লটকন দুনিয়ায়

নরসিংদী এলাকায় অনেকেই লটকনকে বগি বলে ডাকে। সরাসরি কাণ্ড থেকে বের হওয়া লটকনের গাছ দেখতে খুব সুন্দর। তাই লটকন মৌসুমে নরসিংদী এলাকার রায়পুরা ও শিবপুরের বিভিন্ন লটকন বাগানে ভ্রমণ রসিকদের ভিড় জমে।

ফারুখ আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 August 2018, 08:57 AM
Updated : 31 August 2018, 08:58 AM

সেই ভিড়ে আমরাও সামিল হলাম।

এই এলাকার কাঁঠাল এক সময় প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল, এখন সে জায়গা নিয়েছে লটকন।

লেগুনায় চেপে সৃষ্টিগড় যেতে যেতে কথা হয় স্থানীয় সাগীর মুরাদের সঙ্গে।

বললো, “ইদানীং অনেকেই আসে এখানে। বাজার বসে মরজাল এলাকায় ভোর পাঁচটায়। সে দৃশ্যও দেখার মতো। ভোরে আসলে ভালো করতেন”।

সৃষ্টিগড় বাস স্টপেজে আমরা লেগুনা থেকে নামি, সঙ্গে সাগীর মুরাদ। তিনিই আমাদের জন্য একটা ব্যাটারি চালিত রিকশা ঠিক করে দেন। আমরা মাসুদের রিকশার যাত্রী হতেই, মাসুদ আমাদের নিয়ে লটকন বাগানের উদ্দেশ্যে ছুটে চললো।

সৃষ্টিগড় বাসস্ট্যান্ড পেরিয়ে গ্রামের পিচ পথ ধরতেই চলার পথের ক্লান্তি দূর হয়ে মন ভালো হয়ে যায়। আহ, কী সুন্দর। চারিদিকে সবুজের বান ডেকেছে, যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করার নয়।
বৃষ্টি নেই, আকাশ একদম পরিষ্কার। রোদও উঠেছে। পেঁজা তুলার মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে সে আকাশে। মেঘে ভেসে ভেসেই যেন আমরা লটকন বাগানে চলে এলাম। এখানে ‘ভিউ পয়েন্ট’ বলে কিছু নেই। দুচোখ বিস্তৃত করলেই প্রাণ ভরে উপভোগ করা যাচ্ছে লটকন সৌন্দর্য। আমরা লটকনের দিকে তাকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হলাম!

লটকন বুনো গাছ। খুব একটা যত্ন নিতে হয় না গাছের। তবুও লটকন গাছ বেড়ে ওঠে তরতর করে। তবে বাংলাদেশে লটকনের চাষ হয়। প্রতি বছর গ্রীষ্ম-বর্ষায় সমানে ফল দেয়।

আমি লটকন গাছ প্রথম দেখি জৈন্তাপুর সাইটার্স গবেষণা কেন্দ্রে। এরপর এই নরসিংদির শিবপুর এলাকায় তিন বছর আগে প্রথম, তারপর আজ আবার। তবে আমার সঙ্গীর এই প্রথম। সুতরাং তার উচ্ছাস চোখে পড়ার মতো।

আমরা পুরো এলাকা একঘণ্টা রিকশায় বসে কেবল দেখেই চলি। এখানে পুরো এলাকাই লটকনের, আর আছে কাঁঠাল ও লেবু। লটকনের মতোই এখানকার লেবু এবং কাঁঠালের সুনামও কম না। তবে এখন আর কাঁঠাল নিয়ে কেউ ভাবেন না। সবার ভাবনা লটকন নিয়ে। ঠিক যেমন এখন আমাদের।

মাসুদের আহ্বানে এবার আমরা রিকশা থেকে নামলাম। রাস্তার পাশের লটকন বাগানে প্রবেশ করলাম। বাগান মালিক লেবু ছিঁড়ছিলেন গাছ থেকে। তাকে সালাম দিয়ে লটকনে মনোযোগ দিলাম।

থোকায় থোকায় লটকন পুরো গাছ জড়িয়ে আছে। আমরা এক গাছ থেকে আরেক গাছ তারপর আরেক গাছে ছুটে চলছিলাম, সে এক দৃশ্য বটে। লেবু বাদ দিয়ে বাগান মালিক হাজী আব্দুর রহমান আমাদের কাছে ছুটে এলেন। তার উচ্ছাসও চোখে পড়ার মতো।

বললেন, “যত ইচ্ছা লটকন খাও, মানা নাই। কোন গাছের লটকন বেশি মিষ্টি সে গাছের কাছে নিয়ে গেলেন, ইচ্ছা মতো খেলাম। ছবি তুললাম। এভাবেই এবার অন্য বাগানে যাওয়ার পালা। কিন্তু পড়লাম মধুর সমস্যায়।

হাজী সাহেব তো ছাড়বেন না আমাদের। ভাত খেয়ে যেতে হবে। অনেক অনুরোধ উপক্ষো করে অন্য আরেকদিনের ওয়াদা করে রিকশায় উঠলাম, তার আগে হাতে পেলাম এক ব্যাগ লটকন!

আবার আমাদের লটকন দেখে দেখে এগিয়ে যাওয়ার পালা। মজার হচ্ছে আকাশ ঝকঝকে হলেও লটকন এলাকায় সে রোদ পৌঁছতে পারছিল না, লটকন গাছের ঝোপালো অবস্থার জন্য। একেকটা লটকন গাছ লাগানো হয়েছে খুব ঘন করে, আর একটি গাছ ১২ থেকে ১৫ মিটারের বেশি উচ্চতার ছিল না। পুরো এলাকা ছায়াঘেরা ভালো লাগার।

ছোটাবন্দ এলাকার মনসুর মিয়ার বাগানে গিয়ে মনে হল তিনি সত্যিকারের ব্যবসায়ী। সাংবাদিক নাম শুনে কীভাবে নিউজ করা যায় তাকে নিয়ে, তার ছবি তোলাসহ বিভিন্ন সুবিধা নেওয়ার দিকেই তার মনোযোগ দেখলাম।

জানলাম লটকন বিক্রির নানান তথ্য। এক গাছ থেকে প্রতিবছর ৩ থেকে ১৫ লাখ টাকা কামানোর তথ্যও পেলাম আমরা। সাগীর মুরাদের মতো তিনিও মরজালের প্রতিদিনকার বাজার বা হাট বসার কথা বলতে ভুললেন না।

এর মধ্যে রিকশাচালক মাসুদের সঙ্গেও ভাব হয়ে গিয়েছে। বেলা প্রায় দুইটা বেজে গেছে দেখে নৌকাঘাটা এলাকায় তার আত্মীয়র বাড়িতে নিয়ে গেলেন আমাদের পরিষ্কার হওয়ার জন্য।

নৌকাঘাটা এলাকার আশ্রাফ মিয়ার বাড়িতে হাতমুখ ধুয়ে বসতেই হাতে চা পেলাম, পেলাম বাসন ভর্তি গাছের কাঁঠাল। এসব খেয়ে বিদায় নিতে গিয়ে তো আরেক দফা অবাক আমরা। রান্না হচ্ছে খেয়ে যেতে হবে।

আশ্রাফ ভাইয়ের সঙ্গে সবে পরিচয় হলেও অতিথি আপ্যায়নে তার কার্পণ্য ছিল না। পড়ন্ত বিকেলে তিনি আমাদের নিয়ে তার ১৫০ একরের বাগান ঘুরে দেখিয়েছেন, আর ব্যাগ ভরে লটকন দিয়েছেন। পাশের বাসার বাঁধনের আম্মা আমাদের জন্য তেলে ভাজা পিঠা নিয়ে এসেছিলেন। এমন আন্তরিকতার কোনো জবাব আমাদের ছিল না, কেবল আবার দেখা হবে বলে চলে আসা ছাড়া!

প্রয়োজনীয় তথ্য

লটকন বাগান দেখার মোক্ষম সময় গ্রীষ্ম-বরষা কাল। সে হিসেবে লটকন বাগান বেড়ানোর এখনই শেষ সময়। আর কিছুদিন পর লটকন আর থাকবে না এ বছরের মতো। সুতরাং একবার দলবেঁধে ঢুঁ মারতেই পারেন।

দশজনের দল ও একটি মাইক্রোবাস ভালো হবে। তাহলে মনের মতো বেড়িয়ে আসা যাবে। মাইক্রেবাস হলে তো কথা নেই। সৃষ্টিগড় হয়ে চৈতন্য, কুণ্ডপাড়া, নৌকাঘাটা ও বেলাবোর লটকন বাগান মনের মতো ঘোরা যাবে।

সৃষ্টিগড় বা মরজাল থেকে লটকন যাত্রা শুরু করার পর সরাসরি লটকন গাছ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়বে না।

এসব বাগানে প্রবেশে কোনো বাঁধা পাবেন না বরং স্বাগত জানাবে বাগান মালিক বা এলাকার লোকজন। লটকন নিজে থেকে ছিঁড়লেও কেউ কিছু বলবে না, তবু অনুমতি নেওয়া ভালো। কারণ, এমন আন্তরিকতায় অনুমতি না নেওয়া বেয়াদবির সামিল। 

যারা মাইক্রোবাসে সওয়ার না হয়ে বাসে যাবেন তারা গুলিস্তান, মহাখালি বা খিলখেত ফ্লাইওভারের নিচ থেকে বাসে চেপে সরাসরি মরজাল বা সৃষ্টিগড় চলে যেতে পারবেন। হাতে সময় নিয়ে বের হবেন। ভুলেও কেউ পাঁচদোনা নামবেন না। তাহলে এক বোঝা ভোগান্তি আপনাকে আঁকড়ে ধরবে। ফেরার পথে মরজাল বাজার থেকে লটকন কিনে ফিরতে পারবেন। আর বেড়িয়ে আসতে পারবেন উয়ারিবটেশ্বর!

আরও একটু

লটকনের সঙ্গে রথযাত্রার বিশেষ সম্পর্কেও কথা জানা যায়। সে জন্য রথযাত্রার দিন শুরু করে উল্টারথ ও দেশের বিভিন্ন এলাকার রথ মেলায় লটকন বিক্রি হতে দেখা যায়!