কালবিলা শাপলা সুন্দরীর বিলে

সকাল ছয়টায় ইঞ্জিন চালিত নৌকায় যাত্রা শুরু হয়েছিল। সাত-সকালে কোথাও পাখির কিচিরমিচির না পেলেও পানি পথে একটা অপূর্ব সুন্দর সুতানলীর দেখা পেলাম।

ফারুখ আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Sept 2018, 09:26 AM
Updated : 28 Sept 2018, 09:28 AM
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি দেখে ক্যামেরা বের না করায় সুতানলীল ছবি না তোলার আফসোস ছিল। আবার ভালোলাগাও ছিল। আসলে শুধু ছবি না তুলে মাঝে মধ্যে উপভোগও করতে হয়। সকালের নাস্তা হয়নি। আর এত সকালে কখনও এটা হয়ও না। নৌকা আধা ঘণ্টা চলার পর প্রচণ্ড ক্ষিধা অনুভব করলাম। ঠিক তখনই আমাকে অবাক করে দিয়ে সোহান একটু দূরের ঝরনা বাড়ৈর মুদি দোকান দেখিয়ে বলল এখন আমরা এখানে বিশ্রাম নিব।
চারিদিকে পানি, মাঝে দ্বীপের মতো ঝরনা বাড়ৈদের বাড়ি। বিলের পারে মুদি দোকান করেন দেখে ঝরনাবাড়ৈকে হালকা ভাবে নেবেন না। তিনি এসডিএফের সভাপতি। এক ছেলে ঢাকার তিতুমীর কলেজে সম্মান নিয়ে পড়াশোনা করছে, অন্যজন হারতা ইউনিয়ন এর হারতা স্কুল এন্ড কলেজের ছাত্র। আশ্চর্য হলেও তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই তার এত বড় দুইটা ছেলে রয়েছে।

ডিম, চা-পান বিস্কুট, বাটার বন ছাড়া এখানে অন্য কিছু বিক্রি হয় না।

এটা পশ্চিম কালবিলার গল্প। আমরা কালবিলা এসেছি শাপলা ফুল দেখতে। বরিশালের বিখ্যাত লাল শাপলা। কালবিলা ও সাতলা বিখ্যাত লাল শাপলার জন্য। বিশাল বিলের সাতলা নয় কালবিলা অংশে শাপলা দেখতে এসে ঝরনা’দির সঙ্গে পরিচয়।

আমরা যখন শাপলা দেখার জন্য ঝরনা’দির কাছ থেকে বিদায় নেব, তখন দিদির দোকানের খুঁটিতে একটা সাদা-কালো মাছরাঙা। আফসোস তখনও আমি মোবাইলের ওপর ভরসা করে ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করিনি!

সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় আমরা এমভি টার্ন স্টিমারে চেপে বরিশাল যাত্রা করে পরদিন পৌঁছেছি। আলো আঁধারিতে ফিরোজ মোস্তফার ডাকে সম্বিত ফিরল।

বরিশাল স্টিমার ঘাটে তখন টিকেট চেকার ছাড়া আমরা দুজন। আর ফিরোজের সঙ্গী পাঁচজন। ফিরোজ সোহান ও সুমন মোল্লাসহ পাঁচজন ওরা রাত জেগে অপেক্ষা করেছিল।

ফিরোজের সঙ্গে এখন আমরা উজিরপুর যাব। দেড় ঘণ্টা দূরের উজিরপুর বরিশালের একটি উপজেলা। এক সময় উজিরপুর যেতে মোটরবাইক একমাত্র ভরসা ছিল। এখন বাসসহ মাহেন্দ্র অটো রিকসার যাতায়াত এই পথে।

আমরা রফিকের মাহেন্দ্র অটোরিকসায় চেপে রওনা হলাম। সেই অটো আমাদের অন্ধকার পথ ধরে ফজরের আজান শুনিয়ে শুনিয়ে এগিয়ে চলল।

চারিদিকে অন্ধকার। সারারাত ঘুমাইনি। চোখ বন্ধ করে একটু ঘুমাবার চেষ্টা করলাম। শাওনের ডাকে ঘুম ভাঙতে দেখি আমরা পৌঁছে গেছি। রাস্তার বাম পাশে ব্যানার টাঙানো। তাতে লেখা পশ্চিম কালবিলা শাপলা পর্যটন কেন্দ্র। বাম পাশে নৌকার মাঝিদের হাঁকডাক।

আমরা মাঝির সঙ্গে দরদাম করে একটা নৌকায় চড়ে বসলাম। বৈঠা নয়, ইঞ্জিন চালিত নৌকা। মাথার ওপর সামিয়ানা টাঙানো। পাটাতনে ক্যামেরা বাগিয়ে বসে পড়লাম সামনের দিকে মুখ করে, আমার পেছনে অন্যরা। তখন সময় সকাল ছয়টা হবে। মেঘলা আকাশের জন্য তখনও চারপাশ প্রায় অন্ধকার আছন্ন।

নৌকা এগিয়ে চলল আপন গতিতে। ইঞ্জিন চালিত না হয়ে লগি বা বৈঠা চালিত নৌকা হলে ভালো হত। কারণ একটু পরপরই নৌকার প্রপেলার স্যাফটে শাপলা আটকে শুধু যে আমাদের যাত্রা বিলম্ব করছিল তা নয় বিলের শাপলারও বারোটা বাজাচ্ছিল।

যা হোক, শাপলা সুন্দরীর আড্ডাখানায় ঢুকে পড়তে বেশি সময় লাগলো না আমাদের।

পুরো কালবিলা বিল জুড়েই শাপলা সুন্দরীর বসবাস। আমরা চারপাশে কাছে দূরে শাপলাদের সংসার দেখছিলাম। এখানে বিলের এত্ত এত্ত শাপলার প্রধান বিষয় হল এরা সবাই লালরঙা।

বিক্ষিপ্তভাবে এখানে ঘিয়ে রঙা শাপলার সঙ্গেও দেখা হয়ে যাচ্ছিলো। প্রচুর চাঁদমালা ফোটার অপেক্ষায়। শাপলা যেমন রাতের বেলা ফোটে, চাঁদমালা ফোটে দিনের বেলা।

কালবিলা বিলে লাল শাপলার পরই চাঁদমালার বসবাস। অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জলায় ফুটে আছে নীল শালুক। এভাবেই বিস্তির্ণ বিলের জলপথে চলতে চলতে হঠাৎ খেয়াল করি ফিরোজ পানিতে কিছু খুঁজছে। এক সময় পেয়েও যায়। দেখি তার হাতে অনেকগুলো  ‘ঢ্যাপ’ বা শাপলার ফল। অসংখ্য লাল শাপলার ভিড়ে এসব জলজ সৌন্দর্য দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে বাধ্য!

এভাবেই কালবিলার ভোর, শাপলা, ঝরনাবাড়ৈ ও তপন ভৌমিকের কোলাজ ফ্রেম বন্দি করতে করতে ফিরে চলি বাইশ মাথা খেজুর গাছের কাছে।

ওহহো, বাইশ মাথা খেজুর গাছ সম্পর্কেও তো বলা হল না। থাক সে গল্প আরেকদিন!

জেনে নিন

শাপলা বিলে বেড়ানোর সেরা সময় সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাস। তারপরও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে বিলের শাপলা সম্পর্কে জেনে রওনা দেওয়া ঠিক কাজ হবে।

শাপলা বিলে শাপলার সঙ্গে সাপেরও বসবাস। সুতরাং বিষয়টা মাথায় রাখবেন।

অযথাই নৌকায় বসে বিলের পানিতে পা ঝোলাবেন না। সাঁতার না জানলে লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে রাখুন। যে কোনো সময় বৃষ্টিও চলে আসতে পারে। তাই ছাতা বা বর্ষাতিও রাখুন।

প্রথমে যেতে হবে সাতলা। কালবিলা থেকে সাতলার দূরত্ব ১০ মিনিটের। তাই মন চাইলে দুটো বিলই ঘুরে দেখতে পারেন।

ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়া খুব সহজ। স্টিমার ঘাট শ্যামবাজার। ছাড়ার সময় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা। বৃহস্পতিবার রাতে রওনা হলে বিশাল ‘মধুমতি’ স্টিমারের যাত্রী হতে পারবেন।

এছাড়া এ পথে রয়েছে বিলাসবহুল সব লঞ্চ। যাত্রার সময় রাত ৮টা থেকে সাড়ে ৯টা। সদরঘাটের বরিশাল নতুন ঘাট চলে যান। কেবিন নিলে আগেই ঘাটে গিয়ে বুকিং দিয়ে রাখুন। ডেকের ভাড়া ১৫০ থেকে ৩শ’ টাকা।

কেবিন ভাড়া সিঙ্গেল ৫শ’ থেকে ১ হাজার টাকা। ডাবল ১ হাজার ২শ’ থেকে ২ হাজার ২শ’ টাকা।

বরিশাল ভোর চারটায় পৌঁছে যাবেন। আগে থেকেই তাই মাহেন্দ্র অটো রিকসা বুকিং দিয়ে রাখলে ভালো। না রাখলে ঘাট থেকে কিংবা নখুলস্নাবাদ এসে দরদাম করে মাহেন্দ্র অটো রিকসায় চেপে বসুন। আসা যাওয়ার ভাড়া ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা।

আগেই বলেছি উজিরপুর যেতে সময় লাগে দেড় ঘণ্টা। এখানে কালবিলা কিংবা সাতলা যে অংশেই যান নৌকা ভাড়া এক থেকে দেড় ঘন্টার জন্য ৬শ’ থেকে ১ হাজার টাকা নেবে।

ছুটির দিন হলে আগেই বুকিং দিয়ে নিবেন। না হলে এসব ভাড়া আকাশ ছোঁয়া।

সতর্কতা

লঞ্চে দেরি করা যাবে না। ঘাটে লঞ্চ ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা শুরু করতে হবে। সঙ্গে খাবার পানি শুকনা খাবার ও ক্যাপ বা গামছা নিয়ে নেবেন।

নৌকায় বসে চিৎকার চেঁচামেচি কোলাহল করবেন না। বিস্কুট চকলেট চিপস কোমল পানীয় খেলে এসবের পলিথিন বা বোতল সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলুন।

শাপলা বিল দেখার পর হাতে প্রচুর সময় পাবেন। তাই ইচ্ছে মতো বরিশাল ঘুরাফেরা করে তবেই ফিরতি লঞ্চ ধরুন।

ছবি: লেখক।