কোয়ারেন্টিনে মানসিক চাপ দূরে রাখতে

রোগ সম্পর্কিত খবর দেখা কমানোর পাশাপাশি ভালোলাগার কাজে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে।

তৃপ্তি গমেজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 April 2020, 09:19 AM
Updated : 11 April 2020, 09:19 AM

কোভিড-১৯ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারা বিশ্ব। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ রয়েছে ‘লকডাউন’ অবস্থায়।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘লকডাউন’য়ের অর্থ বোঝাচ্ছে- নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়া এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। এই সময় মানুষ চাইলেও নিজের স্বাভাবিক রুটিন অনুযায়ী চলতে পারছেনা। তাই খানিকটা বিরক্তির উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট’য়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশে চলছে ‘অস্বাভাবিক পরিস্থিতি’। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক। এরপরও চেষ্টা করতে হবে যতটা সম্ভব নিজেকে এমন মানসিক দুরাবস্থা থেকে দূরে রাখা।’

ছোট-বড় সকলের মধ্যেই এক টানা ঘরে আবদ্ধ থাকায় কম বেশি মানসিক চাপ দেখা দিচ্ছে। এছাড়াও, সারাক্ষণ কোভিড-১৯’য়ের ‘আপডেট’ বা এর ভবিষ্যৎ ফলাফল কেমন হতে পারে তা নিয়ে আতঙ্কিত থাকাটাও মানসিক চাপ সৃষ্টির অন্যতম কারণ।

অষ্টম শ্রেণির ছাত্র যোসেফ কস্তা এই লকডাউনে তার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে বলেন, “শুরুতে স্কুল ছুটি খুব ভালো লাগছিল। কিন্তু এখন আর ভালো লাগেনা। সারাদিন বাসায় বসে থাকা, মোবাইলে গেইম খেলা আর মাঝে মধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। তাছাড়া বাবা মা সবাই বাসায় থাকায় সারাক্ষণই কিছু না কিছু নিয়ে উপদেশ দেয়। কথা না শুনলে চ্যাঁচামেচি করে।”

“আবার স্কুল বন্ধ থাকায় পড়াশুনা হচ্ছে না ঠিক মতো। সেটা নিয়েও মাঝেমধ্য দুঃশ্চিন্তা হয়।” বলেন যোসেফ।

কর্মজীবী নারীদের মাঝেও দেখা দিচ্ছে মানসিক চাপ। একাধারে ঘর ও অফিসের কাজ করে আবার দেশের খারাপ পরিস্থিতি অনেকটাই মানসিক বিপাকে ফেলেছে তাদের।

হার্ডকো ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষক মিশেল দাসের কথায়, “ঘরে বসে কাজ করায় অনলাইনে স্কুলের কাজ অনেকটাই বেড়ে গেছে। আবার সারাক্ষণই ঘরের সকল কাজ করতে হচ্ছে। তো বলা যায় সারাদিনই ব্যস্ত থাকা হয়।”

“আসলে ঘরে আছি বলেই যে অবসর আছে তা নয়। বরং কাজের চাপ বেশি। আবার সারাদিন আক্রান্ত ও মৃতের খবর দেখে আতঙ্কিত অনুভব করি। ঘরে থাকতে থাকতে মন মেজাজ অনেকটাই খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, “যে কারণে হঠাৎ রেগে যাওয়ার প্রবণতা বা উঁচু স্বরে কথাবলে ফেলার মতো সমস্যা দেখা দিচ্ছে। প্রয়োজনীয় সব কাজ করার পাশাপাশি দৈনদিন জীবনযাত্রার রুটিন মেনে চলাটা বেশ মানসিক চাপের সৃষ্টি করছে।”

মহামারীর খবর শুনে অনেকেই ঢাকা ছেড়েছেন। তবে যারা ভবিষ্যৎ ও পারিবারের মানুষদের কথা বিবেচনা করে বাড়িতে যায়নি তারা কাটাচ্ছেন দুর্বিসহ সময়।

পুরান ঢাকার বাসিন্দা সোয়াস আহমেদ বলেন, “করোনাভাইরাসের প্রকোপ এড়াতে ১৭ তারিখ থেকেই সামাজিক দূরত্ব মেনে চলছি। আর এই কারণে সব কিছু বন্ধ হয়ে যাবে জেনেও বাড়িতে যাইনি।”

“পরিবারের সবার থেকে দূরে থাকা আবার  সারাদিন ঘরে একা একা সময় কাটানোর বিষয়টা খুবই বিরক্তিকর, কষ্টকরও। কিন্তু পরিবারের সকলের কথা ভেবেই আমি আসলে ঢাকায় রয়ে গেছি।”

“সময় কাটাতে এসময় বই পড়া, নিজের ঘর গোছানো বা সিনেমা দেখা ছাড়া করার মতো আর কোনো কাজ নেই। তবুও চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব নিজেকে অবসাদ ও মানসিক চাপ থেকে দূরে রাখার।”

মানসিক চাপ সৃষ্টি ও তা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে ডা. হেলাল সকলকে সুস্থ, স্বাভাবিক ও সুন্দর পারিবারিক জীবন কাটানোর চেষ্টা করার পরামর্শ দেন।

তিনি বলেন, “এই সময়ে সবারই মানসিক চাপ বেশি কাজ করছে এবং মানসিক চাপ বৃদ্ধির নানা রকম সমস্যা যেমন- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস, মাথাব্যথা, খিটমিটে মেজাজ ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।”

“এই পরিস্থিতে মানসিক-ভাবে সুস্থ থাকতে নিজেদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে হবে। যেমন ঘরে বসে আমার কোনো কাজ নেই বা কী করবো সারাদিন- এমনটা ভেবে সময় কাটালে অবসাদ দ্রুত গ্রাস করবে।”

তিনি পরামর্শ দিতে গিয়ে বলেন, “আমাদের মনকে বোঝাতে হবে, ঘরে থাকাটাই এখন আমাদের কাজ। ঘরে থেকে নিজেকে সময় দেওয়া, পরিবারের সবার সঙ্গে গুণগত সময় কাটানো, সবাই একসঙ্গে আছি এই সময়টাকে উপভোগ্য করে তোলার মাধ্যমে মানসিক চাপ কাটানোর চেষ্টা করতে হবে।”

“পরিবারের শিশুদেরকে করোনাভাইরাস নিয়ে ভয় না দেখিয়ে বরং এর সম্পর্কে তথ্য বহুল পরামর্শ ও সতর্ক করার চেষ্টা করতে হবে। পিপিই পরিহিত মানুষের ছবি দেখিয়ে, পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে কয়েকদিন আলাদা থাকতে হতে পারে ইত্যাদি বিষয়ে আগে থেকেই অবগত করা ভালো, এতে তারা যে কোনো অবস্থা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারবে।”

“যারা পরিবার থেকে দূরে আছেন তাদেরকে চেষ্টা করতে হবে যতটা সম্ভব নিজেকে পছন্দের কাজে নিয়োজিত রাখার। গেইমস, সিনামা বা গল্পের বই পড়ে সময় কাটানো যেতে পারে। এছাড়াও শখের কোনো কাজ থাকলে তা করার প্রতি মনোযোগ দিতে পারেন।” বললেন ডা. হেলাল।

এই প্রযুক্তি নির্ভর সময়েও চেষ্টা করতে হবে সারাটা সময় কেবল মোবাইল, টেলিভিশন বা কম্পিউটারের সঙ্গে না কাটিয়ে পরিবার পরিজনদের সঙ্গে কাটানো।

তিনি আরও বলেন, “সারাক্ষণ কোভিড-১৯’য়ের খবর না নিয়ে এর পাশাপাশি পছন্দের অনুষ্ঠান দেখা বা পছন্দের কাজ করা উচিত। তাহলে মন আতঙ্ক থেকে রক্ষা পাবে। আর সারাক্ষণই যদি খারাপ খবর নিতে থাকেন তাহলে ভাইরাস আক্রমণ করার আগেই মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে যাবে।”

উপরের বিষয়গুলো মাথায় রাখার পাশাপাশি ডা. হেলাল উদ্দিন সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও সময় মতো খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন।

“ঘরে বসে থেকে অনেকেরই ওজন বৃদ্ধির সমস্যা দেখা যায়। তাই এসময়ে প্রোটিন নির্ভর খাবার খাওয়া, কার্বোহাইড্রেইট কম খাওয়া ও হালকা শরীরচর্চা করতে হবে।”

এছাড়াও, কোনোভাবেই যেন ঘুম চক্রে ব্যাঘাত না ঘটে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। চাইলে দিনে কাজের পরে বিশ্রাম নেওয়া যেতে পারে। দিনে কাজ করা এবং রাতে ঘুমের অভ্যাসের যেন কোনো পরিবর্তন না হয় সেদিকে বিশেষভাবে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

আরও পড়ুন-