নারীর মর্যাদা রক্ষায় ‘আসল পুরুষ’ হতে চাইলে

সম্প্রতি ‘যৌন হয়রানি’ বিরূদ্ধে সোচ্চার হয়ে বিশ্বের নারীরা #Metoo দিয়ে টুইটার আর ফেইসবুক ভরিয়ে ফেললো। তাদের সঙ্গে ‘গলা মিলিয়ে’ অনেক পুরুষও এই হ্যাশ ট্যাগ ব্যবহার করে মন্তব্য দিয়েছেন। তবে শুধু ‘অনলাইন’য়েই নয়, নারীকে সঠিক মর্যাদা দিতে হলে ব্যক্তি জীবনে পুরুষকেও সচেতন হতে হবে।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Dec 2017, 08:57 AM
Updated : 12 Dec 2017, 09:14 AM

হ্যাঁ, আপনি হয়ত ‘আসল পুরুষ’- বাসে সংরক্ষিত ৯টি সিট বাদ দিয়ে বসেন। এসব নিয়ে তর্ক করে চায়ের কাপে ঝড় তুলেন। তারপরও অফিস, রাস্তা কিংবা বাসায় আরও অনেক কিছুই করার রয়েছে আপনার।

লক্ষ্য করার বিষয় হল কে কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তর্ক করছেন। একজন পুরুষ কি নারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিংবা নারী কি একজন পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমস্যাটিকে দেখতে পারছে?

এসব বিষয় নিয়ে জীবনযাপন-বিষয়ক একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন অবলম্বনে বেশ কয়েকটি লক্ষণীয় বিষয় এখানে তুলে ধরা হল। যা আয়ত্তে আনতে পারলে নারীর প্রতি ‘অনেক’ পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন করা সম্ভব হবে।

প্রতিবাদ করা

নারী সহকর্মীর অবর্তমানে অন্যান্য পুরুষ সহকর্মীরা যদি অবমূল্যায়ন বা হেয় করে কথা বলতে শুনলে, আপনি পুরুষ হিসেবে অন্তত সেই আলোচনায় অংশ না নিয়ে বলতে পারেন, “এটা ঠিক না, এভাবে ‘গাধা’র মতো কথা বলো না”।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে না পারলেও কমপক্ষে অন্যায়কারীকে চোখে আঙুল দিয়ে তার অন্যায়টি দেখিয়ে দেওয়ার সৎসাহস তৈরি করতে হবে।

মতামত গুরুত্ব দেওয়া

অফিসের মিটিংয়ে কোনো নারী সহকর্মীর দেওয়া পরামর্শ সঠিক মনে হলে বলুন ‘তার কথায় যুক্তি আছে’। নিজের এখতিয়ার অনুযায়ী নারীর মতকে বিবেচনায় আসার সুযোগ করে দিতে পারেন এভাবে।

পরিচয় করানো

কর্মক্ষেত্রে নারী সহকর্মীকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় তাকে তার পদমর্যাদা দিয়ে উপস্থাপন করতে হবে। ওয়াশিংটন পোস্ট এবিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলে, “ডাক্তারদের সম্মেলনে ৭২ শতাংশ পুরুষ ডাক্তারকে পরিচয় করানো হয় ডাক্তার অমুক বলে। অপরদিকে নারী ডাক্তারদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটি মাত্র ৪২ শতাংশ।”

পুরুষকে পরিচয় করিয়ে দিতে তার কাজ বা পদবির কথা উল্লেখ করা হলেও নারীদের ক্ষেত্রে সেটা খুবই কম করা হয়। তাই এখন থেকে একজন নারী বন্ধুর সঙ্গে অন্য কাউকে পরিচয় করিয়ে দিতে...তার কাজের কথাও উল্লেখ করুন, যেমনটি করে থাকেন পুরুষ বন্ধুটির জন্য।

আর নারী সহকর্মীকে কোথাও পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে সুন্দরী স্মার্ট বলা বাদ দিন। এগুলো তাকে অনেক অর্থেই নিচু করে দেখানো হয়। বরং তার কাজের পরিচয়েই পরিচয় দিতে অভ্যস্ত হন।

নারী কর্মীর কাজের প্রশংসা করুন, তার সৌন্দর্যের প্রশংসা অফিসের পরিবেশে একেবারেই অযৌক্তিক।

যৌনউত্তেজক বাজে কথা এড়ান: তর্ক-বিতর্ক হতেই পারে, উঠতে পারে রাগ, তাই বলে বকাঝকা দিতে গিয়ে নারীকে অসম্মান করে যেসব গালি আছে সেগুলো বলা বাদ দিন। বুঝতেই তো পারছেন কোন ‘গালাগালি’র কথা এখানে বলা হচ্ছে।

নারীবাদীদের অনুসরণ

একজন নারীবাদীর মন্তব্যে উঠে আসা সমস্যাগুলো হয়ত আপনার কাছে বাড়াবাড়ি ধরনের মনে হতে পারে। তবে তার মন্তব্যে রেগে কিংবা হেসে উড়িয়ে দেওয়ার আগে নিজেকে একজন ভুক্তভোগী নারীর পরিস্থিতিতে রেখে সমস্যাগুলো সম্পর্কে চিন্তা করুন। নারীর সমস্যা গভীরতা মাপার আগে নিজের পুরুষাসুলভ চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে এসে নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করুন।

এমন কিছু করুন যা প্রচলিত অর্থে নারীর কাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত: ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া কিংবা বিছনা করা- প্রচলিত অর্থে মেয়েদের কাজ বোঝলেও, বরং ভাবতে শিখুন কাজের ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ে নাই। তাই এই ধরনের কাজগুলো নিজেই করুন অথবা ভাগাভাগি করে নিন।

মেয়ে শিশুকে আলাদা বিবেচনা করার দরকার নেই: হতে পারে আপনার কন্যা সন্তানের সুন্দর মুখ বা চুলের ঝুঁটি নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসেন। তার সঙ্গে সেটা নিয়ে গল্পও করেন। তবে কোনো ছেলেশিশুর সামনে এরকম করলে বা সবসময় এরকম আলাপ শিশু মনে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলতে পারে- সৌন্দর্যটাই আগে, পরে অন্য কিছু।

বরং কন্যাশিশুর সৌন্দর্যের কথা পরে বলে অন্যান্য আলাপ করুন। বলতে পারেন ‘বাহ! এই কাজটা তো বেশ হয়েছে’, ‘এখন কী বই পড়ছো’ বা ‘স্কুলে কোন সময়টা বেশি ভালোলাগে’।

ঘরেও অনুশীলন

নারীর মূল্যায়ন শুধু কর্মক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, সঠিক মূল্যায়ন আপনার সহধর্মীনিরও প্রাপ্য। তাই সারাদিন আপনার গিন্নি ঘরের যে কাজগুলোতে ব্যস্ত থাকে সেগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। ঘর পরিষ্কার, রান্না করা, সন্তানের লালনপালন ইত্যাদি অসংখ্য কাজ করে। মাস গেলে বেতন পাওয়া যায় না ঠিক, তবে পরিশ্রম কিন্তু হয়। আবার স্ত্রীও যদি চাকরিজীবী হয়, তবে আপনি যতটুকু ক্লান্ত, আপনার স্ত্রীও ততোটাই ক্লান্ত। তাই ঘরের কাজের পুরো দায়িত্ব তার উপর ছেড়ে দেওয়াটা অবশ্যই অন্যায়।

নারীর মূল্যায়ন করার কথা মনে রাখতে হবে বিছানাতেও। সারাদিনের খাটুনির পর আপনি হয়ত ঘনিষ্ঠ হতে চাচ্ছেন কিন্তু আপনার স্ত্রী আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এমতাবস্থায় আপনার ইচ্ছাপূরনের ভার জোর করে স্ত্রী উপর চাপিয়ে দেওয়া উচিত হবে না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সময়টুকু দুজনের জন্যই সুখকর হওয়াও জরুরি।

আপনার ছেলে সন্তানকে নারীর মূল্যায়ন করা শেখাতে পারেন শৈশবেই। ছেলে সন্তানকে পুতুল খেলতে দেখে আপনি যদি বলেন, “ছ্বি বাবা, পুতুল তো মেয়েরা খেলে”, তবে পুরো নারীত্ব বিষয়টিকেই সে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখতে শিখবে। তাই আপনার ছেলে সন্তানের পুতুল খেলাকে খেলা হিসেবে দেখতে হবে, মেয়েলি বিষয় হিসেবে নয়।

সাবধানতা

অন্ধকারে নির্জন রাস্তায় কোনো নারীকে একা হেঁটে যেতে দেখলে তার পেছনে না হেঁটে রাস্তার অপর পাশে চলে যেতে পারেন। এতে আপনার হয়ত কয়েক কদম বেশি হাঁটতে হবে, তবে ‘কেউ মনে হয় অনুসরণ করছে’ এই ভয়ংকর আতঙ্ক থেকে বেঁচে যাবে ওই নারী।

নারীর সমস্যা যদি একান্তই বুঝতে না পারেন, তবে সমস্যাটা নিরপেক্ষ মনোভাব নিয়ে শুনুন। আপনি একা পুরো সমাজকে বদলে ফেলতে পারবেন না, তবে সমস্যা শোনার মাধ্যমে যদি একজন নারীকে সামান্য মানসিক স্বস্তি দিতে পারেন তাই বা কম কি!

ছবি: রয়টার্স।

আরও পড়ুন