চলছে পার্বত্য মেলা ২০১৯

৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই আয়োজন চলবে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

মামুনুর রশীদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Dec 2019, 01:16 PM
Updated : 6 Dec 2019, 01:18 PM

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দ্বিতীয়বারের মতো এই মেলার আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে এই মেলা।

পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা, পোশাক-পরিচ্ছদ, সংস্কৃতি, খাবার ইত্যাদির সঙ্গে শহরের মানুষকে পরিচয় করিয়ে দিতেই এই মেলার আয়োজন করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

প্রধান অতিথি হিসেবে মেলার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্ট ড. গওহর রিজভী। এছাড়াও অনুষ্ঠানের সভাপতি দায়িত্বে ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাঙ্গামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার, খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, সংরক্ষিত আসনের সাংসদ বাসন্তি চাকমা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা।

এবারের মেলায় প্রায় ১০০টি স্টল বসেছে, যার মধ্যে সিংহভাগই বিভিন্ন পাহাড়ি খাবারের দোকান। এমনই একটি স্টল সিএইচটি এক্সপ্রেস।

রাজধানীর কাজিপাড়ায় অবস্থিত এই রেস্তোরাঁর কর্ণধার অর্পন চাকমা বলেন, “বেশির রেস্তোরাঁই আসলে ঢাকার নয়, বরং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার। মেলা উপলক্ষ্যেই তারা এসেছেন। এসব স্টলগুলোতে পাবেন কাঁকড়া, পাহাড়ি বুনো মুরগি, মাছ, মাংস, মাশরুম ইত্যাদির বিভিন্ন পদ। ছেচমাহ-মুহ পিঠা, সান্যি, বিন্নি পিঠা, কলা পিঠা, আফ্রেমুহ পিঠা ইত্যাদিসহ বিভিন্ন ধরনের পিঠা পাওয়া যাবে।”

পাহাড়ি পিঠার পাশাপাশি নকশি পিঠা, চাপটি, তেলের পিঠা, মালপোয়া ইত্যাদি দেশীয় পিঠার স্বাদ নিতে পারবেন যো তৈরি হচ্ছে পাহাড়িদের হাতে পাহাড়ি কায়দায়। মেলার দর্শণার্থীদের মাঝে খাবারের প্রতি প্রবল আগ্রহ চোখে পড়ার মতো।

শিল্পকলা একাডেমির নৃত্য প্রশিক্ষক ফিফা চাকমা ঘুরিয়ে দেখান মেলা প্রাঙ্গন, পরিচয় করিয়ে দেন তাদের সংস্কৃতির বিভিন্ন দিকের সঙ্গে।

তৈরি খাবারের পাশাপাশি জুম পদ্ধতিতে চাষ করা বিভিন্ন শাকসবজি, ফল, কাঁচা তরকারি, মশলা, ভেষজ উপকরণ, চাল, ডাল ইত্যাদি সবকিছুর পসরা সেজেছে মেলায়।

‘জুম ফুড’ নামক স্টলটি এ্মনই একটি স্টল। তুলনামূলক বড় এই স্টলে পাহাড়ি, কমলা, মাল্টা, ভূট্টা, আনারস, কলা, পেঁপে ইত্যাদি বিভিন্ন ফল মিলবে। এছাড়াও বিশেষ পাহাড়ি ফল তো আছেই। বিন্নি চাল, নানানপদের মসলা, ডাল- কি নেই এখানে। মেলা ঘুরতে এসে মাসের বাজার সেরে ফেলতে পারবেন অনায়াসে।

রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের শান্তিময় চাকমা তার স্টল ঘুরিয়ে দেখান। স্টলে আরও জানতে পারবেন জুম ঘর সম্পর্কে। কৃত্রিমভাবে তৈরি জুম ঘরের নমুনা সাজানো আছে স্টলের পেছন দিকে।

শান্তিময় চাকমা বলেন, “জুম ঘরের সিঁড়িকে বলা হয় ‘হবাক’, বীজ বোনার জন্য মাটি খুড়তে যে দা ব্যবহার হয় তার নাম ‘চুচ্চাং তাগল’, আরকটি ছোট কাস্তেও থাকে যার নাম ‘চাঁড়ি’, পানি পানের পাত্রের নাম ‘ঘুত্তি’, সেটা যে শিকেয় রাখা হয় তার নাম ‘জুরি’।”

এছাড়াও জানা যাবে কীভাবে পাহাড়ি মানুষ চাষের কাজ করেন। ফসল ওঠানোর পর জমি ফাঁকা না রেখে কীভাবে সেখানে স্বল্প সময়ে ফলের চাষ করা যাবে ইত্যাদি।

পাহাড়ি পোশাকের দোকানের আধিক্যও চোখে পড়ার মতো। ত্রিশিলা চাকমার প্রতিষ্ঠানটির নাম তারেং, তৈরি করেন পাহাড়ির সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তোলে এমন ডিজাইনের টিশার্ট।

তিনি বলেন, “শুরুটা টিশার্ট দিয়ে হলেও বর্তমানে কাজের পরিধি বেড়েছে। পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহি কোমর তাঁতে বোনা রেয়ন সুতার কাপড় দিয়ে তৈরি করছি পাঞ্জাবি। ‘রেয়ন’ কাপড় হিসেবেই এই কাপড় আমাদের সমাজে পরিচিত। এছাড়াও বান্দরদনের বম সম্প্রদায়ের হাতে বোনা মাফলার নিয়ে এসেছি আমরা। আরও আছে গায়ের চাদর, যার পাহাড়ি নাম ‘বর্গী।”

ঢাকার কাজিপাড়ায় তাদের একটি দোকান আছে।

কোমর তাঁত আর বাঙালির চিরচেনা তাঁতে বোনা কাপড় নিয়েই কাজ করেন বেইন টেক্সটাইলের নিতা চাকমা। তার কোনো দোকান নেই, পাহাড়ি সম্প্রদায় আর পূর্ব পরিচিতদের মাঝেই তার ব্যবসা সিমিত। তার স্টলে দেখা গেল বিভিন্ন ফতুয়া, পাঞ্জাবি, শাল, থামি, পিনন, ওড়না, ব্যাগ, বিছানার চাদর ইত্যাদি। মধ্যবিত্ত দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির শৌখিন অন্দরসজ্জা ও বেশভুষাতেই ব্যবহার হয় তার তৈরি করা পণ্যগুলো। আর বাঙালিদের মাঝেও পাহাড়ি বস্ত্র শিল্প বেশ জনপ্রিয় বলেই মন্তব্য করেন নিতা চাকমা।

খাবার আর পোশাকের দোকানে ফাঁকে কিছু অলঙ্কার ও ঘর সাজানোর অনুষঙ্গের দোকানও চোখে পড়বে। ঋতিশা চাকমার ‘বক্স অফ অর্নামেন্টস’ এমনই একটি দোকান যারা কাজ করেন রুপা নিয়ে।

পাহাড় আর সমতলের মানুষের ব্যবহার করা অলঙ্কারের ঐতিহ্য আর নকশাকে একত্রিত করে আধুনিক ধাঁচের গহনা তৈরিই তার উদ্দেশ্য। ফেইসবুক পেইজের মাধ্যমে সেই লক্ষ্য অর্জনেই তিন বছর ধরে কাজ করছেন ঋতিশা।

পার্বত্য চট্টগ্রামের এক এনজিও ‘আশিকা’, আর এই মেলার তাদেরই স্টল হল আশিকা ব্যাম্বু ফার্নিচার। আছে বাঁশ কেটে তৈরি গাছ লাগানোর টব। তবে তা অন্দরসজ্জার কাজেও অনায়াসেই ব্যবহার করা যাবে। আরও আছে বাঁশের তৈরি ল্যাম্প, ফুলদানি, তিন তাকের ‘র‌্যাক’ বা ‘শেল্ফ’। ল্যাম্পের মধ্যে একটি বেশ চমকপ্রদ। এর নিচের অংশটি একটি বড় নারকেলের আস্ত খোলস, আর উপরের অংশটি বাঁশের, সামান্য বেতের ব্যবহারও আছে নিচের অংশে।
বিপ্লব চাকমার পরিচালনায় চলা এই প্রতিষ্ঠান তাঁতের শাড়ি ও অন্যান্য বস্ত্রশিল্প নিয়েও কাজ করছে।

স্টল ছাড়াও মেলায় মাঝখানে প্রতিদিন থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। যেখানে বাঙালি গান তো থাকবেই, সঙ্গে থাকবে পাহাড়িদের লোকজ সংগীত ও নৃত্য পরিবেশনা। দেশের পার্বত্য অঞ্চলগুলো থেকে প্রতিদিনই বিভিন্ন শিল্পি গোষ্ঠী আসবেন তাদের পরিবেশনা নিয়ে।