করোনাভাইরাস: শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন

বদলে যাওয়া পরিস্থিতির সঙ্গে শিশুদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করাতে হবে।

ইরফানা সামিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 April 2020, 05:40 PM
Updated : 19 April 2020, 05:54 PM

বাসা, স্কুল, পড়া, খেলা- স্বাভাবিক ছন্দময় জীবনের ছন্দপতন শুরু হয়েছে করোনাভাইরাসের কারণে। ছুটি ঘোষণা দেওয়ার পর প্রথম প্রথম বিষয়টা হয়ত আনন্দের ছিল। তবে দিন গড়ানোর পাশাপাশি আনন্দের জায়গায় হয়ত দখল করছে অস্থিরতা।

যেকোনো পরিবর্তনের সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যত সহজে খাপ খাওয়াতে পারে, শিশুদের কিন্তু একটু বেগ পেতে হয়। আর এই মহামারীর পরিস্থিতি পুরো বিশ্বের জন্য নতুন এবং অপরিচিত। বিশেষ করে যেসব শিশুর বয়ঃসন্ধিকাল চলছে।

জিসান নামের এক কিশোরের কথাই ধরা যাক। সঙ্গত কারণেই ছদ্মনাম ব্যবহার করা হল। সপ্তম শ্রেণির এই ছাত্রের স্কুল বন্ধের সঙ্গে বন্ধ হয়েছে আরও অনেক  কিছু। সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টার অভাববোধ করছে, তা হচ্ছে টিফিন পিরিয়ডে অথবা স্কুলের পরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আর ক্রিকেট খেলা। বসে বসে সে শুধু ভাবে কবে সবকিছু আগের মতো হবে? কোচিং আর প্রাইভেট টিউটর বন্ধ হয়েছে বলে কিছুটা স্বস্তিবোধ করলেও, আরেকটা দুশ্চিন্তা মনের ভেতর কাজ করছে, সেটা হচ্ছে স্কুল খুললে পড়াশোনার সঙ্গে তাল মেলাতে পারবেতো? মোবাইলে গেমসও আর ভালো লাগছেনা। এদিকে বাবা মা সারাদিন বাসায় থাকায় সার্বক্ষণিক তাকে উপদেশ শুনতে হচ্ছে! যতটুকু পড়ার দরকার, ততটুকু তো সে পড়ছে, স্কুল থেকে অনলাইনে যা হোম ওয়ার্ক দিচ্ছে তা তো সে করছেই! আর ইদানীং তার মনে হয়, এত পড়েই বা কি হবে? করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সব মানুষতো মরেই যাবে! তার মাথায় সারাক্ষণ উল্টাপাল্টা সব কথা ঘুরছে। ভয় পাচ্ছে এই ভেবে যে, যদি তার কাছের প্রিয়বন্ধু বা মানুষকে হারিয়ে ফেলে।

বয়ঃসন্ধিকালে সব মানুষই মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে পারিপার্শ্বিক এই পরিবর্তন তাদেরকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। যদি পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যরা শিশুদের শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও যত্নবান না হন।

তাই পরিবারের শিশুদের প্রতি এসময় বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। মাঝে মাঝে উদ্বিগ্ন হওয়া এই সময়ে স্বাভাবিক। তবে সারাক্ষণ দুঃশ্চিন্তা করা, ঘুমের সমস্যা হওয়া, দুঃস্বপ্ন দেখা, খাবারে অনীহা প্রকাশ, পড়াশোনা বা যেকোনো কাজে মনোযোগ দিতে না পারার মতো বিষয়গুলো স্বাভাবিক বলা যাবে না।

আর এই অবস্থায় শিশুটির জন্য একজন মনোবিজ্ঞানীর বা মনোঃচিকিৎসকের এর শরণাপন্ন হতে হবে।

আর পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছু বিষয় আমাদের দৈনন্দিন চর্চায় আনতে হবে।

প্রথমত: করোনাভাইরাসের এই মহামারীরর পরিস্থিতিতে বাবা-মা তাদের সন্তানকে জীবনের খুব মূল্যবান দর্শনের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দিতে পারেন; আমাদের জীবনে বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন অনিশ্চয়তা আসে এবং সেই অনিশ্চয়তার ভিতরেও জীবনকে আমারা এগিয়ে নেই।

বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মাধ্যমে আপনি আর আপনার সন্তান সেই ইতিবাচক দর্শনটাকে একসঙ্গে আত্মস্থ করছেন এবং নতুন একটা পথে হাঁটছেন! এভাবে সন্তানের কাছে এই সঙ্কটের সময়টা তুলে ধরা যেতে পারে। বারবার শঙ্কা বা উদ্বিগ্নতার কথা সন্তানের সামনে না বলে, নিজেদের ভেতরে অথবা বন্ধুমহলে অথবা আত্মীয়ের সঙ্গে টেলিফোনে বা অনলাইনে যোগাযোগ করতে পারেন। আর নিজেরা একটু হালকাবোধ করতে পারেন।

মহামারীর দিনে ঘরবন্দি জীবন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

দ্বিতীয়ত:
বড়দের মতো এসময় বাচ্চাদের ভেতরেও একটা হারানোর ভয় কাজ করতে পারে। আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুদের থেকে সামাজিক দূরত্বে থাকার কারণে তাদের ভেতরে কিছু চিন্তা আসতে পারে। যেমন- বন্ধুদের সঙ্গে দূরত্বের কারণে যদি কোনো বন্ধু হারিয়ে যায়; যদি তারা আর তাদের দৈনন্দিন উপভোগ্য কাজগুলো যেমন- খেলাধুলা, ঘুরতে যাওয়া ইত্যাদি কখনও করতে না পারে; করোনারভাইরাসের প্রভাবে যদি কাছের কাউকে হারিয়ে ফেলতে হয় ইত্যাদি।

এই ধরনের নেতিবাচক চিন্তার ফলশ্রুতিতে তারা ভীষণ একাকিত্ব, অসহায়, বিষণ্ণ আর আশাহত অনুভব করতে পারে। তাই শিশুরা এই পরিস্থিতিতে কী ভাবছে এবং কী অনুভব করছে তা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। তাদের অনুভূতির প্রকাশটাকে বাধা না দিয়ে শ্রদ্ধা করতে হবে অর্থাৎ শিশুদেরকে আশ্বস্ত করতে হবে যে, এই পরিস্থিতিতে তার ভেতরের অনুভতিগুলো প্রকাশের ক্ষেত্রে আপনি তার পাশে আছেন।

যখন কোনো পরিস্থিতি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না সেটা আমাদের মধ্যে ভীতি, হতাশা এবং উদ্বিগ্নতার সৃষ্টি করে। আর এই অনুভূতিগুলো সবসময়ই আমাদের মনে অনুভূত হতে থাকলে শরীরেও এর একটি প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। আমরা অসুস্থবোধ করি। তাই যেটা আমাদের  নিয়ন্ত্রনের বাইরে তা থেকে ভাবনাটা যদি একটু বিপরীত দিকে সরিয়ে ফেলি, তাহলে কেমন হয়? অর্থাৎ যা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি সেটার উপরে মনোযোগ দেওয়া। যেমন- নিরাপদ থাকার নিয়মগুলো নিজে মেনে চলা এবং অন্য মানুষকে সচেতন করা, নিজের দক্ষতা আর সামর্থ্যকে কাজে লাগিয়ে সমাজের মানুষের জন্য কিছু করা।

বর্তমান পরিস্থিতিতে বাচ্চাদের ভেতর মানবতাবোধ তৈরি এবং আত্মস্থ করার এক মোক্ষম সময়।

তৃতীয়ত: এই কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে বিভিন্ন পরিবারে বিভিন্ন দুর্যোগাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। বাড়ির বড়রা উদ্বিগ্ন থাকতে পারেন এবং অনেক সময় বাড়ির শিশুদের সঙ্গে নেতিবাচক আচরণও করে ফেলতে পারেন। ফলে শিশুরা মনের ভেতরে ভীষণ উদ্বিগ্ন বোধ করে, নিজেদের অসহায় এবং ছোট ভাবতে থাকে।

এটা না করে বরং শিশুদের সঙ্গে এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করা যেতে পারে। আর এ অবস্থা উত্তরণে তাদের কোনো পরামর্শ আছে কিনা এবং না থাকলেও তারা তাদের অবস্থান থেকে কি করতে পারে সেটা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। এতে তারা পরিবারের সঙ্গে একাত্মবোধ করবে। একাকিত্ব বোধের বদলে নিজেকে পরিবারের একজন সক্রিয় সদস্য ভাবতে শিখবে।

চতুর্থত: করোনাভাইরাস সংক্রান্ত আপডেটগুলো বিশ্বস্ত তথ্যসূত্র থেকে জানতে হবে। আর এ সংক্রান্ত খবর জানার ক্ষেত্রে শিশুর বয়সটাও গুরুত্বপূর্ণ।

খুব ছোট শিশু (৬-১২ বছর) যদি সার্বক্ষণিক এ সংক্রান্ত নিউজ দেখে তাহলে তাদের মস্তিষ্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আর একটু বড় শিশুদের (১৩-১৮ বছর) ক্ষেত্রে বাস্তবিক নিউজগুলো দেখতে দেওয়া যেতে পারে তবে সার্বক্ষণিক তারা যাতে টিভি/ সোশ্যাল মিডিয়াতে এ সংক্রান্ত নিউজ না দেখে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

কারণ যেকোনো নেতিবাচক ঘটনা বা ছবি অথবা ভিডিও শিশুসহ যেকোনো বয়সীদের মস্তিষ্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে যদি তার মাত্রা অতিরিক্ত হয় যদিও মানুষ আর বয়সভেদেও এর প্রভাব ভিন্ন হতে পারে। 

তবে বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাওয়া নয় বরং বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া শেখাতে হবে আমাদের শিশুদের।  

পঞ্চমত: শিশুর স্কুল বন্ধ বলে বাসায় সারাক্ষণ পড়াশোনার জন্য তাকে চাপ প্রয়োগ করতে থাকলে বা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সার্বক্ষণিক উপদেশ দিতে থাকলে সেটা কার্যত কোনো ইতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসেনা। এ সময়ে যেহেতু শিশুরা সার্বক্ষণিক ঘরে থাকছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে খেলাধুলা এবং শরীরচর্চার সুযোগ সীমিত। তাই একটু অন্য উপায়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে।

বাসার ছাদে, নিরাপত্তার ঝুঁকি না এড়িয়ে বাচ্চাদেরকে খেলতে দেওয়া যায় কিনা দেখা যেতে পারে। যাদের ইনডোর গেমসের সরঞ্জাম আছে তারা ঘরের ভেতরেই প্রত্যেকদিন অন্তত এক ঘণ্টা খেলার ব্যবস্থা করতে পারেন।

তাছাড়া বাবা মায়েরা নিজেদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য সন্তানকে সঙ্গে নিয়েই ছাদে হাঁটতে পারেন। এছাড়াও ঘরের কাজে নিয়োজিত করা যেতে পারে। এতে তারা স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার দক্ষতা অর্জন করবে।

বাচ্চারা কথা নাও শুনতে চাইতে পারে। এক্ষেত্রে নেতিবাচকভাবে না বলে বরং ইতিবাচকভাবে আবেদন করলে বা সাহায্য প্রার্থনা করলে শিশুরা বাবা মায়ের কথাগুলো শুনতে আগ্রহী হবে।

শিশু সার্বক্ষণিক ঘরে থাকার কারণে পড়াশোনার পাশাপাশি তার ধর্মীয়চর্চা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা, যে কোন সৃষ্টিশীল শখের কাজে নিয়োজিত হতে পারে।  

ষষ্ঠত: যে কোনো উদ্বিগ্ন পরিস্থিতিতে নিয়মিত শ্বাস প্রশ্বাসের দিকে গুরুত্ব দিতে হয়। কারন নিয়মমাফিক এবং মনযোগী শ্বাস প্রশ্বাস আমাদের উদ্বিগ্নতার স্তর কমিয়ে আমাদের মস্তিষ্ককে সচল রাখতে সাহায্য করে। বাবা মায়েরা নিজেদের পাশাপাশি শিশুদেরও এ বিষয়ে অবগত করতে পারেন।

মনে রাখতে হবে

যেসব বিষয় আমাদের মনে ভালোলাগা তৈরি করে সেই বিষয়গুলোতে মনযোগী হতে হবে। বাবা মায়ের ভালো বোধ করার সঙ্গে সন্তানের মানসিক ভাবে ভালো থাকা জড়িত। কারণ বাচ্চারা অনেকাংশে অনুভূতির প্রকাশ শেখে বাবা মায়ের অনুভূতির প্রকাশ থেকে। পরিবারের সব সদস্যরা দিনের কোনো একটা সময়ে ‘আনন্দ ঘণ্টা’ কাটাতে পারেন। যেমন, একসঙ্গে বসে একঘন্টা আনন্দের সব বিষয় নিয়ে স্মৃতিচারণ করা।

এ পরিস্থিতিতে জীবনকে উপভোগের পরিবর্তে, জীবন বাঁচানোর দিকেই সবাই মনোযোগী হয়ে পড়ায় মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়াটা অনেকের কাছে বিলাসিতা মনে হলেও হতে পারে। তবে জেনে রাখুন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা খুবই জরুরি। কারণ মানসিক সুস্বাস্থ্যই কিন্তু শারীরিক সুস্বাস্থ্যের ইন্ধনদাতা। তাই নিজে ভালো থাকুন এবং আপনার পরিবারের শিশুটিকে ভালো রাখুন। তারাই কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ।

শিক্ষা ও শিশু মনোবিজ্ঞানী ইরফানা সামিয়া

লেখক পরিচিতি: শিক্ষা ও শিশু মনোবিজ্ঞানী, সাইকোথেরাপিস্ট ও কাউন্সেলর; ন্যাশনাল ইনস্ট্রাক্টর- ইয়ুথ মেন্টাল হেল্থ ফার্স্ট এইড।