বন্ধুত্বের প্রভাব

বন্ধুত্বের হয়না পদবি, বন্ধু তুমি কেঁদো না। বন্ধু সবুজ চিরদিন, বন্ধুত্বের বয়স বাড়ে না।

তৃপ্তি গমেজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 August 2018, 07:10 AM
Updated : 5 August 2018, 07:10 AM

অঞ্জন দত্তের গানের এই চরণের সঙ্গে কেউ নিশ্চই অমত করবেন না। প্রকৃত বন্ধুত্বের বয়স বাড়ে না। বয়স্ক জীবনে কৈশোরের বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটালে ফিরে পাওয়া যায় হারানো দিনগুলো।

আবার ছোট বয়সের বন্ধুত্বের প্রভাবও কম নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস অ্যামহার্স্ট’য়ের ‘সাইকোলজিকল অ্যান্ড ব্রেইন সায়েন্স’য়ের প্রাক্তন অধ্যাপক সুসান ক্রাস হুইটবর্ন মানসিক স্বাস্থ্য-বিষয়ক একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানান, ‘শৈশবের বন্ধু শিক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি শুরু করতে সাহায্য করে। গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতাগুলো শেখার পাশাপাশি জীবনের গল্প সাজিয়ে তোলে ছেলেবেলার বন্ধুত্ব।’

যুক্তরাষ্ট্রের মানসিক স্বাস্থ্য-বিষয়ক লেখিকা কার্লিন ফ্লোরা’র প্রকাশিত বই ‘ফ্রেন্ডফুলেন্স’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে এই অধ্যাপক আরও জানান, এই কারণে ফ্লোরা তার বইতে, শিশুদের সামাজিক সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে অনির্ধারিত সময় দেওয়ার জন্য অভিভাবক ও শিক্ষকদের পরামর্শ দিয়েছেন।

‘ফ্রেন্ডফুলেন্স’ অর্থাৎ বন্ধুত্বের প্রভাব বিষয়ে লেখা এই বইতে ফ্লোরা আরও জানিয়েছেন, কৈশোরের বন্ধুত্ব সুন্দর রোমান্টিক সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। এই কারণে বন্ধুদের সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর ক্ষেত্রে সন্তানকে বাধা না দেওয়া অভিভাবকদের উচিত হবে। বরং বন্ধুদের ঘরে নিয়ে আসার জন্য সন্তানকে উৎসাহ দিন।

ফলে সন্তান ভালো না খারাপ সংস্পর্শে আছে সেটা নজরে থাকবে।

ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র যোসেফের কাছে বন্ধু মানে খেলার সঙ্গী।

তার কথায়, “স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে পড়ার ফাঁকে গল্প করি, স্কুল শেষ হলে মাঠে খেলি। আবার বাসায় ফিরে বিকাল বেলা বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে যাই। স্যারের বাসায়ও অনেক বন্ধু আছে আমার। একদিন না গেলে তারা আমার খোঁজ নেয়, স্যারের পড়া দিলে তা জানায়। আমিও আমার বন্ধুদের সাহায্য করি তাদের খোঁজ খবর নেই।”

ছোট বেলায় ক্লাসের পড়া নিতে, গল্প করতে, খেলাধুলা করতে বন্ধু যেমন দরকার তেমনি একটু বড় হয়ে মনের কথা বলতে, দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নেওয়া হয় এই বন্ধুদের সঙ্গেই। তারুণ্যের বন্ধু হয় বেড়ানো সঙ্গী। আর একটু ভারী বয়সে বন্ধু হয় সুপরামর্শক। সামনে এগিয়ে যাওয়া আরও গতিময় হয় বন্ধুদের উৎসাহেই।

একই ভাবে সুসান ক্রাস তার প্রতিবেদনে বলেন, “মানুষের প্রবণতা হচ্ছে নিজের সঙ্গে মিল রেখে বন্ধু পছন্দ করা। তবে নিজের মতাদর্শের সঙ্গে মিল নেই এরকম মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে দৃষ্টিভঙ্গীর নতুন রূপ চোখের সামনে আসবে।”

স্কুল শিক্ষক রুপা দাসের মতামত হচ্ছে, “অনেকেই পরিবারে বাবা মায়ের সঙ্গে নিজের মনের কথাগুলো বলতে পারেন না। সেক্ষেত্রে বন্ধুরা হয় মনের কথা বলায় জায়গা। আবার অনেকের বাবা মায়ের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকার পাশাপাশি বাইরে ভালো বন্ধু থাকলে মানসিক ও সামাজিক বিকাশটা সুন্দরভাবে হয়, এতে করে সে একজন ভালো মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠে।”

কৈশোর কিংবা ছাত্রজীবনে ভিন্ন মাত্রার বন্ধুত্ব গড়ে না উঠলেও কর্মক্ষেত্রে নানান মানসিকতার মানুষের সঙ্গে মিলমিশে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।

বেসরকারি চাকুরিজীবী ফারিয়া ইসলাম বলেন, “জীবনটাকে সহজ করতে আর মনের অনুভূতিগুলো খোলামেলা ভাবে বলতে বন্ধু থাকা প্রয়োজন।”

“কর্মক্ষেত্রে স্কুল কলেজের বন্ধুদের খুব মিস করি। এখানে ছোটবেলার বন্ধুরা নেই। কাজের খাতিরেই পরিচয় সহকর্মীদের সঙ্গে। তারপরেও দুয়েকজনের সঙ্গে নিজের চিন্তা ভাবনা মিলে যায় আর তারাই হয়ে ওঠে কর্মক্ষেত্রের কাছের বন্ধু।”

তিনি আরও বলেন, “স্কুল কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাত অনেকটাই কমে যায় অফিসের জন্য। আর তখন সহকর্মীরাই হয় সহভাগিতার জায়গা। কর্মজীবনে অনেক প্রতিকুলতা ফেইস করতে হয়, এই বন্ধুরাই তখন ঢালের মতো কাজ করে।”

“এই সময় বন্ধু মানে একজন ঢাল ও পরামর্শক।” নিজের কথাগুলো এভাবেই জানালে ফারিয়া।

সুসান ক্রাস তার প্রতিবেদনে জানান, কাছের বন্ধুরা গভীর কিংবা হালকা ভাবে আপনার চিন্তা-ভাবনার সমর্থন করবে। বন্ধুত্বপরায়ন মানসিকতার জন্য অনেক বন্ধু থাকতে পারে জীবনে। তবে সাহায্যের জন্য একশ বন্ধুর দরকার নেই। এজন্য বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ‘বন্ধু-বৃক্ষ’ থেকে ডালপালা ছেঁটে যারা আপনাকে বেশি গুরুত্ব দেবে তাদেরকেই জীবনে রাখা ভালো।”

তবে বন্ধুরা জীবনকে অতিষ্ঠও করে তুলতে পারে।

অধ্যাপক সুসানের ক্রাস এই বিষয়টাকে বন্ধুত্বের অন্ধকার দিক হিসেবে দেখিয়েছেন।

তিনি বলেন, “যারা আপনাকে সবচেয়ে বেশি চিনবে তাদের বিশ্বাসঘাতক হওয়ার শক্তিটাও বেশি থাকে। বন্ধুরা অনেকসময় বিপদেও ফেলতে পারে। তাদের খারাপ বা ক্ষতিকর অভ্যাস আপনাকে সেদিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে, যেমন- বন্ধুর কারণে মদ্যপান বা ধূমপানের অভ্যাস গড়ে ওঠা।”

সুসান আরও বলেন, “আপনার জীবনের লক্ষ্য কিংবা প্রেম বা সংসার জীবনে যদি বন্ধু হয়েও অনধিকার-চর্চা করা শুরু করে তবে সেটা মানসিক অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই এই ধরনের বন্ধুদের না বলতে দ্বিধা করা উচিত না।”

বন্ধুর কারণে প্রতারিতো বোধ করা এবং মানসিক চাপে থাকাও ‘ফ্রেন্ডফুলেন্স’য়ের লক্ষণ।

আরও পড়ুন