যেখানে মিলেছে আর্ভ-রোন জলধারা

জেনিভা’র দুই নদীর দুই রং। অথচ বয়ে চলেছে পাশাপাশি।

আইরিন সুলতানাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 March 2019, 08:47 AM
Updated : 29 March 2019, 08:55 AM

আর সেই জলাধারা সঙ্গে মিশে মনের আবেগ প্রকাশ করেছেন লেখক এখানে।

আইজিএফ সম্মেলন (ইন্টারনেট গভর্নেন্স ফোরাম ২০১৭) শেষ হয়েছে। জেনিভার জাতিসংঘ দপ্তরে আর পা মাড়িয়ে কাজ নেই। সতীর্থদের অনেকে বিদায় নিয়ে ফ্লাইট ধরেছে। বাক্সপেটরা গুছিয়ে ফেলেছি শেষ কয়েকজনও।

গির্জার দুপুরের ঘণ্টা ঢং ঢং করে জানান দিচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই এ শহরটা ছাড়তে হবে। তবে জংশন না দেখে যাই কী করে?

ভুটান সতীর্থরা লাগেজ হাতে জুরিখ মুখে রওনা করতে করতে হুঁশিয়ার করলো, যদি ফিরতে দেরি হয়ে যায়; যেও না বরং!

জেনিভা শহরের এদিকটা অ্যাপ আর ম্যাপ দিয়ে বেশ একটা চিনে গেছি কদিনেই। আর আসা হবে কি? এ যাত্রায় আর্ভ-রোনের মোহনা দেখেই ফিরবো দেশে; চেকআউট করে লাগেজটা রিসিপশনের জিম্মায় রেখে বেরিয়ে পড়লাম।  

করনাভিন থেকে ১৪ নম্বর ট্রামে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ জংশন স্টেশন।

ট্রাম ঠিক থাকলেও উল্টা পথেরটায় চড়ে কয়েক স্টেশন পেরিয়ে ভুল ভাঙলো। নেমে ফিরতি ট্রামের অপেক্ষায় ঠাণ্ডা বাতাসে দাঁড়িয়ে টের পেলাম, ভয় পাচ্ছি। যদি ট্রাম আসতে দেরি হয়? যদি আর্ভ-রোন দেখা না দেখার উত্তেজনায় এই মুহূর্তের অ্যাড্রিনালিন রাশের চেয়েও দৌঁড়ে চলে ঘড়ির কাঁটা?

যদি এয়ারপোর্টের ট্রেনটা মিস করি? তারপর যদি ফ্লাইটটাও মিস করি?

ট্রাম আসতেই চেপে বসলাম। যেন ভয় তাড়ানোর অবলম্বন এখন ট্রামটা। এটা ঠিক ট্রামই ছিল। জংশনে নামলাম। কিন্তু কোন দিকে গেলে দেখা মিলবে দুই নদীর সন্ধিস্থল?

হাইওয়ের পাশ দিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটা দিয়ে একটা ব্রিজের উপর এসে নিচে বয়ে যাওয়া নদী দেখি। কোনটা রোন? কোনটা আর্ভ?

নদীটা যেদিকে যাচ্ছে সেটার পিছু নেব ভেবে দাঁড়ানো জায়গা থেকে নেমে একটা আবাসিক এলাকার পেছন দিকে দাঁড়ালাম। কতক হেঁটে একেবারে সুনসান এই সীমানায় আর এগুনো ঠিক হবে কি না সে দ্বন্দ্বে পড়ে পা সায় দিল না চলায়।

বিভুঁইয়ে এসে ঝুটঝামেলাহীন থাকাই ভালো। ওখান থেকে সরে প্রধান সড়কের আরেক দিকে এসে ছোট আরেকটা ব্রিজের উপর দাঁড়ালাম। নিচে শান্ত জলধারার এটা কি লেক? না নদী?

গভীরতা কম। কোথাও সবুজাভ, কোথাও নীলচে। স্ফটিক জলের কি কোনো রং হয়? টলটলে জলস্তর ভেদ করে দেখে ফেললাম পাথুরে তলদেশে শুয়ে থাকা আস্ত একটা সাইকেল।

হাতের ম্যাপে গন্তব্যে আঙ্গুল বসিয়ে এক পথচারীকে আটকে জানতে চাইলাম, যেখানে মিলেছে আর্ভ আর রোন, সেটা কোথায় দেখতে পাবো?

এ শহরে যারা হাঁটছে-ঘুরছে সবাই স্থানীয় নয়। এই যুবক স্থানীয়ই বোধ হল। জানালো, ঠিক রোন নদীর ‍উপরেই দাঁড়িয়ে আছি। আর এই নদীর বাঁধানো পাড় দিয়ে যে পথটা চলে গেছে ওটা ধরে এগুলে মোটে দশ-পনের মিনিটে পৌঁছে যাব জংশনে।

আমার ডানে রোন। বাঁয়ে একটা আবাসিক এলাকা। রোনের এপাশে-ওপাশে ডিসেম্বরের ঠাণ্ডায় পত্রপল্লবহীন গাছ মসের আস্তর গায়ে বিমূর্ত চিত্রের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রকৃতির ক্যানভাসে। শূন্যের আশপাশে ঠাণ্ডাতেও এখানে প্রকৃতি বিবর্ণ নয়। স্রোতহীন নদীতে ভাসছে-উড়ছে নানা রংয়ের হাঁস।

যখন তখন গলা ডুবিয়ে দিচ্ছে নদীতে। মানুষে এদের ভয়ডর নেই। যেন এটা ওদের জলজপুর।

পথের পাশের বাড়িগুলোর সীমানা প্রাচীরে গ্রাফিতি দেখতে দেখতে এগুচ্ছি। নদীর অন্যপাশেও চোখে পড়ছে দেয়াল গ্রাফিতি। এর মধ্যেই ঘড়িতে চোখ গেলে ভয়টা নড়েচড়ে উঠলো। দেরি করছি না তো? এই পথ জংশনেই নেবে তো আমাকে?

পেছন ফিরে হাঁটা দেওয়া ছাড়া ডানে-বামে রাস্তা নেই। সোজাই যেতে হবে। আমার আগে আগে এক তরুণও চলেছে। 

সংশয় মিলিয়ে গেল পথের প্রায় শেষ মাথায় পৌঁছে। এতক্ষণ খুব বেশি মানুষ নজরে না এলেও এখানে কিছু উৎসাহিদের জটলা। আগে থাকা তরুণটি স্থানীয় নয়; পর্যটক। জংশন দেখতে এসেছে। সামনে আঙ্গুল তুলে ওই দেখালো আর্ভের বেরিয়ে আসা। বিনিময়ে ওর মোবাইলে ওরই কটা ছবি তুলে দিলাম।

এখান থেকে একটু দূরে উঁচু একটা ব্রিজ। উপর থেকে দুটো নদী দেখতে ওখানে দাঁড়ায় লোকে। দুটো জলধারা কেমন করে নিজ নিজ রংয়ের স্বকীয়তা ধরে রেখে পাশাপাশি গড়িয়ে চলেছে তা দেখতেই মানুষের ছুটে আসা।

নিচে নদীটা অনেকটা চওড়া। কারণ এখানে আর্ভ এসেছে, এখানে রোনও বইছে। তারপর দুটো স্রোত মিলে এগিয়ে গেছে আল্পস আশীর্বাদপুষ্ট রোন।

আর্ভ নদীর পানি এমনিতে ঘোলা হলেও এই্ অংশে রোনের সংস্পর্শে আর্ভের জলরং আমাকে সিলেটের সারি নদীকে মনে করিয়ে দেয়।

আর্ভকে মনে মনে বললাম, “তোমার কথা পৌঁছে দেব সারি নদীর কানে।”

বুক ভরে নদীর ঠাণ্ডা বাতাস টেনে নিতে নিতে দারুণ নির্ভার মনে হলো নিজেকে। এবার তাহলে ফেরা যায়।

ছবি: লেখক।