চুলহীন মাথা মজার কোনো বিষয় না

টাকে টাকা আসে- মোটেও সত্যি নয় বরং মানুষের কথায় মাথা ঘুরে যায়।

আবদুল্লাহ আলিফবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Jan 2019, 10:28 AM
Updated : 29 Jan 2019, 06:38 AM

কেশবর্জিত মাথা নিয়ে কৌতুকের শেষ নেই; কিন্তু যার মাথায় চুল নেই, তার দুঃখেরও শেষ নেই। আশপাশের মানুষের অসহযোগিতা ও অসহিষ্ণুতায় সমস্যাটিকে মোকাবেলায় আলোচনায় জায়গা না পেয়ে অনেককে কষ্ট চাপা দিতে হয় নিজের মাঝেই।

এদেরই একজন মনোয়ারুল ইসলাম মনিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে যিনি অপেক্ষা করছেন চাকরির। ছাত্রত্বের শেষ ১০টি বছর নিত্যদিন তাকে শুনতে হয়েছে একটি শব্দ- ‘টাকলু’। সেই সময়ের মনোপীড়ার কথা আমাদের বলছিলেন তিনি।

উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষে পড়ার সময় চুল পড়া শুরু হয়। উদ্বেগে চিকিৎসার জন্য এখানে সেখানে ছোটাছুটি করেন। কিন্তু কাজ হয়নি।

তিনি বলেন, “সিএমএইচে এক ডাক্তারের কাছে গেলাম। কবিরাজি ডাক্তারের কাছে গেলাম। আমি যখন যা পাইছি, যেটাকে মনে হইছে অ্যাপ্রোপ্রিয়েট, সব জায়গায়ই গেছি কিন্তু আমার কোনো আউটপুট আসেনি।”

“যখন দেখলাম যে চুল একেবারে সবই পড়ে গেলো তখন বেসিক্যালি আমার খুব খারাপ লাগতো।”

মন খারাপে নতুন মাত্রা দেয়-এর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। আশপাশের মানুষ, এমনকি বন্ধু-বান্ধবও এটা নিয়ে হাসি মশকরা করা শুরু করে।

এরপর সামাজিকভাবে বিভিন্ন স্থান থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করতে শুরু করেন তিনি। এমনকি চিত্তবিনোদনের জন্য কোথাও ঘোরাঘুরি করতে গেলেও সেই ছবি সামাজিক মাধ্যমে দিতেন না। টাক কমিয়ে দিয়েছে তার আত্মবিশ্বাসের মাত্রা।

“একাডেমিক লাইফে যখন চুল পড়ে যায় আমি বিভিন্ন জায়গা থেকে আমার এখানে একটা ক্যাম্পেইন হচ্ছে, প্রেজেন্টেশন হচ্ছে, কিছু প্রোগ্রাম হচ্ছে ওগুলো থেকে আমি নিজেকে স্কিপ করতাম। ফেইসবুকে সাধারণত বিভিন্ন জায়গায় গেলে, ঘুরাফেরা করলে ছবি খুব একটা দিতাম না। কারণ দেখা যায় যে, আমি ছবি দিলে একটু অড লাগতেছে। আমার কনফিডেন্স লেভেলটা আরকি লো হয়ে যাইতো। বন্ধুবান্ধব আছে যার অনেকে হাসি মশকরা করতো।”

শারীরিক বিষয় নিয়ে ব্যঙ্গ করাকে বলে, ‘বডি শেইমিং’। বাংলাদেশের মানুষ এর খারাপ দিকটি নিয়ে ততটা সচেতন নন। চুলহীন ছেলেরা অনর্থক উপহাসের পাশাপাশি বিয়ে-রোমান্টিক সম্পর্কের মতো জীবনের সঙ্গে জড়ানো গভীর বিষয়েও অনেক সময় প্রত্যাখ্যাত হতে হয় কেবল এই কারণে।

চুলহীন ছেলেদের জীবনসঙ্গী বেছে নিতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়ার কথা শোনা যায়। মাথায় চুল নেই- এমন ছেলেদের জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে কতোটা আগ্রহী মেয়েরা?

 

এ বিষয়ে রূপন্তি প্রিয়াঙ্কা বলেন, “একদম প্রথমেই রাজি হব না। কারণ হচ্ছে সবাই চায় তার জীবনসঙ্গী দেখতে একটু সুন্দর হোক। কারণ আমরা সবসময় বলে অভ্যস্ত যে, শারীরিক সৌন্দর্য আসলে মুখ্য না। কিন্তু এ বিষয়টা বাস্তবে অতোটা প্রযোজ্য না।”

আরেক তরুণী হাফিজা খানম মুন্নী বলেন, “পারিবারিকভাবেও বলা হয় যে, থাক তুমি একটু দেখ ছেলেটারতো সবকিছুই ভালো আছে এ ব্যাপারটা না হয় আমরা একটু কনসিডার করলাম। কিন্তু সে ক্ষেত্রে অন্যান্য যে অ্যাট্রিবিউটগুলো আসবে বিয়ে করার ক্ষেত্রে সেগুলো যদি ফুলফিল হয় সে ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অনেক সময় কনসিডার করা যেতে পারে। কিন্তু এখন এমন একজন যদি আসে যে, যার অন্যান্য ক্যারেক্টারিস্টিকগুলো, অ্যাট্রিবিউটসগুলো থাকা উচিত সেগুলো তার মধ্যে ওরকমটা নেই মানে আমি যতটা চাই- সেক্ষেত্রে কিন্তু আমরা ওইটাকে বড় একটা ইস্যু হিসেবে দাঁড় করাবো যে না একজন টাককে আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব না।”

মাহমুদা সাবিহা বলেন, “আমাদের এখনকার সোসাইটিতে ছেলেদের যে প্রফেশন অ্যান্ড আমার কোয়ালিফিকেশনের সঙ্গে যদি ম্যাচ করে যায় দেন আমার মনে হয় যে এটা কনসিডার করবো।

মাথার টাক অনেক সময় জন্ম দেয় হীনম্মন্যতার। রেহাই পেতে অনেকে পরচুলা পরেন, কেউ চুল প্রতিস্থাপনের কথা ভাবেন। পরচুলা ব্যবহার করলেও অনেকে তা গোপন রাখেন। তাতে কি মনে শান্তি আসে?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পরচুলা ব্যবহারী বলেন, “আগে যে ধরনের একটা অস্বস্তি লাগা কাজ করতো এখন সে জায়গাটা নাই। এক ধরনের স্বস্তি আছে।”

“নিজেকে দেখতে কেমন লাগছে- এই চিন্তাটা একটা অস্বস্তি লাগা কাজ করতো, ওই জায়গাটা এখন আর নাই। এখানে আমার সুবিধাটা হচ্ছে উইগটা পারমানেন্ট না। সার্জারির মধ্য দিয়ে যেতে হয় না। খরচটাও হাতের নাগালে ছিল। চাইলে যে কোনো সময় নিজে থেকেই সার্ভিস করতে পারি। সব সুবিধার কারণে এটা আসলে ইউজ করা।”

তবে টাক নিয়ে এত উদ্বেগ কেনো বাংলাদেশে? এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সেলিম হোসেন বলেন, “সোসাইটাল স্ট্যান্ডার্ড অব বিউটিতে আমরা যে চিত্র দেখি আমি, মানুষের সেই চিত্রের মধ্যে চুল আছে। এছাড়াও দেখেন আপনি, মিডিয়া বিভিন্নভাবে চুল রাখাকে প্রমোট করে। আরেকটা যেটা খুব ইমপোর্টেন্ট বিষয় সেটা হল চুল থাকাটা অ্যাজ অ্যান ইন্ডিকেইশন দ্যট ইউ উইল গেট অ্যাকসেস টু দ্য জব মার্কেট।”

“আর ওভারঅল মানুষের একটা ইনএইট (অন্তর্নিহিত) একটা টেনডেন্সি আছে, সে গ্রিন থাকতে চায়, সে ইয়াং থাকতে চায়। চুল থাকাটা হচ্ছে তার ইয়াংয়ের প্রতীক, গ্রিন থাকার প্রতীক। যে কারণে সবকিছু মিলিয়ে আমার কাছে মনে হয় যে চুল থাকাটাকে আমরা সোসাইটিতে প্রেফার করি।”

পুষ্টিহীনতা, শারীরিক পরিশ্রম না করা, প্রসাধনী ব্যবহার, এমনকি বংশগত কারণেও টাক হতে পারে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বেশি সময় কাটানো, শীতের রুক্ষতা এবং নারীদের ক্ষেত্রে সন্তান জন্মদানের পরেও অস্বাভাবিকভাবে চুল পড়তে পারে।

বাংলাদেশে চুল পড়া নিয়ে কোনো গবেষণা ও পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। ঢাকার একজন চিকিৎসকের চেম্বারে দেখা গেলো টাকের নিদান পেতে আসা বেশিরভাগই বয়সে তরুণ। প্রতিদিন অন্তত ৬০ জন ওই চিকিৎসকের কাছে যান চুল গজানোর উপায় জানতে। টাক কি নিরাময়যোগ্য? 

ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপকডা. এস. এম. বখতিয়ার কামাল বলেন, “প্রায় আড়াই শ’ রোগে চুল পড়ে। এর মধ্যে চার-পাঁচটি রোগের কারণে চুল পড়ে, সেগুলার চিকিৎসা পৃথিবীতে নেই। ফলে সেগুলো নিরাময়যোগ্য না। আর বাকি যে কারণ আছে, আমাদের কাছে যে রোগী আসে বা সারা পৃথিবীতে চুলের ডাক্তারের কাছে যে রোগীরা যায় তার শতকরা ৯৯ ভাগ রোগীর চুল যে পড়ে তা ‘রিগ্রো’ করা সম্ভব।”

কারও মাথায় কোনো ঘা হলো, পাঁচড়া হয়ে চুল পড়ে গেলো ওখানে, কোথাও পুড়ে গেলো, কারও মাথায় একটি অংশে ক্যামিকেল দিয়ে ক্ষতি হয়ে গেলো অথবা আগুন লেগেই পুড়ে গেলো বা কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়ে কোনো বড় ধরনের সেলাই পড়ে গেলো, ওসব জায়গায় চুল গজানো সম্ভব না। আর বাকি সব ক্ষেত্রেই অলমোস্ট চুল গজানো সম্ভব।”

চুলের যত্নে মানুষ কত কিই না ব্যবহার করেন। শ্যাম্পু, সাবান, জেল, তেল, রং- এসব পণ্যের বাজার বাংলাদেশে বেশ বড়। বিজ্ঞাপনে চুলের যত্নের বিষয়টিকেই জোরের সঙ্গে বলা হয়।

তবে এই চিকিৎসকের মতে, চুলে প্রসাধনী ব্যবহার না করা ও সুষম খাদ্যই পারে ‘টাক পড়া’ ঠেকাতে।

“আমার প্রথম কথা হচ্ছে চুলের কোনো যত্নেরই দরকার নেই। ইমপোর্টেন বিষয় হচ্ছে এইসব হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্ট বরং আরও চুল পড়া বাড়ায়। বরং হেলদি লাইফস্টাইল প্রচুর পানি, শাক, মাছ, দেশি ফল এই ধরনের খাদ্যাভাসে অভ্যস্ত হতে হবে আমাদেরকে। এবং প্রচুর হাঁটতে হবে। অথবা ঘরের কাজগুলা নিজ হতে নিজেই করতে হবে।”

আর মনোবিজ্ঞানীদের মতে, টাক নিয়ে রসিকতা মাত্রা ছাড়াচ্ছে কি না, সেটাও আমাদের ভাবতে হবে। সেজন্য দরকার সামাজিক সচেতনতা, মানসিকতার পরিবর্তন।

আরও পড়ুন