নীল সাগর আর আগুন পাহাড়ের বালিতে

হাতে কম সময় নিয়ে গেলে হবে না। বালি’র সৌন্দর্য ভোগ করার জন্য প্রয়োজন অন্তত পাঁচদিন।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 May 2018, 10:40 AM
Updated : 20 May 2018, 10:41 AM

দেশের বাইরে ঘুরতে যাওয়ার জায়গা হিসেবে অন্যতম ইন্দোনেশিয়ার বালি’তে সম্প্রতি ঘুরে এসেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’য়ের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শামীম আহমেদ। সেখানে ঘুরতে গেলে কী কী দেখার আছে সেই অভিজ্ঞতাই জানাচ্ছেন এই প্রতিবেদনে।

ঘুম ঘুম চোখে হঠাৎ দেখি প্লেনটি গাঢ় নীল পানির দিকে ধেয়ে চলছে। তবে ধারণা ভুল প্রমাণ করে সমুদ্রের পারে রানওয়েতে ঠিক মতোই ল্যান্ড করলো বিমান। বালির ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ১০টা। উজ্জ্বল সূর্যালোকে চারদিক উত্তাল।

বালির নাগুরা রাই আন্তজার্তিক বিমানবন্দরে নামার পর দাঁড়ালাম ইমিগ্রেশনে। সফরসঙ্গী দুজন হঠাৎ হাওয়া। পরে খুঁজে পাওয়া গেল ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার অফিসে। জানলাম তাদের আটকিয়েছে যাচাই-বাছাই করার জন্য। নয়জন সফরসঙ্গীর বাকিরাও চলে গেলাম সেখানে, বললাম সবাই একসঙ্গে সবারই জিজ্ঞাসাবাদ হোক।

আগুন-বালি শপিং সেন্টার।

একে একে সবাইকে ডেকে কিছু তথ্য নিশ্চিত হয়ে ছেড়ে দিল আমাদের। সফরসঙ্গীর মধ্যে ছয়জনই সাংবাদিক। ইমিগ্রেশনে কিছুটা সন্দেহ হওয়াতে হয়ত তাদের কিছু বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল।

তবে একদিকে লাভ হয়েছে। ব্যস্ত এ বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে যে লম্বা লাইন ছিল আমাদের তা পার করতে এক ঘণ্টা লেগে যেত। ১০ মিনিটের মাথায় আমরা এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে পারলাম ইমিগ্রেশন কর্তকর্তার সন্দেহের চোখে থাকার জন্য।

বিমানবন্দরের বাইরে আসার পর আর অপেক্ষা করতে হয়নি। আমাদের টুরিস্ট গাইড নোভাকে পেলাম খুব সহজেই। মিনিবাসে করে রওনা হলাম আমাদের হোটেলের দিকে, তবে রাস্তার প্রচন্ত যানজট থাকায় সমুদ্রতীর এলাকা কুটায় হোটেলে যেতে আমাদের লেগে যায় প্রায় এক ঘণ্টা।

বাসা থেকে ঢাকা বিমানবন্দর, ঢাকা থেকে মালয়েশিয়া প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা এবং সেখানে দুঘণ্টা ট্রানজিট আবার সেখান থেকে তিন ঘণ্টায় বালি। দীর্ঘ ১৬ ঘণ্টার  মতো জার্নি করে সবাই ক্লান্ত। তবে সমুদ্র পারের হোটেলে ঢোকার পরই সে কান্তি  নিমিষেই কেটে গেল। পুরো হোটেল জুড়ে সবুজ আর নীল পানির জলকেলি।

যার যার রুমে গিয়ে খুব দ্রুত ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে গেলাম দুপুরের খাবারের খোঁজে। হোটেলের পাশেই রয়েছে নানা রকমের খাবারের দোকান। স্থানীয় একটি হোটেলে খেয়ে নিলাম। দল নেতার সিদ্ধান্ত এল আজ আর কোনো স্পটে ঘোরাঘুরি নয়, যে যার মতো রেস্ট নিতে পারবে।

কে শুনে কার কথা। রুমে আর যাওয়া হল না, ঘুরাঘুরি শুরু হল সেখান থেকেই। ঘুরে দেখতে হবে পুরো শহর। প্রায় ঘণ্টা দুই হাঁটার পর প্রচণ্ড গরমে সবাই প্রায় কাহিল। সিদ্ধান্ত হল ফুট ম্যাসাজ করাতে হবে। তবে ম্যাসাজের খরচ শুনে চোখ তো কপালে। বলে কি! আধ ঘণ্টা ম্যাসাজের জন্য দিতে হবে ৫০ হাজার রুপাইয়া! অবশ্য যখন টাকার হিসেবে আনলাম তখন মাত্র ৩শ’ টাকা। তবে ম্যাসাজের পর চনমনে হয়ে উঠল সবাই।

রাতের খাবার খেলাম ‘হার্ডরক’ ক্যাফেতে। স্থানীয় ব্যান্ডের গান আর নানান পদের খাবার শেষে করতে করতেই আমাদের রাত প্রায় পার হয়ে যায়।

দ্বিতীয় দিন ঘুম থেকে উঠেই সোজা চলে গেলাম হোটেলের ঠিক সম্মুখে সমুদ্র সৈকতে। সকালের ভারত মহাসাগর, নীল আর নীল। তবে এত সকালেও পর্যটকদের কমতি নেই সৈকতে।

কেউ রোদ পোহাচ্ছে আবার কেউ সার্ফিংয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সার্ফিং না জানলেও অসুবিধা নেই, শেখার জন্য রয়েছে প্রশিক্ষক। খুব কম খরচেই শিখে নেওয়া যায় সার্ফিং। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩ হাজার টাকায় (অবশ্যই কম-বেশি হতে পারে দরদাম করতে হয়) শিখে নিতে পারেন সমুদ্রে বিশাল জলরাশির সঙ্গে কীভাবে সখ্য গড়ে তুলতে হয়।

নীল ঢেউয়ে ছুটে চলার এক অনন্য কৌশল। তবে শারীরিক ফিটনেস ভালো থাকলেই এ সাহস আপনি করতে পারেন। স্থানীয় যারা সার্ফিং করছে তাদের বেশিরভাগকেই দেখা গেল মেদহীন সুঠাম শরীরের।

বালিতে বেশিরভাগ পর্যটক অস্ট্রেলিয়ার। তবে জাপানি, ভারত ও অন্যান্য দেশের পর্যটকরাও তুলনামূলকভাবে কম নয়।

সিটিট্যুরের জন্য রয়েছে নানা অফার। দরদাম করে খুব সহজেই সিটি ট্যুরে যাওয়া যায়। গ্রুপে হলে খরচ কম হয়। তবে যারা একা যাবেন তারা বাইক নিয়েও বের হতে পারেন। সিটি ট্যুরে বের হলাম দুপুরের দিকে। পথে পড়লো বালির স্থানীয় শপিংমল ‘আগুন বালি’। এখানের হস্তশিল্পগুলো খুবই চমৎকার এবং দামেও সস্তা।

হোটেল থেকে দেখা।

কুটা থেকে বাসে প্রায় এক ঘণ্টা পথ পেরিয়ে আমরা হাজির হলাম বালির অন্যতম দর্শনীয় স্থান বাতু বলং মন্দির।

দুপুরের খাবার সারলাম মন্দিরের প্রবেশ পথে একটি রেস্তোরাঁয়। একটি ছোট পুকুরের মধ্যে মাচা করে বসার ব্যবস্থা, পায়ের নিচে রঙিন মাছ। নানা ধরনের সি ফুড দিয়ে পার করলাম এক দুপুর।

ঠিক সমুদ্রের মাঝ বরাবর পাথরের পাহাড়ের উপর মন্দির থেকে আবিভূত না হয়ে উপায় নেই। চারদিকে নীল জলরাশি আর পাহাড়। সেখানে প্রায় ঘণ্টাখানেক থেকে আবার চলে গেলাম হোটেলে। তবে এ পথে যাওয়ার সময় চোখে পড়ল কয়েকটি বড় পাহাড়। আমাদের গাইড নোভা জানালো এগুলো সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। যে কোনো সময়ই জেগে উঠতে পারে।

কুটা সৈকত।

এরপর দিন সকালে বালির অন্যতম দর্শনীয় দ্বীপ নুসা লেম্বোগানে যেতে হবে। তাই দ্রুত বিছানায় যেত হল। ট্যুর প্যাকেজ প্রায় ১০০ ডলার। সকাল ৮টার দিকে হোটেল থেকে রওনা হওয়ার পর বিশাল জাহাজে করে সমুদ্রের পাড়ি দিলাম প্রায় এক ঘণ্টা।

তিন তলার এই জাহাজ চলছে খুব দ্রুত। সঙ্গে ঢেউয়ের দুলুনিতে বমি আসা স্বাভাবিক। অনেকের অবস্থাই কাহিল হয়ে পড়লো। দ্বীপ থেকে প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে থাকলো আমাদের জাহাজ। নামলাম জাহাজ সংলগ্ন ডকে। স্পিডবোট করে নিয়ে যাবে ভিলেজট্যুরে। অনেকেই নাট সিঁটকালো গ্রাম দেখতে কি এত কষ্ট করলাম!

যা থাকে কপালে, সমুদ্রে স্পিডবোটে করে রওনা দিলাম দ্বীপে। পৌঁছানোর পর ছাদ খোলা জিপে করে চললাম গ্রামের ভেতর দিয়ে, প্রায় ২০ মিনিট পর থামলাম একটি ফাঁকা মাঠের ধারে। নেমে তো আরও হতাশ। এখানে কেনো? প্রশ্ন সবার।

তাই এক রকম মন খারাপ করে স্থানীয় মুদ্রা ৩০ হাজার রুপি করে ডাব কিনলাম। তবে এদেশের ডাব আকারে এত বড় যে একা খেয়ে শেষ করা দায়।

কুটা সৈকত।

সামনে একটু এগিয়ে যেতেই অবাক করা দৃশ্য। আমরা দাঁড়িয়ে আছি সমুদ্র থেকে প্রায় ১০০ ফুট ওপরে।  বিশাল বিশাল ঢেউ ফুঁসে আসছে পাহাড়ে গায়ে। যেন তীব্র আক্রোশে আঘাত হানছে পাহাড়ে। সেই আঘাতে হাজার বছর ধরে ক্ষত হচ্ছে পাহাড়ের গায়ে। আধ ঘণ্টার মতো সময় কাটিয়ে আমরা ফিরে আসলাম জাহাজে।

জাহাজে দুপুরের খাবার। সঙ্গে স্থানীয় ব্যন্ডের গান চারদিকে নীলের ছড়াছড়ি। খাবারের পর ব্যানানা রাইডিং।

কলার মতো দেখতে বাতাস ভরা বেলুনে চড়লাম আমরা চারজন। একটি স্পিডবোট সেটা টেনে নিয়ে গেল গভীর সমুদ্রে, প্রায় ১০ ফুট উচ্চতার ঢেউয়ের উপর দিয়ে এ রাইডে অবশ্যই সাহস থাকতে হবে, নইলে সমস্যা হতেই পারে।

ব্যানানা রাইডিংয়ের পর জাহাজ সংলগ্ন জেটি থেকে রওনা দিলাম স্কুবা ডাইভিংয়ে। সেখানে প্রয়োজনীয় পোশাক পরে সমুদের নিচের জগতের অংশ হয়ে গেলাম। নানা রংয়ের মাছ আর নীলের রাজ্য। নুসা লেম্বোগান জয় শেষে আমরা সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসলাম হোটেলে।

বাতুবলং

শেষ রাতে সময় কাটলো স্কাই গার্ডেন ক্লাবে। বিশাল এ ক্লাবে তিনটি ফ্লোরে প্রতিটিতেই চলছে বিভিন্ন দেশের লাইভ ব্যান্ডের গান আর সঙ্গে নেচে চলছে বিভিন্ন দেশের পর্যটক। পরদিন সকালে বালিকে বিদায় দিয়ে রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্য।

প্রয়োজনীয় তথ্য

বালিতে তেমন কোনো নিরাপত্তা সমস্যা নেই। তবে অস্ট্রেলিয়ান পর্যটকদের না ঘাটানোই ভালো। মানি একচেইঞ্জ করার সময় বিশেষ সতর্কতা নিতে হবে। ভালো কোনো মানি একচেইঞ্জে গিয়ে বিনিময় করাই ভালো। কারণ রুপিয়ার পরিমাণ বেশি হওয়ায় (১০০ ডলারে প্রায় ১৩ লাখ ৭০ হাজার রুপি) খুচরা দিয়ে সহজেই কম দিয়ে দিতে পারে।

বালিতে শপিং করার জন্য স্থানীয় লোকজ শিল্প ও পোশাক কিনতে পারেন। তবে দামাদামি করতে হবে। যাদের বঙ্গবাজার বা ঢাকা কলেজের সামনে শপিং করার অভিজ্ঞতা আছে তারা খুব সহজেই কিনতে পারবেন নাহলে ঠকবেন।

নুসা লেম্বোগানে’তে লেখক।

তবে ‘আগুন বালি’ নামে শপিং সেন্টারে নির্ধারিত মূল্যে সব ধরনের জিনিসই কিনতে পারেন। যেখানে ঠকার সম্ভবনা নেই।

বালিতে যেতে ভিসা বা ভ্রমণের জন্য কাগজপত্র কিছু লাগে না। শুধু পাসপোর্ট আর এয়ার টিকেট সঙ্গে থাকলেই হয়। খুব কম সময়ের জন্য বালি ভ্রমণে না যাওয়াই ভালো। কমপক্ষে পাঁচ দিন না হলে এ ভ্রমণে আফসোস থেকে যাবে।

কারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এ ভূমিতে প্রকৃতি উপভোগের শেষ নেই।