ব্লাউজের পরিবর্তে ‘ক্রপ টপ’

ব্লাউজ ছাড়াও শাড়ি পরা যায় যদি সংগ্রহে থাকে নানান ধরনের টপস।

রুম্পা সৈয়দা ফারজানা জামানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Feb 2020, 09:47 AM
Updated : 3 Feb 2020, 11:13 AM

এই শাড়ি নিয়ে কতই না গল্প! শাড়ি নিয়ে কত আলোচনা – সমালোচনা, শাড়ির প্যাঁচে নিয়ে কত জল্পনা। কিন্তু যে কারণে শাড়ি হয়ে ওঠে আল্পনা-তা নিয়ে কিন্তু কথা কম হয় না! সেই আল্পনার নকশা, রং বা চরিত্র শাড়ির থেকেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বলছি ব্লাউজের কথা।

গায়ক সঞ্জীব চৌধুরী যখন গেয়েছিলেন ‘তোমার ভাঁজ খোল আনন্দ দেখাও’ তখন সেই আনন্দটা ছিল হয়ত ব্লাউজেই!

আবার শাড়ির আঁচল যখন এলোমেলো ভাবে উড়ে যায়- তখন কিন্তু অঙ্গে জড়িয়ে থাকে ব্লাউজ। আর সেই আবেদন কোনো ভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার নয়।

ছবি: সজীব।

কারণ শাড়ি যদি হয় ‘আবেদনময়ী’ পোশাক – সেই পোশাকের অলঙ্করণের মূল অংশ হচ্ছে ব্লাউজ। তা সে দ্বীপের মতো মূল ভূখণ্ড থেকে একটু দূরে থাকুক! বা লেগে থাকুক অঙ্গে–ঢঙ্গে।

যদিও ব্লাউজের গল্প শুরু ‘পছন্দ নয়’ থেকে! ইতিহাস বলে, শেরশাহের আমলের আগে ভারতবর্ষের নারীরা তাদের বক্ষ উন্মুক্ত রাখত। খুব বেশি দরকার হলে এক টুকরো কাপড় দিয়ে বুক বেঁধে রাখতো। তবে রানি ভিক্টোরিয়ার সেটি পছন্দ হত না। তার ইচ্ছে অনুযায়ী তৈরি হয় নারীর জন্য শাড়ির নিচে পরার পোশাক যা ব্লাউজ নামেই পরিচিত।

ওদিকে আবার ইতিহাসে আছে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীকে শাড়ির নিচে নগ্ন বক্ষের কারণে ব্রিটিশ রাজের আমলে ক্লাবে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়েছিল। এটাও ব্লাউজ পরার জন্য এক ধরনের ‘এলিট’ চাপ ছিল বলে ধরে নেওয়া হয়।

১৮৯০ সাল থেকে অল্প-স্বল্পভাবে মহিলাদের ফ্যাশন হিসেবে ব্লাউজের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ১৮৯০ সালে একটি ব্লাউজ এবং একটি প্লেন স্কার্ট ছিল উঠতি বয়সি তরুণীদের আদর্শ পোশাক। ১৯০০-১৯১০ সাল থেকে সামাজিক পরিবর্তনের পাশাপাশি ব্লাউজে স্টাইলেও শুরু হয় নানান পরিবর্তন।

শুরুটা হয় ইংরেজ নারীদের টপসের স্টাইল দিয়েই। ইংরেজ নারী যেভাবে উপরে ছেলেদের শার্টের মতো ব্লাউজ এবং নিচে লং স্কার্ট পরত। তাদের এ-পোশাক দেখে ভারতবর্ষের মেয়েরা আকৃষ্ট হত বলে ধরে নেওয়া হয়।

এরপরেই শুরু হয় সেই কাঙ্ক্ষীত রাবীন্দ্রিক যুগ। রবীন্দ্রনাথের ভাতিজি শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ পরার প্রচলন শুরু করেন। ধীরে ধীরে ভারত উপমহাদেশের ধনী এবং সুশীল শ্রেণির নারীদের মধ্যে ব্লাউজ পরার প্রচলন শুরু হয়।

এই শুরু হল শাড়ি হোক যথা তথা – ব্লাউজ হোক কোনো না কোনো কবিতা।

রবীন্দ্রনাথের পরিবারের মেয়েদের মতো ‘ফ্রিল’ দেওয়া থ্রিকোয়ার্টার হাতার ব্লাউজ পরা আদি-আধুনিক নারীদের ছবি এখনও ভাসতে দেখা যায় সামাজিক মাধ্যমে।

তারপর আসে সুচিত্র সেনের ভি কাটের ব্লাউজ।

এরপরের গল্প সবই সিনেমার বা নাটকের নারীদের কেন্দ্র করে। গোল গলা, গভীর কাট বা ভি-কাট সবই যুগের আর ট্রেন্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আসতে থাকে।

পরিবর্তনটা আসে তারপর। নব্বইয়ের দিকে যখন হিন্দি সিরিয়াল যুগের রূপ বদলে দিচ্ছে তখন বিভিন্ন নাটকে পোশাকের ঢংও বদলাতে থাকে। টি শার্ট বা হাত ছাড়া টপসের সঙ্গে শাড়ি পরতে দেখা যায় মূল নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করা শিল্পীদের।

কারণ এখনও উপমহাদেশে ‘বোল্ড’ মানে সুন্দর নয় ‘উদ্ধত’-ই ধরে নেওয়া হয়।

মিলেনিয়ামের পর আসল পরিবর্তন আসতে থাকে বাংলাদেশে। পশ্চিমবঙ্গের নারীরা তখনও রাবীন্দ্রিক ঘরানায় থাকলেও বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের মেয়েরা শুরু করে নানা রকমের নীরিক্ষা।

যা এখন পুরাটুকুই ট্রেন্ড।

“আজকাল আর ব্লাউজ কিনি না”- বলেন মিতি হক।

পেশায় প্রকৌশলি মিতি আরও বলেন, “ক্রপট দিয়ে ভালো মতোই শাড়িটা পরে নেওয়া যায়। দেখতেও লাগে বেশ। তাই আর ব্লাউজের পেছনে সময় দিতে হয় না।”

একই কথা বলেন, রাজশাহীর ইথেল। তিনি নিজেও শার্ট বা টিশার্ট দিয়ে শাড়ি পরে ফেলেন।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে অনেক দেশীয় ফ্যাশন হাউজ এখন ক্রপ টপ- বা খাটো দৈর্ঘ্যের টপের দিকেও মনোযোগ দিচ্ছে। কারণ শাড়ির সঙ্গে অনেকে এটাই বেছে নেন।

ছবি: মাহমুদ হোসেন অপু।

দেশীয় ফ্যাশন ঘর ‘বিবিয়ানা’র স্বত্বাধিকারী এবং ডিজাইনার লিপি খন্দকর নিজেই শাড়ির সঙ্গে টপ মিলিয়ে সেট তৈরি করেন। তৈরি করছেন নানা ফ্রেব্রিকের ক্রপটপ।

ওদিকে বাজার ঘুরে দেখা গেছে ‘গেঞ্জি’ কাপড় ছাড়াও আঁটোসাঁটো টপ তরুণীদের পছন্দের জায়গায় স্থান করে নিচ্ছে। নানান রকমের নীরিক্ষায় চলে আসছে জিন্স কাপড়ের ক্রপ টপ, ফরমাল শার্ট বা হাতাকাটা ইভিনিং টপস– তাও আবার ব্লাউজ হিসেবে।

শাড়ি পরার ধরনে পরিবর্তনও চলে আসছে ব্লাউজের কারণে। যেহেতু ব্লাউজগুলোর কাট ঠিক ওমন ‘খাঁজকাটা’ নয়, তাই সামনে ভাঁজ করে ব্লাউজটাকে বেশি হাইলাইট করে শাড়ি পরার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে।

ঐতিহ্যবাহী ব্লাউজের কাপড়ের বাইরে গামছা কাপড়, লিলেন বা ভেলভেটের তৈরি টপস জায়গা করে নিচ্ছে ফ্যাশন সচেতন নারীদের বুকে।

ব্লাউজের প্রচলিত কাটে অভ্যস্ত না হওয়ায় শিক্ষিকা মিথিলা রহমানও তার কিশোরী কন্যাকে উৎসাহ দিয়েছেন টপসের সঙ্গে শাড়ি পরার জন্য।

সব মিলিয়ে বিষয়টি শেরশাহের ব্লাউজ বা কাপড়ে নেই– চলে এসেছে ‘মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ’য়ের দরজায়।

যা রানি চাপাতে চেয়েছিল- তা নিজের মতো করেই আকড়ে ধরছেন এখন এই উপমহাদেশের নারীরা।

টপসের সঙ্গে কখনও ট্যাসেল বা কখনও ঝুনঝুনি দিয়ে যেমন বাঙালিয়ানা তুলে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে, আবার অফশোল্ডার টপস শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে পরে প্রাচ্য- পাশ্চাত্যের মাঝে সমন্বয় করে নতুন গল্প লেখার চেষ্টাও করছেন নারীরা। আর সেই গল্প মোটামুটি সফল, কেননা এখন শুধু ব্লাউজ কেন্দ্র করে অনলাইন শপগুলো আরও ভাবছে।

ঢাকার বদরুদ্দোজা মার্কেট তো বটেই থাইল্যান্ড বা মালয়শিয়া থেকে আনছে ক্রপটপগুলো। ফ্যাশন হাউজগুলো বিভিন্ন কাটে–ছাঁটে বানাচ্ছে ক্রপটপ। তৈরি হচ্ছে অন্যরকমে একটি চাহিদা।

দামও বেশি নয়। রাজধানীর ঢাকা কলেজের উল্টা পাশের নুরজাহান মার্কেটের ভেতরের দোকানগুলোতে দেড়শ থেকে ৩শ’ টাকার মধ্যে মিলবে নানান ধরনের ক্রপটপ।

দেশীয় ফ্যাশন ঘরগুলোতেও রয়েছে ক্রপটপের সংগ্রহ। কাপড় ও কাট-ছাঁটের ধরনে দাম শুরু দেড় হাজার টাকা থেকে।

তাই অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ যতই দুঃখ ভরে লিখুক না কেনো- নারীরা আর শাড়িতে নেই হয়তো- নারীরা শাড়ি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়নি।

বরং রোজ কী করে গায়ে জড়ালে কামনার বদলে প্রশংসার দৃষ্টি থাকবে সবার চোখে– সেটা নিয়েই করে চলছে নানান নীরিক্ষা।

কারণ এই বারো হাতের যে গল্প সেই গল্প এখন শেরশাহের আমলে নেই- বক্ষ উন্মোচনে স্বস্তির যুগও নেই।

যুগ বুঝে যোগ চলছে তাই নারীর পোশাকের ঢঙ্গে- ব্লাউজের সঙ্গে।

ছবির মডেল: লেখক।