নৃ-গোষ্ঠী খাসিয়াদের বসবাস। দেবলছড়া খাসিয়াপুঞ্জি যাওয়ার আগেই পরিকল্পনা ছিল, বের হলাম ২৬ মার্চের ছুটিতে।
শ্যামলির বাসে চেপে রাত ১১টায় আমরা ঢাকা ছাড়লাম ২৫ মার্চ। সেই বাস রাত সাড়ে তিনটায় আমাদের শ্রীমঙ্গলের চৌমনায় নামিয়ে দিল। তারপর অটো রিকশা ভাড়া করে চলে গেলাম রাধানগরের হিমাচল রিসোর্ট।
রিসোর্টটি প্রিয়জন সাজু রহমানের। সাজুকে আগেই বলে রেখেছিলাম সুতরাং গভীর রাতে হিমাচলের ব্যবস্থাপক মিলুর স্বাগত জানানোতে আন্তরিকতার অভাব ছিল না।
সেদিন খাসিয়া পাড়ায় ঘেরাঘুরি করেই সারা। পরদিন পরিচিত ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা চালক সুকুমারকে ফোন দেই। তাকে দেবলছড়ার কথা বলি কিন্তু সে চেনেনা।
তবু বলে “স্যার আপনি চিন্তা করবেন না, আমি ঠিকঠাক চিনে নিবো ”
কি আর করা পরিচিত সুকুমারকে নিয়ে পরিচিত পথে নামি অচেনার উদ্দেশ্যে। তার আগে সকাল সাতটায় পানসিতে নাস্তা করে নেই।
শ্রীমঙ্গল আসার কারণ ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী দূর্গম এলাকা দেবলছড়া হলেও পানসির স্পেশাল চায়ের কথা বাদ দেওয়া যাবে না। শুধু পানসি রেস্তোঁরার চায়ের জন্য হলেও শ্রীমঙ্গল চলে যাই বারবার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শমসেরনগরে বিমান বন্দর গড়ে উঠেছিল। এখন বিমান চলাচল না করলেও বিমান বন্দরটি আছে। আরও আছে মুক্তিযুদ্ধকালিন বধ্যভূমির ওপর নির্মিত একটি স্মৃতিসৌধ। আমরা শমসেরনগরের অন্দর না দেখে এগিয়ে চললাম ডানকান চা বাগানের ভেতর দিয়ে দেবলছড়ার দিকে। তার আগে শমসের নগর বাজারের খাসিয়া দু’একজনের সঙ্গে কথা বলে দেবলছড়ার রোড নকশা ঠিক করে নিলাম।
মেঘবৃষ্টি কুয়াশাহীন বসন্তের সকাল। রাস্তার দুপাশে চাবাগানের ফাঁকে ফাঁকে চা-কর্মীদের কর্মতৎপরতা। শীত মৌসুমে চাপাতা তোলার কাজ বন্ধ থাকে। সে সময় গাছগুলো ছেটে দেওয়া হয়। এখন বসন্ত ঋতু চললেও চা-পাতা তোলার কাজ সেভাবে শুরু হয়নি। তবে চা-পাতা তুলছে কোথাও কোথাও।
ডানকান চা বাগানে চাপাতা তোলার সময় ছবি তুলি, দেখা ও কথা হয় চা শ্রমিক রাসামা ও লারাইলামার সঙ্গে। রাসামাকে চা-পাতার ভর্তা বানাতে দেখে খেতে ইচ্ছে করলেও তাদের কাছে পর্যাপ্ত না থাকায় চেয়ে খেয়ে নেওয়া হয় না।
এখানে লেকের পাশের পুরোটাই বালুকাময়। লেকের পানিই এখান বসবাসকারিদের একমাত্র পানির উৎস, আর রয়েছে পাতিকুয়া। ক্যামেলিয়া লেকটির উৎস সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে হলেও আমাদের বাহনচালক এ সম্পর্কে কিছুই ধারণা দিতে পারলেন না। আমাদের নিয়ে তার এই প্রথম এই পথে আস সুতরাং এবার একটু মজা করে সুকুমারকে বললাম- “ভাড়া কিন্তু আমাদেরকেই দিতে হবে দাদা!”
সোজা পিচঢালা হলেও বিশ মিনিটের মতো চলার পর লালমাটির পথ পেলাম৷ বৃষ্টিপাত ছাড়া দিন বলে সেপথে চলতে অসুবিধা নাহলেও খানাখন্দের সেপথে ভালোই ঝাঁকুনি অনুভব করছিলাম।
একটু এগিয়ে টিলার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সুনছড়া চাবাগান থেকে ক্যামেলিয়া লেকের সৌন্দর্য মুগ্ধতা জাগানিয়া। আমরা ক্যামেলিয়া লেকের শোভাদেখি, দেখি চাবাগানের শোভা। এখানে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে ও ছবি তুলে আবার চলা শুরু করি।
হাসপাতালের অভ্যন্তরে ছবি তোলা নিষেধ হলেও এত সুন্দর হাসপাতাল ও তার আশেপাশের সৌন্দর্য ক্যামেরা বন্দি করার লোভ সামলাতে না পেরে ফটাফট ছবি তুলে আবার যাত্রা পথে এগিয়ে চলি। একটু এগিয়ে দেখা ও কথা হয় চা শ্রমিক কালাম্মার সঙ্গে। এখানেই তিনি থাকেন শমসের নগর।
কালাম্মার সঙ্গে আরও তিনজন শ্রমিক যোগ দেন। তাদের মানবেতর জীবন, তাদের রোজ ১০২ টাকার বেতন ও থাকা-খাওয়া নিয়ে কথা হয়। তারপর কালাম্মাদের বিদায় জানিয়ে আরেকটু এগিয়ে পেয়ে যাই সুনছড়া চাবাগান এর বিশ্রামঘরে। এটা আসলে বিশ্রামঘর না, এখানে শ্রমিকরা চায়ের পাতা সংগ্রহ করে নিয়ে এসে জমা করেন, পরে ওজন করে জমা দেন বাগানের প্রতিণিধির কাছে।
যেহেতু চা তোলা এখনও শুরু হয়নি সেভাবে সুতরাং দেখা গেল কয়েকজন এখানে অলস সময় কাটাচ্ছেন। একজনকে দেখলাম চা-পাতা দিয়ে ভর্তা বানাচ্ছেন। এই ভর্তা চা বাগানের স্পেশাল খাবার। টমেটো, চানাচুর, চা পাতার সঙ্গে তেঁতুলের সংমিশ্রণ মিলে এই ভর্তা। জান্নাতের এই ভর্তা খাওয়ার ইচ্ছেপূরণ হয়ে গেলে আমরা আবার দেবলছড়ার দিকে চলি।
ছবি তোলা নিষেধ হলেও তারা আমাদের বাঁধা দিলেন না। বরং একজন কথা প্রসঙ্গে বললেন, কী এক ভালো লাগার কারণে আপনাদের ছবি তোলায় নিষেধ করিনি।
আমাদের সময় কম সুতরাং এবার বিদায় নেওয়ার পালা। সীমান্তচৌকিতে বিদায় জানিয়ে দেবলছড়া খাসিয়াপুঞ্জির দিকে এগিয়ে যাই। সামনে আর মাত্র ১০ মিনিটের পথ, তারপরই দেবলছড়া খাসিয়াপুঞ্জি।
আকাশ আজ ঝকঝকে পরিষ্কার কয়েকবারই বলেছি। ঝকঝকে আকাশের সঙ্গে এখানকার মেঠোপথও চমৎকার। চলতি পথে এক চা শ্রমিককে কুয়া থেকে অনেক কসরত করে পানি তুলতে দেখি। পাশেই একটা মন্দির। এখানে পূজা হয় সব সময় বোঝা যায়। সীমান্ত চৌকি থেকে দেবলছড়ার রাস্তায় চড়াই আছে কিছুটা। সে চড়াই পেরিয়ে এক সময় দেবলছড়া পৌঁছি।
দেবলছড়া খাসিয়াপুঞ্জিতে প্রবেশ করার সময় একটা খাল পেরোতে হয়, যার নাম দেবলছড়া খাল।
সরু বাঁশের সাকো দেখে বোঝা গেল খাল বা ঝিরির পানি কমে-বাড়ে। ঝিরির ওপর দাঁড়ানো সাঁকোতে দাঁড়িয়ে জান্নাতের ছবি তোলার সাধ জাগলেও পরে ভয়ে সে রাজি না হওয়ায় সে আশা বাদ দিয়ে পুঞ্জির ভেতর প্রবেশ করি। দেবলছড়া পৌঁছে গেছি।
দশ মিনিটে টিলার ওপর চলে আসি। তারপরই দুচোখে বিস্ময় নিয়ে শুধু দেখে চলি। এমন সাজানো গোছানো পুঞ্জি না দেখলে বিশ্বাস হবে না। টিলার ওপর ইটের দোতলা দালান। একতালা ইটের বাড়ি আছে অনেক। টিনের চৌচালা চোখ ধাঁধানো বাড়ির দেখাও পেলাম। প্রত্যেকবাড়ির প্রবেশ মুখে ডিস অ্যান্টেনা লাগানো। এসব সীমান্ত ওপার ভারতের ত্রীপুরা থেকে আসা স্কাই টেলিভিশনের। পুরো পুঞ্জি ঘুরে দেখি। টিলার ওপাশে ত্রীপুরা মুখি রাস্তা করা। টিলার ওপর ওপার থেকে বাইক ও গাড়ি চলাচল, এটাও অবিশ্বাস্য, না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না।
এখানে স্কুলও রয়েছে, দেবলছড়া জুনিয়র স্কুল। পুরো পুঞ্জি ঘুরে আমরা আবার শুরুর সেই জায়গায় আসি যেখান দিয়ে আমরা পুঞ্জিতে উঠে এসেছি। পাশেই মন্ত্রির বাড়ি। একটা সাবেক মন্ত্রি অন্যটা নতুন মন্ত্রি। পুঞ্জি প্রধান হেডম্যানকে এখানে মন্ত্রি বলা হয়। বর্তমান মন্ত্রির নাম বিটিসন প্রধান। এর আগের মন্ত্রি টিলসন প্রধান মারা গেছেন ১৯৯৪ সালে।
এরপর আমরা বর্তমান হেডম্যান বা মন্ত্রি বিটিশনকে পেয়ে তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি।
দেবলছড়াপুঞ্জিতে ৮০টা পরিবারের পনেরোশ থেকে ষোলশ লোকের বসবাস জানালেন তিনি। এখানে জীবিকা নির্বাহের একমাত্র মাধ্যম পান। ওপারের ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ে প্রশ্ন করলে বিটিশন প্রধান আর কথা বলেন নি।
এবার আমরা দেবলছড়া খাসিয়াপুঞ্জি থেকে নেমে বামের জঙ্গলা পথে চলি। এখানে পানের জুম ঘুরে দেখি। পানের জুম থেকে পান এসে জমা হচ্ছে, চমৎকার সে দৃশ্য। পাশেই চমৎকার বাঁশবন আর প্রজাপতির লুটোপুটি। অজস্র দাঁতরাঙা ফুল দেখে জান্নাত তো অবাক। সে আরও অবাক বিশাল গাছের পালান ফুল দেখে এবং সে ফুলের সৌরভ নাকে নিয়ে।
প্রয়োজনীয় তথ্য
মৌলভিবাজার জেলার শমসের নগরে ত্রিপুরা সীমান্তে দেবলছড়ার অবস্থান। এখানে যেতে হলে ঢাকা বা দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে শ্রীমঙ্গল বা শমসের নগর যেতে হবে। ট্রেনে বা বাসে শ্রীমঙ্গল বা শমসের নগর চলে যান। তারপর শমসেরনগর বাজার থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বা সিএনজি চালিত অটোরিকশা নিয়ে চলে যান সোজা দেবলছড়া।
আমি শমসের নগর থেকে না, শ্রীমঙ্গল থেকে শমসের নগর হয়ে ডানকান চা-বাগান, সুনছড়া চাবাগান, ক্যামেলিয়া লেক ও ক্যামেলিয়া হাসপাতাল পেছনে ফেলে দেবলছড়া খাসিয়াপুঞ্জি গিয়েছিলাম।
পুঞ্জি থেকে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। দলবেঁধে এখানে যাওয়া বা বনভোজন করা যাবে না। বিজিবি সীসান্ত চৌকিতেও বাঁধার সামনে পড়তে হবে। চারজন একসঙ্গে বিজিবি ডবলছড়া যাওয়ার অনুমতি দেয় না। সুতরাং দেবলছড়া পুঞ্জি উপভোগ করতে হলে পুঞ্জির কাউকে সঙ্গে নেবেন এবং বিজিবি সীমান্ত চৌকি থেকে যথাযথ অনুমতি নিয়ে নেবেন।
এখানে দেখার আছে খাসিয়াপুঞ্জি, পানের জুম, পাহাড় ও চাবাগান। এই পথে ক্যামেলিয়া লেক ও হাসপাতাল দেখার স্মৃতি আপনাকে অনেকদিন তাড়িয়ে বেড়াবে।
শমসের নগর থেকে দেবলছড়া সহজ ও একটানা চলার সোজা পথ। পিচ ও পাহাড়কাটা রাস্তা এখানে সামান্য খানাখন্দের। পথ শমসের নগর থেকে ডানকান চা-বাগানের ভেতর দিয়ে সোজা চলে গেছে দেবলছড়ার দিকে। রোমাঞ্চকর অভিযানে বেরিয়ে পড়া অভিযাত্রিদের ট্রেকিং করার জন্য দারুণ উপযোগী। চা বাগানের ভেতর দিয়ে দেবলছড়া ভ্রমণ এক কথায় অসাধারণ!