কাঠমান্ডুর মাথামুণ্ডু

পোখারা কিংবা নাগরকোট নয়- নেপালের রাজধানীর আনাচে-কানাচে হেঁটে ঘুরে ফিরে দেখার আছে অনেক কিছু।

রুম্পা সৈয়দা ফারজানা জামানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 March 2019, 07:44 AM
Updated : 8 March 2019, 07:49 AM

আর এখানে সেই অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুলেছেন লেখক।

‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া!’

কবির এই কথাটা মনে হয় ঘরের কাছে বা হাতের নাগালে থাকা যে কোনো জায়গার জন্য প্রযোজ্য। যেমন ইন্দোনেশিয়ার বালিতে সবাই যায়। তবে রাজধানীর নামটাই এখন ভুলতে বাকি। অথচ জাকার্তাতেও আছে দেখার মতো অনেককিছু!

তেমনই নেপাল। সেখানে যেয়ে মনে হয় গাড়ি নিয়ে নাগরকোট বা এক নিমিষে চলে যাই পোখারা। কাঠমান্ডুর মাথামুণ্ডু কিছুই দেখা হয় না। তাতেই বা ক্ষতি কী! কি বা আছে থামেল ছাড়া!

সেটা একটা প্রশ্ন বটে। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই সব ছেড়েছুড়ে কাঠমান্ডুই হল আমার গন্তব্য। বলে রাখা ভালো- নেপালে এটা আমার দ্বিতীয় ভ্রমণ। প্রথমবার ছিলাম দেড়দিনের জন্য। এবার পাঁচদিন।

একটু কম খরচে ঘুরে বেড়ানোর পায়তাড়া করি সবসময়। তাই এবারও এক সাবেক সহকর্মীর সঙ্গে মিলিয়ে তারিখ ঠিক করলাম। হোটেল রুমটা অন্তত ভাগাভাগি করা যাবে।

তবে আমি পৌঁছে গেলাম একদিন আগে। থাকার জন্য জায়গা চাই। ললিতপুরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বড়ভাই সেজানের থাকার বদৌলতে পেয়ে গেলাম একদিনের জন্য গ্রেস হোটেল। ফিটফাট ‘হোমস্টে টাইপ’ রুম। বিছানা, বাথরুম চমৎকার। দেড় হাজার নেপালি রুপিতে সকালের নাস্তাও আছে! মন্দ নয় থাকার ব্যবস্থা!

এরপর আসি আবহাওয়ায়! ভেবেছিলাম ছিলাম ঠাণ্ডা থাকবে দিনেও। তবে বিমানবন্দরে যখন নামলাম, বেশ গরম লাগলো!

এই যে নেপাল সারাজীবন আমাকে ধোকা দিল! দেশে গরম পড়েনি বলে যত স্টাইলিশ গরম কাপড় নিয়ে গেলাম। অথচ সেখানেও একই হাল।

পরে শুনলাম রাতে ঠাণ্ডা পড়ে। তাও বেশি না। গেল বছরের ফেব্রুয়ারিতে নাকি ‘জিরো’তে নেমেছিল।  ‘ক্লাইমেট চেইঞ্জ’ কত প্রকার ও কী কী তা বোঝা যাচ্ছে প্রতিটা দেশেই।

সেদিন সারাবেলা এদিক সেদিক ঘুরলাম। ললিতপুর আসলে কাঠমান্ডুর অভিজাত এলাকার মাঝে পড়ে। এখানে চাকুরিজীবীরাই বেশি থাকেন। আছে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল, মেটলাইফ, জাতিসংঘ-ইত্যাদির দপ্তর।

মজার ব্যাপার হল, সবই আছে- কিন্তু কাঠমান্ডুতে কি দেখবো সেটা বোঝার উপায় নেই। যেমন, থাইল্যান্ডে গেলে কোথায় কি আছে- ডে-ট্রিপ- টুরিস্ট প্লেস ইত্যাদির ব্রোশিয়ার আছে। অথচ এখানে টুরিস্ট তথ্য মানে- “টিকেট কাটো- পোখারা যাও!”

ললিতপুর হাঁটা শেষে সন্ধায় ফিরে চা খাওয়ার অবসর। এদেশে নেপালি এবং ভারতীয় রূপি সমানতালে চলে। এটা জানতাম। তবে ভুলে ভারতের টাকা নেওয়া হয়নি। ফলে নেপালি রুপিতেই চললাম।

এপাশ ওপাশ থেকে ঘুরে একটা টুরিস্ট গাইড– অফিসও পেয়ে গেলাম। যার কাছ থেকে শহরের এটা সেটা জানা গেল। এসব জানতে জানতেই সন্ধ্যা। আর সব সুনসান। স্থাণীয় লোকজন কোনো মতে হয়ত নয়টা অবধি জেগে থাকেন। তারপরেই – নিশ্চুপ ধরণী।

তবে জেগে থাকে থামেল। সেখানে রাত পর্যন্ত গান-টান শুনে আসা।

থামেলের এই রাস্তাটা চমৎকার। থামেল বাজার। রাস্তা সাজানো। পাশেই মার্কেট। খোলা থাকে টেনেটুনে দশটা পর্যন্ত। তবে পার্পেল হেইজের মতো পাবগুলো বেশ রাত পর্যন্ত অর্ডার নেয়। সেখানেও হাঁটা মজার। বেশিরভাগ টুরিস্ট সেখানেই থাকে।

পরদিন ওই আপা আসায় চলে গেলাম হোটেল হিমালায়া। বলে রাখা ভালো- ললিতপুরে আরও দুটি জায়গা আছে ধারে কাছে ঘুরে বেড়ানোর মতন। দুটি শপিং মল; লাবিম এবং সিভিল মল। সেখানে সিনেমা চলে। শেষ শো ৭.৩০ বা ৭.৪৫।

এই গেল দুই দিন। এবার শুরু তৃতীয় দিন।

গুগল দেখে ভাবলাম শহর ঘুরে বেড়াই। পাটান দরবার স্কয়ার, কাঠমান্ডুর দরবার স্কয়ার ইত্যাদি। শুরু করলাম কাঠমান্ডু ভ্যালি দিয়ে। গুগলকে জিজ্ঞেস করে রওনা দিলাম।

বিধিবাম। কী বিপদ! ট্যাক্সিওয়ালা নিজেই জানে না ওটা কোথায়! আমি শুধু বললাম, আমি পর্যটক আমি জানবো?

তবুও রওনা দিলাম। ১৩৫টা স্থাপনা আছে। আর ভ্যালি মানেও সুন্দর হওয়ার কথা। কিন্তু কোথায় সে অরণ্য! নগরায়ন সেই ভ্যালির মধ্যে আবাসিক এলাকা গড়ে দিয়েছে। চোখে ভেসে উঠল লালবাগের কেল্লার ছবি। একই ভাবে সুন্দর স্থাপনাকে ঢেকে দিচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ন।

ভাঙা হৃদয়ে ফেরা সেখান থেকে। তবে মন ভালো করে দিল পাটান দরবার স্কয়ার।

আসলে লাবিম মল থেকে পায়ে হাঁটা পথে পুরো রাস্তাটাই অসাধারণ। প্রাচীন শহর। প্রাচীন স্থাপনা। একেকটা দরজার যে কাজ! যে সুক্ষ্ম কারুশৈলী তা দেখলাম হা করে।

রাস্তা থেকেই বাড়ি শুরু। বাড়ির নিচেই দোকান। “কিনলে কিনবে না কিনলে নাই” ভাব। তবে জিনিসগুলো সস্তাই। রাস্তার এপাশে ওপাশে নানা রকমের কারুকাজ করা বাড়ি। নতুন পুরানো- ভূমিকম্পে ভাঙা আবার একটু মেরামত করা! জগাখিচুড়ি অবস্থা। বোঝা যাচ্ছে যত্নের বড্ড অভাব; আর ধুলা!

তারপরেও প্রধান স্থাপনায় গেলে মন ভালো হয়ে যায়। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোর মেরামত চলছে বেশ ধীরে। প্রচূর পর্যটক। আর কিছু সুযোগসন্ধানী স্থানীয়। তাদের হাত থেকে বাঁচতে হবে এবং কেউ গেলে খেয়াল রাখবেন বিষয়টা।

ভক্তপুরও চমৎকার জায়গা ঘুরে বেড়ানোর জন্য। নাগরকোট যাওয়ার সময়ে পথে এটা পড়ে। তাই ট্যাক্সি নিয়ে এখানে হয়ে নাগরকোট যাওয়াই ভালো।

খুবই সুন্দর বৌদ্ধমন্দির এবং প্রাচীন স্থাপনার সমন্বয়ে এই জায়গা। ঘুরে বেড়াতে লাগবে এক ঘণ্টার মতো। তবে সারাদিনের জন্য মনটাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে।

এখানে ঢুকতে লাগে ৫শ’ নেপালি রুপি। ভালো কথা- ললিতপুর থেকে নাগরকোট যাওয়া আসা ৪ থেকে ৫ হাজার রুপি। দরদাম করতে হয়। না হলে পকেট থেকে ৮ হাজার রুপিও খসে যেতে পারে।

এবার নাগরকোট। এটি ঈশ্বরের একটি অদ্ভুত    নিদর্শন। জায়গাটা যত না সুন্দর তারচেয়ে বেশি সুন্দর যাওয়ার পথ। এমনিতেও আমার পথচলাতেই আনন্দ। কেনো যেন চলমান পথই ভালো লাগে।

জায়গায় জায়গায় গাড়ি থামিয়ে ছবি তুললাম। আমার সঙ্গী হরিতাই। নেপালি চালক। একটু বাঁক ফিরতেই চোখের সামনে বরফের পাহাড়। কি সুন্দর! মেঘের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া শুভ্রতা তার; আকাশ ছুঁয়ে বলে- তুমি নাগালেই আছো। আমি কতক্ষণ অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখি। এজন্যই তো ছুটে আসা!

নাগরকোটে পৌঁছে সেই এক পাহাড়ি আমেজ পাওয়া গেল। মঙ্গল বারতা লেখা ফেস্টুন। সাজানো পথ। আর মোমো। নাগরকোট টাওয়ারে উঠলাম। ঠাণ্ডা কিন্তু রোদ। রাতে নাকি আরও শীত জেঁকে বসে। তবে আগেই চলে এলাম হোটেল।

নাগরকোটে যাওয়া আসার পথে সবচেয়ে ভালো লাগে প্রকৃতির গ্যালারি। ধাপে ধাপে পাহাড়ি খাঁজ। মনে হয় কেউ হাত দিয়ে সিঁথি কেটে দিয়েছে। সেখানে কখনও ফুটেছে ফুল, কখনও স্থানীয়রা করছে চাষবাস। যেমন সুন্দর যাওয়ার পথ তেমনি সুন্দর আসার।

ফিরে এসে সেই থামেল।

এরপরদিন বিভিন্ন মন্দির ঘুরে বেড়ানো। ছবি তোলার জন্য সেরা জায়গা। আরও সেরা হল আছে পাঠাও সার্ভিস। তাই আমার মতো স্বল্প খরচে ঘুরে-বেড়ানি মানুষের জন্য এটা বিশাল শান্তির ব্যাপার!

পশুপতিনাথ মন্দির, শিম্ভুস্তুপা, বুদ্ধানাথ মন্দির দেখে এবার কাঠমান্ডু দরবার স্কয়ার।

গুগলে আলাদা আলাদা করে কুমারি হাউজ, হনুমান মন্দির-সহ বিভিন্ন জায়গা থাকলেও খেয়াল করে পড়ে নিতে হবে। এগুলো একই জায়গায়। একটু হেঁটে নিতে হবে।

কাঠমান্ডু দরবার স্কয়ার বিশাল এলাকাজুড়ে অবস্থিত আর এখানেও ভুমিকম্পের ধ্বংসাবশেষ আছে। মেরামত চলছে। আছে গয়না-সহ নেপালি নিদর্শনের বড় বাজার। তবে দাম বেশি। সেক্ষেত্রে কিছু কিনতে চাইলে থামেলই সেরা।

শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, শহরটাকে খারাপ লাগেনি আমার। সবসময় পাহাড়ে বা সাগরে হারাতে হবে এমন-তো কথা নেই। পূর্ণিমা রাতে শহরের রাস্তায় একা হাঁটাও কিন্তু অনেক আনন্দের। কোনো একটা অচেনা চায়ের দোকানে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ইটালির লরেঞ্জোর সঙ্গে শহর নিয়ে আলোচনাও মন্দ নয়। শহরের বাড়িতে বাড়িতে যা আছে দেখার সেটাও বা কয় জায়গায় দেখা যায়। এত যত্নেই তো বাড়িগুলো ‘বাসা’ হয়!

তবে কাঠমান্ডু আসলে অবশ্যই ভালো করে পড়ে জেনে আসা ভালো। স্থানীয় লোক হয়ত সব জায়গা সব নামে চেনে না, এটা মাথায় রাখা জরুরি। আর হাঁটতে পারলে ভালো। জুতা আরামদায়ক হলে কথাই নেই। সবই আশপাশে। যদিও ধুলাটা মিরপুরের বর্তমান অবস্থাকে জোর প্রতিযোগিতা দেবে। তবুও ঠাণ্ডার কারণে সয়ে যায়।

সবমিলিয়ে কাঠমান্ডুর ললিতপুর বেশ। আরাম করে আয়েশ করার জন্য খারাপ নয়। আরেকবার না হয় পোখারা আর লাস্ট রিসোর্ট ঘুরে আসা যাবে। আপাতত শহরে চলুক নতুন গানের আয়োজন।