ডেঙ্গু সম্পর্কে যা জানা থাকা জরুরি

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হাওয়া নিশ্চিত করতে চাই সঠিক সময়ে পরীক্ষা।

মামুনুর রশীদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 August 2019, 11:00 AM
Updated : 3 August 2019, 11:00 AM

কয়েক মাস আগেও অসংখ্য মশা কামড়ালেও নিজের গায়ে দুই একটা চাপড় মেরেই ভুলে থাকা হত। তবে এখন একটা মশা কামড়ালেই মনে ভয় জাগে। জ্বর আসলে মানুষ প্যারাসিটামল খেতেও দুদিন সময় নিত; কিন্তু আজ ছুটছে ডেঙ্গুর পরীক্ষা করাতে।

ডেঙ্গুর জীবাণু ছড়ানো মশার নাম ‘এইডিস ইজেপ্টাই’, তবে এই মশা কামড়ালেই যে ডেঙ্গু হবেই হবে এমন নয়।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পুরো ঘটনাচক্রটি জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য-কমপ্লেক্সের মেডিসিন বিভাগের পরামর্শদাতা ডা. কামরুল হাসান (বিসিএস স্বাস্থ্য)।

ডেঙ্গু জীবাণুর সংক্রমণ চক্র: মোট চার ধরনের ডেঙ্গুর জীবাণু রয়েছে, যাদেরকে বলা হয় ‘ডেঙ্গু স্টেরিওটাইপস’। এর যেকোনো একটিতে একবার আক্রান্ত হলে এই নির্দিষ্ট জীবাণু সারাজীবন সেই আক্রান্ত ব্যক্তিকে ওই নির্দষ্ট ধরনের ডেঙ্গুর ভাইরাস থেকে রক্ষা করে, তবে বাকিগুলো থেকে নয়।

তবে মানুষ থেকে আরেকজন মানুষের শরীরে এই জীবাণু ছড়াতে পারেনা, সেজন্য চাই ‘এইডিস ইজেপ্টাই’ মশা।

ডেঙ্গু ছড়ানোর প্রক্রিয়াটাও সহজ নয়। একটি ‘এইডিস ইজেপ্টাই’ মশার জীবনকাল ৭ থেকে ১৪ দিন। আর এই জাতের স্ত্রী মশাই শুধু রক্তপান করে। এমন একটি মশা ডেঙ্গুর জীবাণু আছে এমন একজন মানুষকে কামড়ানোর পর মশার শরীরে সেই জীবাণু প্রবেশ করে। এই মশার মাধ্যমে জীবাণু ছড়ানোর মতো পর্যায়ে পৌঁছাতেও কয়েকদিন সময় লাগে।

তারপর এই মশা কোনো সুস্থ ব্যক্তির রক্ত পান করলে মশার লালাগ্রন্থি থেকে জীবাণু মানুষের শরীরে আসবে। আসলেই ডেঙ্গু হয়ে যাবে না, সময় লাগবে তিন থেকে সাত দিন। এই সময়ের মধ্যে ওই ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ডেঙ্গুর জীবাণু ধ্বংস করতে না পারলে তবেই ওই ব্যক্তির ডেঙ্গু হবে।

ডেঙ্গুর উপসর্গ: ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে জ্বরের তাপমাত্রা গড়াতে পারে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত। এই রোগের কিছু সাধারণ উপসর্গ হল বিরামহীন মাথাব্যথা, হাঁড়, হাঁড়ের জোড় ও পেশিতে ব্যথা, বমিভাব ও বমি হওয়া, গ্রন্থি ফুলে যাওয়া, সারা শরীরের ফুসকুড়ি দেখা দেওয়া, চোখের পেছনে ব্যথা হওয়া ইত্যাদি।

ডেঙ্গুর তীব্র মাত্রাকে ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় ‘ডেঙ্গু হেমোরেজিক’ বা ‘ডেঙ্গু শক সিনড্রোম’।

‘ডেঙ্গু শক সিনড্রোম’য়ের উপসর্গ হল, শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা হওয়া কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যাওয়া, ত্বক শীতল হয়ে যাওয়া, অবিরাম অস্বস্তি, ত্বকের ভেতরের অংশে রক্তক্ষরণের কারণে ত্বকের উপরের অংশে লাল ছোপ সৃষ্টি হওয়া, বমি, মল কিংবা প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, প্রচণ্ড পেট ব্যথা ও অনবরত বমি হওয়া, নাক ও দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ এবং অবসাদ।

পরীক্ষা: বর্তমান প্রেক্ষাপটে জ্বর হলে প্রথম কাজ হবে ‘সিবিসি (কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট)’ পরীক্ষা করানো।

এখানে দেখা হয় ‘হিমোগ্লোবিন’, ‘টোটাল কাউন্ট’, ‘প্লাটিলেট’ এবং ‘হেমাটোকিট’ বা ‘প্যাকডসেল’ (পিসিভি)।

জ্বরের প্রাথমিক অবস্থায় রোগীর অবস্থা কেমন ছিল সেটা যাচাই করা হয় এই পরীক্ষা থেকে। এই পরীক্ষায় ‘প্লাটিলেট’য়ের সংখ্যা কমতে দেখা গেলে ডেঙ্গুর প্রাথমিক সন্দেহ শুরু হয়। সেক্ষেত্রে পরামর্শ দেওয়া হয় ডেঙ্গু ‘এনএসওয়ান অ্যান্টিজেন’ পরীক্ষা।

এই পরীক্ষায় ‘আইজিজি’ এবং ‘আইজিএম’ অ্যান্টিবডি পর্যবেক্ষণ করেন চিকিৎসকরা। যদি আইজিএম পজিটিভ এবং আইজিজি নেগেটিভ হয় তবে বুঝতে হবে রোগী সম্প্রতি প্রথমবার ডেঙ্গুর জীবাণুর আক্রমণের শিকার হয়েছেন, অর্থাৎ তার ডেঙ্গু হয়েছে।

দুটিই পজিটিভ হলে বুঝতে হবে আগে রোগী ডেঙ্গুর চার ধরনের জীবাণুর মধ্যে একটিতে আক্রান্ত হয়েছিল। এবার সে অন্য ধরনের জীবাণুর আক্রমণে আবার ডেঙ্গুর শিকার হয়েছেন।

এই পরিস্থিতে ধরা হয় এবার রোগীর রোগের তীব্রতা বেশি হবে। এই অ্যান্টিবডি তৈরি হতে সাধারণত পাঁচ থেকে সাত দিন সময় লাগে। তাই এই সময়ের পর পরীক্ষা করানো হলে সঠিক ফলাফল পাওয়া যাবে।

অন্যান্য সময়ের চাইতে এবারের ডেঙ্গুর আচরণ কিছুটা ভিন্ন। এর আগে ডেঙ্গুর তীব্রতা পরিমাপের একটি উপায় ‘লিকুইড প্লাজমা’র পরিমাণ। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে রক্তের এই উপাদান বের হয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে জমতে থাকে এবং এই ‘প্লাজমা’ বের হয়ে যাওয়ার কারণেই ‘প্লাটিলেট কাউন্ট’ কমে যায়।

তবে এবার সবচাইতে বড় আশঙ্কা হল ‘হাইপোভলিউমিক শক’ যেখানে ‘প্লাটিলেট কাউন্ট’ আশঙ্কাজনক মাত্রায় কমে যাওয়ার আগেই রোগীর রক্ত থেকে ‘প্লাজমা’ বেরিয়ে যাওয়া কারণে হৃদযন্ত্র শরীরে পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ করতে পারছে না, ফলে রোগীর আকস্মিক মৃত্যু হচ্ছে।

এজন্য এবার ‘সিবিসি’ পরীক্ষায় চিকিৎসকদের দেখার মুল বিষয় হচ্ছে ‘হেমাটোকিট’ বা ‘প্যাকডসেল’ (পিসিভি)। এই অবস্থায় রোগীকে ‘প্লাটিলেট’, ‘ফ্লুইড’ কিংবা সরাসরি রক্ত দেওয়া হতে পারে। আর এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ চিকিৎসকের বিবেচনার উপর নির্ভরশীল।

যেহেতু ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি তাই জ্বর হলেই সিবিসি পরীক্ষাটি করানো উচিত। ডেঙ্গু এনএসওয়ান পরীক্ষা করাতে পারলে ভালো তবে না করলেও সমস্যা নেই।

জ্বরের তৃতীয় দিনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে পারেন।

সাধারণত পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যেই ডেঙ্গু রোগীর জ্বর ভালো হয়ে যায়। কিন্তু তারপর শুরু হয় আরও জটিল সময়, যেখানে ‘প্লাটিলেট’ কমে যাওয়া, রক্তক্ষরণ ইত্যাদি দেখা দেয়, যা আরও পাঁচ থেকে সাত দিন থাকে।

এই সময়ে সুস্থভাবে উৎরে যেতে পারলেই রোগী নিরাপদ।

আরও পড়ুন