‘কালো’ বলে কইর নাকো হেলা

’জাতের মেয়ে কালো ভালো’ তারপরও আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় মেয়ের গায়ের রং কালো হলেই নানান প্রশ্ন জেগে ওঠে। এসব শুনেও তারা এগিয়ে চলে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে।

আব্দুল্লাহ আলিফবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 March 2018, 08:49 AM
Updated : 8 March 2018, 09:45 AM

“ছোট বেলায় বন্ধু-বান্ধবিরা ছিল বা এমন অনেক ফ্রেন্ডের অভিভাবকরা ছিল যারা আম্মুকে এভাবে বলতো যে মেয়েটার রংটা কালো। তখন থেকেই বুঝতে শিখেছি যে কালো রংটা আসলে খারাপ।”

দুঃখ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন গায়ের রংয়ের কারণে সামাজিকভাবে হেনস্তা আর মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া একজন শিক্ষার্থী ওয়াহিদা জামান সিথি।

তিনি বলেন, “আমি দেখতে ভালো না এ বিষয়টা আমার মাঝে কাজ করা শুরু করেছে যখন আমি বাইরের জগতে বের হওয়া শুরু করেছি, সামাজিকভাবে যখন পরিচিত হতে শিখছি।”

সিঁথি শুধু একা নন, নিজেকে নিয়ে এমন উপলব্ধি শুরু হয় কালো রংয়ের অনেক মেয়েদেরই। যদিও জাতিগতভাবে ও ভৌগলিক অবস্থানের কারণে গায়ের রং কালো দেশের অধিকাংশ মানুষের।

গায়ের রং নিয়ে মানসিক যন্ত্রণার শুরুটা শিশুকাল থেকেই। সদ্য পড়াশোনা শেষ করে সাংবাদিকতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লড়াইয়ে থাকা কামরুন্নার কুইন স্মরণ করছিলেন শিশুকালের অভিজ্ঞতা।

“খুব ছোটবেলায় একবার ভাইয়ার সাথে ঘুরতে বের হলাম। ভাইয়া পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো, আমার ছোট বোন। তার বান্ধবি বলেছে, তোমার বোন? এত কালো কেনো? তখন থেকেই শুরু”, বলছিলেন কুইন।

এরপর থেকে প্রতিনিয়তই ‘কালো‘ বলে বিব্রত হতে হয় তাকে। এমন অভিজ্ঞতা রয়েছে সিঁথিরও।

“আমি আমার বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গেছি। তখন আমাকে দেখে আমার পেছনেই তার ফ্যামিলির একজন মেম্বার তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো যে, এই ‘নিগ্রো’ কালো মেয়েটাকে তুমি কোত্থেকে ফ্রেন্ড বানালে।”

এ ঘটনাগুলো জীবনে চলার পথেও অনেক তরুণীর ওপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

‘আব্বু, আম্মু, ভাইয়ারা সবসময় একটা চিন্তায় থাকে, মেয়ে কালো কীভাবে বিয়ে দেবে। আত্মীয়-স্বজনরা প্রতিনিয়ত বাসায় এসে বলে যে মেয়ে কালো এখন থেকেই পাত্র খোঁজ, বিয়ে দেবে কীভাবে? তো এটা নিয়ে আব্বু-আম্মুরও আসলে খারাপ লাগে, ওই প্রেশারটা (চাপ) আলটিমেটলি (চূড়ান্তভাবে) আমার ওপরই পড়ে”, বলছিলেন কুইন।

কেউ কেউ আবার বন্ধুদের সাথে মিশতে গেলে কিংবা কারও সাথে পরিচিত হতে গেলেও হীনমন্যতায় ভোগেন। 

“খুব কম হলেও এমন সিচ্যুয়েশন ফেইস করতে হয় যে আমি কালো বলে হয়ত আমাকে সেভাবে গুরুত্বটা দেওয়া হচ্ছেনা” মন্তব্য সিঁথির।

 

হেনস্তায় বাড়ে হীনমন্যতা, রং ফর্সা করার প্রসাধনী মাখতে বলেন বাবা-মাও। এ নিয়ে সিঁথির অভিজ্ঞতাটা এমন-

“দেখা গেলো নানু ইন্ডিয়া থেকে আমার জন্য একটা রং ফর্সাকারী ক্রিম নিয়ে চলে আসলো। মা-ও হয়তো মাঝে-মধ্যে বলে এটা ইউজ করো, ওটা ইউজ করো।”

“একটা সুপার শপে বাসার জন্য কিছু কেনাকাটা করতে গেছি। সেলসম্যানরা এসে বলবে আপু আপনার মুখে দাগ আছে, আপনি এই ক্রিমটা ব্যবহার করেন আপনার চেহারা অনেক ব্রাইট হবে। আমি কিন্তু বলিনি ভাইয়্যা আমাকে চেহারা ব্রাইট করার মতো কিছু দেন।”

তবে তিনি রং ফর্সাকারী প্রসাধনী ব্যবহারে আগ্রহী নন। সিথির বক্তব্য, “নিজের চেয়ে গায়ের রং ফর্সা হওয়া নিয়ে বাইরের মানুষের ভাবনাটা বেশি।”

তবে শিক্ষিত নারীদের অনেকেই প্রসাধনী ব্যবহারের পক্ষে না।

কালো মেয়েদের বিয়েও একটি সামাজিক সঙ্কট। সিঁথি বলছিলেন নিজের বিয়ের নিয়ে তার মাকে বাজে মন্তব্য শুনতে হয়েছে।

“এক ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করে বসলেন ভাবী আপনার মেয়েকে বিয়ে দিবেন কেমন করে? মেয়েতো কালো আবার মোটাও।”

এসব কারণে মেয়েদের বাবা-মাও থাকেন উদ্বেগে। তাই মেয়ের গায়ের রং নিয়ে যাতে প্রশ্ন না ওঠে তাই পড়ালেখা শিখিয়ে বিয়ে দিতে চান সিঁথির মা নাজনীন সুলতানা।

তিনি বলেন, “মেয়েকে বলেছি গায়ের রং কালো এত হতাশ হয়ো না। পরিপাটি থাকো, পড়াশোনা করো। শিক্ষিত হতে হবে, সম্মান নিয়ে বাঁচাই বড়ো কথা।”

তবে সিঁথি কিংবা কুইন, এখন আর গায়ের রং আমলে নেন না কেউই। নিজের মেধা ও যোগ্যতা নিয়ে এগিয়ে যেতে চান সামনে।

কুইন বলেন, “আমি সবসময়ই চিন্তা করি যে আমার ক্যারিয়ারটাকে ভালো করবো অনেক। নিজেকে উঁচু পর্যায়ে নিয়ে যাবো তাহলেই মানুষ আমাকে সম্মান করবে: গায়ের রংয়ের জন্য না, আমার মেধার জন্য, আমার ক্যারিয়ারের জন্য।”

তবে আত্মপ্রত্যয়ী সিঁথির প্রশ্ন, “কালো শব্দটাকি খুব ট্যাবু? কালো মানুষ কি খুব অসম্ভব কোন প্রাণী? অন্য গ্রহের কোনো প্রাণী?”