পাহাড়িদের হাতে তৈরি পাহাড়ি খাবার

রাজধানীতেই পাহাড়ি খাবারের স্বাদ নিতে চাইলে চলে যেতে পারেন মিরপুর কাজীপাড়ায়।

মামুনুরু রশীদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Feb 2019, 02:12 PM
Updated : 4 Feb 2019, 02:21 PM

কারণ এখানকার ‘সিএইচটি এক্সপ্রেস’ ও ‘হেবাং’ রেস্তোরাঁ দুটি পরিচালনা করছেন পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীরা। রসুইঘরের পাচকও সেখানকার।

তাই বাঁশ মুরগি, লাকসু সালাদ কিংবা মুংদি’র খাঁটি স্বাদ পাওয়া যাবে সেখানে।

সিএইচটি এক্সপ্রেস

‘চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্স এক্সপ্রেস’য়ের সংক্ষিপ্ত রূপ এইচটি এক্সপ্রেস। মিরপুরের কাজীপাড়া ফুটওভার ব্রিজের নিচে, স্বপ্ন’র পাশ দিয়ে যাওয়া গলিতে ঢুকে কয়েক কদম এগোলেই হাতের বামে পড়বে এই রেস্তোরাঁ।

ছোট পরিসরের সাজানো। বসার জায়গা আছে সবমিলিয়ে ৫০ জনের। দুপুর ১২টা থেকে চালু হয়, খাবার পরিবেশন চলে রাত ১০টা পর্যন্ত। ওয়াইফাই সুবিধাও আছে।
রেস্তোরাঁর কর্ণধার দুজন। এদের মধ্যে একজন খাগড়াছড়ির অর্পন চাকমা। তিনি বলেন, “২০১৭ সালের জুন মাসে শুধু অর্ডারের ভিত্তিতে হোম ডেলিভারির মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে সিএইচটি এক্সপ্রেস। পরে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাস থেকে রেস্তোরাঁয় রূপ নেয়।”
প্যান এশিয়াটিক খাবারের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের খাবারের ফিউশন দিয়ে সাজানো হয়েছে এই রেস্তোরাঁর মেন্যু। তবে একেবারে দেশীয় পার্বত্য অঞ্চলের খাবারও রয়েছে বেশ কয়েক পদের।
পার্বত্য অঞ্চল সম্পর্কে ধারণা না থাকলে রেস্তোরাঁর অন্দরসজ্জার মর্ম বোঝা একটু কঠিন। রেস্তোরাঁর একপাশে আছে কাঠের চেয়ার টেবিল। অপরপাশে মাটিতে মাদুর বিছানো আর সামনে নিচু টেবিল।

দেয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো কাপড়ের টুকরোগুলোকে প্রথম দর্শণে নকশিকাঁথা মনে হতে পারে। তবে আসলে তা চাকমা, মারমা, ম্রো, চাক এবং খেয়াং সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী পোশাক।

দেয়ালে আঁকা আছে এই পাঁচ সম্প্রদায়ের ভাষার বর্ণমালার কয়েকটি অক্ষর। রেস্তোরাঁর প্রতিটি কর্মচারী বিভিন্ন আদিবাসি গোষ্ঠীর।

খাবারের আলাপে আসা যাক। রেস্তোরাঁর মেন্যুর প্রথম তিন পাতা পুরোপুরি বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের খাবার। যেখানে মুরগির মাংস, গরুর মাংস, কাঁকড়া, মাছ ও হাঁসের মাংসের বিভিন্ন পদ।

অর্পন চাকমা বলেন, “এদের মধ্যে জনপ্রিয় খাবার হল ‘ব্যাম্বু চিকেন’ (প্রতি প্লেট ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা, পুরো বাঁশ ৭শ’ থেকে ১ হাজার টাকা)।”

আরও আছে মারমা সম্প্রদায়ের ব্রয়লার মুরগির মাংসে তৈরি ‘লাকসু সালাদ’, ১৫০ টাকা। কাঁকড়ার দুই পদ, প্রতি পদ ১৫০ টাকা। ছুরি মাছ কিংবা চিংড়ি মাছের তিন পদের ‘ড্রাই ফিশ’, প্রতি পদ ১৮০ টাকা।

সুপের মধ্যে জনপ্রিয় হল মারমাদের নুডুলস সুপ ‘মুংদি’, ৫০ থেকে ১শ’ টাকা। আর তিব্বতীয় অঞ্চলের নুডুলস সুপ ‘থুকপা’, ১২০ থেকে ১৫০ টাকা।

স্ন্যাকসের মধ্যে আছে- মাছ, গরু কিংবা মুরগির মাংসের তিন ধরনের মোমো ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। এশীয় উপমহাদেশের বিশেষ বার্গার ‘বাও’ ২০০ থেকে ২৩০ টাকা।

আর পাহাড়ি ধাঁচে তৈরি ভিন্ন স্বাদের চিকেন ফ্রাই, ১৮০ টাকা।

অর্পন চাকমা বলেন, “মুরগির মাংসে পদগুলোতে ব্রয়লার আর পাহাড়ি এই দুই ধরনের মুরগি ব্যবহার করা হয়।”

তার কথায়, “পাহাড়ি রান্নাগুলোতে মসলার ব্যবহার হয় কম, ভেষজ লতাগুল্মই থাকে বেশি। যেমন- ধান সাবারাং (লেমন গ্রাস), সাবারাং (ওয়াইল্ড বেসিল), ভাত পাটা (পানড্যান লিভস), বাগোর (ধনে পাতা), মাচ্ছো বাগোর ইত্যাদি।”

“বাঙালি ভর্তা আর পাহাড়ি ভর্তার মধ্যে তফাৎ আছে। বাঙালিরা ভর্তা বানায় একবারে পিষে। তবে পাহাড়িদের ভর্তার বেশিরভাগই হয় উপকরণগুলো কুঁচি করে কেটে।”

বাঁশের মধ্যে রান্নার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় ‘পার্বো’ নামক এক ধরনের বাঁশ।

“বাঁশ যত বয়স্ক হবে ততই ভালো। কারণ কচি বাঁশ দ্রুত পুড়ে যায়। বাঁশের মধ্যে মাংস রান্না করতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগে।” বললেন অর্পন চাকমা।

হেবাং

মিরপুর কাজীপাড়ার স্বপ্ন আউটলেটের পাশের ভবনের দোতলায় এই রেস্তোরাঁ। ২০১৬ সালে হোম ডেলিভারি দিয়ে যাত্রা শুরু করে হেবাং।

চার বোনের প্রচেষ্টা আর ক্রেতা ও বন্ধু-বান্ধবের অনুপ্রেরণায় ২০১৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর রূপ নেয় রেস্তোরাঁয়।

রেস্তোরাঁর অন্যতম কর্ণধার সুচিন্তা চাকমা বলেন, “শুধু চাকমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী খাবার পরিবেশন করি আমরা। পুরো রেস্তোরাঁর সকল কর্মচারী আমাদেরই আত্মীয়-স্বজন।”
৩০ থেকে ৩৫ জনের বসার ব্যবস্থা আছে এখানে। দুপুর ১২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সন্ধ্যা ও রাতের খাবারের সময় ক্রেতার চাপ পড়ে বেশি। ওয়াইফাই সুবিধাও আছে।
জনপ্রিয় খাবারগুলোর মধ্যে আছে ‘ব্যাম্বু চিকেন’, কাঁকড়া ও হাঁসের কয়েকটি পদ। এখানেও মুরগির মাংসের পদগুলোর মধ্যে ব্রয়লার আর পাহাড়ি মুরগি এই দুটির মধ্য থেকে বেছে নিতে পারবেন বলে জানান সুচিন্তা।

মুরগির পদগুলোর দাম ১৮০ থেকে ৯শ’ টাকা। হাঁস পাওয়া যাবে ২৮০ টাকায়।

কাঁকড়ার আছে দুই পদ, প্রতি পদের দাম ২শ’ টাকা।

মাছের মধ্যে আছে চিংড়ি, বাইল্ল্যা, ছুরি, লইট্টা ইত্যাদির বিভিন্ন পদ। মাছ ভাজা, শুটকি ভর্তা, সিদ্ধ মাছের ভর্তা, দাম ২শ’ টাকার মধ্যে।

সামুদ্রিক মাছের প্ল্যাটার মিলবে ২শ’ টাকায়- থাকবে লইট্টা, চাপিলা ও এক দৈর্ঘ্যের মাছ।

আবার পাঁচটি চাপিলা মাছ ভাজা পাওয়া যাবে ১০০ টাকায়।

শামুকের পদও মিলবে ২শ’ টাকায়।

খাওয়ার শেষে মিষ্টিমুখের জন্য রয়েছে বিন্নি চালের পায়েশ।

ছবি: সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের।