমের সামনে দিগন্ত মেলা বারান্দা। বেশ ক'টি টেবিল-চেয়ার। আপাতত আর কিছু দেখছি না।

অস্থিরতার সঙ্গে ক্ষুধাও বাড়ছে। রুমে একটু থিতু হয়ে বেরোলাম এখানকার রেস্তোরাঁয়। স্যুপ নিলাম। এরা কাসার বাসন কোসনে খাবার পরিবেশন করে। বিষয়টা নান্দনিক হলেও আমার জন্য হ্যাপা। আমার কেমন গন্ধ লাগে। যাহোক, পেটে কোনো রকম সেঁটে ফিরলাম রুমে।

কাঁপছি রীতিমত। বেশ ঠাণ্ডা। হিটিং প্যাড বের করে কোমড়ে গরম সেঁক নিলাম। এটা ওটা করতেই রাতের খাবার সময় হয়ে এল। রেস্তোরাঁ থেকে বেরোবার আগেই রাতের খাবারের ফর্দ দিয়ে আসতে হয়েছিল এবং কথা মতো তা রুমেই পরিবেশিত হল।

যিনি খাবার দিয়ে গেলেন তার পিছে পিছেই রুম ছাড়লাম। আমার রুমের সামনের যেই দিগন্ত মেলা বারান্দা- সেখানে। নিচে, খুব নিচে টিম টিম কিছু বাতি জ্বলছে। ওখানে লোকালয় হয়তো। আকাশকে সাক্ষী রেখে সেদিন খুব কেঁদেছিলাম, খুব। সাগরের সামনে যেমন মন খুলে যা খুশি বলে ফেলা যায়, তেমন করে কেঁদেছিলাম।

আজ আকাশটা মেঘে ভারী, কে জানে কাল সূর্যের দেখা মিলবে কিনা। ঘুমোতে যাওয়া উচিত। তলিয়েও গেলাম জলদি। সকালটা ধরতে হবে।

ভোর ৫টা ৩৫ মিনিটেও এত্ত রাত। চারিদিক অন্ধকার। আরও কিছুক্ষণ বাদের আলসি আলসি আলো। আশপাশের ছাদেও মানুষ জমছে যদি বিশিষ্ট সেলিব্রিটির দেখা মিলে।

একজন বয়স্ক ভদ্র মহিলাকে দেখা গেল সামনের ছাদের। তিনি স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সূর্য খুজছেন। যাহোক, মূল স্রোতের দিকটাতেই স্যার দেখা দিলেন। বেশি সিদ্ধ হয়ে যাওয়া ডিমের কুসুমের মতো ফ্যাকাসে একটা সূর্য। তাকে দেখতে এত আয়োজনের কোনো মাজেজা আমার চিনা বাদামসম মগজে আসর ফেলে নাই। এর চেয়ে ঢের ভালো ছিল আমার সাজেকে।

ছাদ থেকে নামলাম, আমার সেই বারান্দায়। ভাবলাম বসি আরও কিছুক্ষণ, আলো ফুটুক আরেকটু। আলো যত বাড়ছে, ততই মুগ্ধ হচ্ছি। অদ্ভূত সুন্দর সব ফুল। অবলীলায় হেঁটে বেড়াচ্ছেন মিস্টার অ্যান্ড মিসেস টার্কি, হাঁস, তিতির মুরগী। একটু পর পর মিস্টার টার্কি আজগুবি শব্দ করে করে গা ঝাড়া দিচ্ছেন।

ভালো লাগছে। জীবন ভালো। আবার এদেশে আসলে তাদের সঙ্গে বেশ ক’টা দিন কাটিয়ে যাব। আরেকটু আলো ফুটতেই মনে হল ওপাশটা দেখে আসি। হেঁটে নামছি।

নেমে নেমে বেশ কিছু দূর। একটা টং দোকান আছে, চা পাওয়া যায় ওতে। আমার সঙ্গে মোবাইল ফোন (যাতে সিম ও ইন্টারনেট কিছুই নাই) ছাড়া কিছু নাই। পার্সটা থাকলে চা খাওয়া যেত। আরও কিছু দূর যেতে ইচ্ছে হলেও গেলাম না। নামছি তো আরাম করেই, উঠতে জীবন-যৌবন বিসর্জনের দশা হবে ‘ফর শিওর’। লোভ সামলে হোটেলের দিকে ফিরছি। গাড়ির চালক অপেক্ষায়। নাস্তাটা সারলেই আবার ফিরতে হবে থামেল। আমার ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

না ফেরার একটা দেশ থাকলে ভালো হত। যার পরিচিত জীবনে ফিরতে ইচ্ছা নাই, সে না ফেরার দেশে থাকবে। যতদিন ইচ্ছা ততদিন থাকবে। সেখানে যারা থাকবে, তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় হবে, শেখা-দেওয়া-নেওয়া হবে। তারপর ইচ্ছে হলে সে ফিরে যাবে নতুন ভাবে, নতুবা এখানেই থাকবে।

এটা আমার হোটেল না, এর পাশেরটা আমার। যেটা দেখা যাচ্ছে না। এই পথ বেয়েই ফিরছিলাম। এখন আর শীত নেই। আরাম একটা আবহ। একটা শীতল বাতাস আছে অবশ্য মাঝে মাঝে। মাথায় বার বার একটা কথাই বাজছে- আকাশ বদল, মেঘের বদল, দূরত্বেও ‘বরফ মাখা জল’। বরফ মাখা জল ভালো না, গলা বসে যায়, ঠাণ্ডা লাগে। বুঝিতো আমি, তাও।

থামেল ফিরে একটু বিরাম। হাতে মেলা কাজ- দরবার স্কয়ার, গার্ডেন অব ড্রিমস, অনেক কিছু বাকি।