প্রাচীন বটবৃক্ষে একদিন

ঝিনাইদহের বেথুলি গ্রামের তিনশ বছরের পুরানো বটবৃক্ষটি ঘিরে রয়েছে নানান উপকথা। প্রকৃতি এই অবাক শিল্প উপভোগ করার পাশাপাশি গল্প শুনেও আনন্দ পাওয়া যায়।

ফারুখ আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Dec 2017, 12:17 PM
Updated : 6 Dec 2017, 12:27 PM

বেথুলি হলেও মল্লিকপুর বা মল্লিক বাজার নামেই বেশি পরিচিত। অনেকে আবার সুইতলা বলে ডাকেন। বেথুলি গ্রাম বহু আগে কুমার সম্প্রদায়ের বসতির জন্য বিখ্যাত ছিল।

সেই সময় কুমার সম্প্রদায়ের লোকেরা পাতকুয়া ব্যবহার করতো, সেন বংশীয় কুমার পরিবারের কোনো একজনের পাত কুয়োর উপর একদিন একটি গাছ জন্মে। সে বহু আগের কথা, কারও কারও মতে প্রায় ৩শ’ বছর আগের গল্প হবে, আবার কেউ কেউ একটু আগ বাড়িয়ে ঘটনার শুরু প্রায় ৫০০ বছর আগের কথা বলে থাকেন।

দীর্ঘ ৩০০ বছর সেও কম না (মতান্তরে পাঁচশ), এত বছর আগে এখানে যে গাছটি জন্মে, ডালপালায় আভাস দেয় সেটি একটি বটগাছ। কুমার পরিবারের কেউ সে বটগাছটির যত্ন করেছিল কিনা কেউ জানে না।

যেহেতু বট গাছ সেহেতু অযত্নে বা অবহেলা হলেও দিন দিন বেড়ে ওঠে। গাছটি ডালপালা ছড়াতে থাকে আর তার বিস্তৃতি বাড়তে থাকে। তারপর একদিন গাছটি ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়।

বর্তমানে বেথুলি গ্রামের প্রায় ১১ একর জায়গা নিয়ে বটবৃক্ষটির অবস্থান, যার উচ্চতা প্রায় আড়াইশ থেকে ৩শ’ ফুট।

শুরুতেই বলেছি ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ উপজেলার বেথুলি গ্রামের গল্প এটি। ইউনিয়নের নাম মালিয়ট। সুইতলা, মল্লিকপুর বা বেথুলি এই তিন নামেই এলাকাটি পরিচিতি।

যার জন্য অনেকেই এলাকার নাম নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি করে থাকেন, বিভ্রান্ত হন। এলাকার পরিচিতি নিয়ে জটিলতা বা বিভ্রান্তি যাই থাকুক, বটগাছটি নিয়ে কোনো জটিলতা নেই।

গাছটি একটি বটবৃক্ষই বটে, শুধু তাই নয়, বিবিসি জরিপের পর ১৯৮৪ সালে গাছটিকে এশিয়া মহাদেশের সর্ব বৃহত্তম বটবৃক্ষের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এর আগ পর্যন্ত কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনের একটি বট গাছ এই মর্যাদার আসিনে ছিল।

যাকে নিয়ে এত গল্প, এতসব কথন বা রচনা, সেই বটগাছটি দেখার জন্য একদিন ঝিনাইদহের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাঁড়লাম।

আমাদের যাত্রা শুরু হয় কমলাপুর স্টেশন থেকে। বাহনের নাম চিত্রা, যশোর হয়ে খুলনা যাবে ট্রেনটি।

ভোর চারটায় আমরা যশোরের ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর স্টেশনে নামি, এটা একটা উপজেলা। আমাদের গন্তব্য আগমুণ্ডিয়ার রায়পুরা গ্রামের হাঙ্গার প্রজেক্ট এর বাংলো। হাঙ্গার প্রজেক্টের বাংলোটি ঝিনাইদহে আমাদের আস্তানা বলা যায়। এখানে থেকেই আমরা ঝিনাইদহ ঘুরে বেড়াবো, যাব তিনশ বছরের পুরাতন বটবৃক্ষ দেখতে।

সকাল সকাল ওঠার পরিকল্পনা থাকলেও সেদিন আমরা আয়েশ করে ঘুমিয়ে সকাল নয়টায় বিছনা ছাড়ি। সকালের নাস্তা সেরে আগমুন্ডিয়ার পথে নামি। মেঠোপথে পা রাখতেই শরীরে কেমন শিহরণ খেলে যায়। চারিদিকে পাখিদের কলতান। আহা কতদিন এমন মেঠো হাঁটা হয় না, ভাসা হয় না এমন সুরের ঝরনায়।

আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের জন্য নির্ধারিত মাইক্রোবাসে। এর পরের পনের মিনিট পর বিরতী। জায়গার নাম বারোবাজার। এখানে রান্না করা খাবারের দোকান নেই। ছোট ছোট দোকান রয়েছে চা বিক্রির জন্য। কলা বিক্রি হয় সব দোকানে। খেজুর গাছের প্রাচুর্য আর সবজি খেত চারপাশে। আমার দেশের গ্রাম বাংলা বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই।

বারোবাজারে চা পান শেষে ১২ কিলোর মতো সরু পথ পার হয়ে চলে আসি বেথুলি গ্রামে।

শুরুতেই বলেছি বেথুলি- সুইতলা ও মল্লিকপুর নামেও পরিচিত। আমাদের সামনে এখন স্মারক বটবৃক্ষ লেখা তিনশ বছর বয়স্ক বটবৃক্ষের কাছে যাওয়ার মূল ফটক, সে ফটক পার হয়ে সবাই ভেতরে প্রবেশ করি। হাদিরাতুল তালুকদারসহ তুষার জামান ভাই, বাবুভাইরা ফটকের কাছে ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন!

আমাদের চারিপাশে বটগাছ। ছায়াঘেরা শীতল পরিবেশে চারিপাশে। ডানেবামে সামনে পেছনে যেদিকে তাকাই বট ছাড়া কিছু নেই। ঘুরছি দেখছি আর ভাবছি কী বিশাল বটবৃক্ষ। যার দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যে আমরা তো বটেই যে কেউ মোহিত হবেন।

শুক্রবার ছুটির দিন বিধায় দর্শনার্থীও কম না, বনভোজনের দলও আছে। এভাবে এমন যায়গায় বনভোজন বেমানান। অনেককেই বানরের মতো গাছে ঝুলতে দেখে খটকা লাগে, এভাবে অরক্ষিত থাকলে তো গাছের ১২টা বেজে যাবে। ভাবতে ভাবতে দেখি সেই ১২টা বাজানোয় সামিল আমার সঙ্গীরাও!

এক জায়গায় সতর্কিকরণ বিজ্ঞপ্তি দেখলাম। বনবিভাগের দেওয়া স্মৃতিফলকও রয়েছে। যেখানে লেখা এশিয়ার প্রাচীন ও বৃহত্তম বটবৃক্ষ সম্পর্কে লেখা।

অনেক গাছের গোড়ায় পূজার সামগ্রি দেখে বোঝাই যায়, বটবৃক্ষ নিয়ে শোনা গল্প বা মিথ বিশ্বাসী লোকের সংখ্যা কম না। প্রায় দেড় ঘণ্টা ছিলাম আমরা প্রাচীন বটবৃক্ষের সান্নিধ্যে। আদি এবং অকৃত্রিম শিল্পকর্ম যাকে বোঝায়, এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহত্তম বটবৃক্ষটি ঠিক তাই।

আপনিও চলে যেতে পারেন, থাকতে পারেন কিছু সময় বটবৃক্ষটির সান্নিধ্যে এবং ফিরতি পথ ধরার সময় বেথুলি বাজারে চা নাস্তা খেয়ে নিতে পারেন।

শুনতে পারেন স্থানীয় বা দোকানদারের কাছে বটবৃক্ষ নিয়ে মজার মজার সব গল্প। একটা গল্প হল এরকম- একবার গাছ কাটতে গিয়ে কুদরত উল্লাহ নামের একজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। কুদরত উল্লাহর স্ত্রী গাছ ধরে কান্নাকাটি করে স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনেন। ইত্যাদি!

প্রয়োজনী তথ্য

ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে চেপে চলে যান ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ হয়ে বেথুলি গ্রাম। সেখানেই দেখা পাবেন তিনশ বছরের বেশি বয়সি বটবৃক্ষটির।

প্রাচীন মসজিদের শহর হিসেবেও ঝিনাইদহের দারুণ সুখ্যাতি। বটবৃক্ষ দর্শনের পাশাপাশি পুরো ঝিনাইদহ ঘুরে সবকটা মসজিদও দেখে নিতে পারেন। যাই করেন, একটি কথা মনে রাখবেন এই অঞ্চলে এনজিওদের আস্তানা ছাড়া আবাসিক হোটেল পাবেন না। হয় আপনাকে যশোর শহরের কোনো হোটেলে থাকতে হবে নয় এনজিও বা পরিচিত গ্রামবাসির মাধ্যমে থাকা ও খাবার ব্যবস্থা করতে হবে।

আরেকটা ব্যবস্থা হল, ১৯৯০ সালে প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যায় করে এখানে একটা রেস্ট হাউজ নির্মাণ করা হয়েছে, আগে থেকে অনুমতি নিতে পারলে এখানেও রাত্রিযাপণ করতে পারবেন।

ব্যবস্থা যাই হোক চলে যান বটবৃক্ষের কাছে, ভালোলাগা ১৬ আনা!

ছবি: লেখক।

আরও পড়ুন