গাজী, কালু, চম্পাবতী’র সঙ্গে একদিন

যাদের আধ্যাত্মিক প্রভাবে নাকি প্রাচীনকালে বাঘ-কুমির একঘাটে জল পান করত, সেই গাজী, কালু, চম্পাবতী’র মাজার দেখতে চাইলে যেতে হবে ঝিনাইদহ।

ফারুখ আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Nov 2017, 10:19 AM
Updated : 3 Nov 2017, 10:37 AM

সেখানে যাওয়ার আগে বরং একটা পৌরাণিক প্রেমের কাহিনি জেনে নিন।

গাজী, কালু ও চম্পাবতী’র পরিচয় নিয়ে রয়েছে নানান কিংবদন্তি। প্রচলিত আছে বৈরাট নগরের রাজা ছিলেন দরবেশ শাহ সিকান্দর। তারই সন্তান বরখান গাজী। আর কালু ছিলেন রাজা দরবেশ শাহ সিকান্দরের পালিত পুত্র।

কালু আর গাজীর ছিল দারুণ ভাব। যেখানেই গাজী সেখানেই কালু।

যা হোক, ঘটনাচক্রে চম্পাবতীর ভালোবাসার টানে গাজী ছুটে গিয়েছিলেন ছাপাই নগর; বর্তমানে বারোবাজার নামে পরিচিতি।

সামন্ত রাজা রামচন্দ্র ওরফে মুকুট রাজার মেয়ে চম্পাবতী। হিন্দুরাজার মেয়ের প্রেম গাজীকে ভুলিয়ে দিল সে মুসলমান। প্রেমতো আর ধর্ম-জাত মানে না। ছাপাই নগর চলে আসার পর গাজীর সঙ্গে কালুও ছিলেন।

ছাপাই নগরের বলিহর বাওরের তমাল গাছ তলায় গাজী নিয়মিত অপেক্ষা করতেন চম্পাবতীর জন্য। এদিকে মুকুট রাজা তো রেগেমেগে আগুন। গাজীকে শায়েস্তা করতে ভার দিলেন তার সেনাপতিকে। তবে সেনাপতি দক্ষিণা রাও যুদ্ধে পরাজিত হয়ে গাজীর কাছে ইসলাম ধর্মের দীক্ষা নেন। অন্যদিকে রাজা রামচন্দ্র যুদ্ধে পরাজিত হয়ে চলে যান ঝিনাইদহের বাড়িবাথান। পিছু পিছু গাজীও গেলেন। সঙ্গী হিসেবে এবার কালুর সঙ্গে দক্ষিণা রাও-ও আছেন।  

যা হোক, শেষ পর্যন্ত চম্পাবতীকে উদ্ধার করে নিজের বাড়ি নিয়ে আসলেও বিষয়টা রাজা সিকান্দর মেনে নিতে পারলেন না। তিনি গাজীকে তার বাড়িতে উঠতে তো দিলেনই না, বিতাড়িতও করলেন।

প্রেমের জন্য দরবেশ হলেন গাজী। চম্পাবতীকে নিয়ে পথে নামলেন। ঘুরতে ঘুরতে একসময় গাজীর আস্তানা হয় সুন্দরবন এলাকায়। সেখানে তার সঙ্গী যথারীতি কালু ও দক্ষিণা রাও।

বারোবাজারের গাজী, কালু, চম্পাবতী’র মাজারে আরেকটা কবর রয়েছে। ধারণা করা হয়, সে কবরটি দক্ষিণা রাওয়ের।

কাহিনি শেষ। এবার চলুন ঘুরে আসি বারোবাজার থেকে।

প্রথম দিন ভোর ছয়টা। ঝিনাইদহের আগমুন্ডিয়ার রায়পুরা গ্রাম। রুমের জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি শান্ত চারিদিক। আবছা সরের মতো কুয়াশা লেগেছিল পুরো প্রকৃতিতে। মন কুয়াশায় আচ্ছন্ন হতেই কিছু সময় জানলার পাশে দাঁড়িয়ে কুয়াশা উপভোগ করি। তারপর শুরু হয় ডাকাডাকি। এই ডাকাডাকি আর উঠাউঠি করে ঠিক নয়টায় আমরা আগমুন্ডিয়ার পথে নামি।

মিঠে সুরের মেঠো পথ। সেই পথে এখন আমরা হাঁটবো না। মাইক্রোতে চেপে পুরো ঝিনাইদহ ঘুরবো। গোটা শহর তো আর সম্ভব না, একদিনে বিশেষ জায়গাগুলো দেখবো।

শুরতেই প্রজেক্ট অফিসার শাহিন হোসেন আমাদের মৌরি গাছের পাতা ধরিয়ে দিলেন, বললেন, “খেয়ে দেখেন।”

মৌরি আমাদের খুব পরিচিত। অনেকে তাকে মহুরি বলে ডাকেন। তবে গুয়োমুরি বললে সবাই তাকে এক নামে চেনেন। সেই সকালে অনেক উপকারী মৌরির পাতা আমাদের দারুণ আবেশ দিল। তারপরই মাইক্রোতে সওয়ার হওয়া।

খুব সুন্দর প্রকৃতিময় ঝিনাইদহ। পুরো এলাকা গাছ-গাছালিতে ঘেরা। কিছু কিছু জায়গাতে সামাজিক বনায়ন চোখে পড়ল। খেজুর গাছ মানে, অজস্র খেজুর গাছ এখানে। এই গাছের আড়ালে পড়ে গেছে বাকি সব গাছ।

শুরুর অনেকটা পথ আমরা মেঠোপথ ধরেই এগিয়েছি, তারপর পিচ পথে চলা। সবুজের সমারোহ প্রচুর হলেও কাছেপিঠে নদী চোখে পড়ল না। দুই কিলোর মতো চলার পর আমরা ছোট্ট একটা ঝুলন্ত ব্রিজের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় নিচে ছোট্ট খালের মতো দেখে মাইক্রো দাঁড় করালাম।

ব্রিজের গায়ে লেখা বুড়া ভৈরব (মরানদী) নদী। নদীর এই করুণ অবস্থা দেখে আবার সেই প্রশ্ন সামনে চলে এলো- কেনো মরে গেলো নদী!

আধা ঘণ্টার মতো সেতুর উপর দাঁড়িয়ে ছিলাম, তারপর চা পানের বিরতি বারোবাজার এলাকায়। এখানে বাজার আছে। তবে সরকারি অফিস বা তেমন বড় কোনো মোবাইল কোম্পানির শো-রুম চোখে পড়ল না। একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট, নিরিবিলি বলতে যা বোঝায় বারোবাজার ঠিক তাই।

ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু খাবারের দোকান। বেঞ্চিপাতা সাধারণ ব্যবস্থা, খাদ্যতালিকা আরও সাধারণ। লাল চা আর কনডেন্স মিল্কের চায়ের সঙ্গে চাপাকলা ভালোই চললো।

কোনো কোমল পানীয় পাওয়া যায় না দোকনে। তবে ইংরেজিতে ‘গতি’র সঙ্গে মেলানো নামের এনার্জিড্রিংক প্রচুর। এখান থেকেই আরও  দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চলে আসি গাজীকালু’র জায়গায়।

গাজী, কালু, চম্পাবতী’র মাজার রয়েছে এখানে। তাই জায়গার নামকরণও স্বার্থক।

ঝিনাইদহ শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য শুধু নয়; গাজী, কালু, চম্পাবতী’র মাজারের জন্যেও বিখ্যাত। সবাই জুতা-স্যান্ডেল খুলে মাজারের ভেতর প্রবেশের জন্য পা বাড়ালাম।

প্রতিদিন প্রচুর ভক্ত আর দর্শনার্থী আসেন মাজার দর্শনে। সেদিন দর্শনার্থী বলতে আমরাই, বাকিরা ভক্ত। মাজারে প্রবেশের আগে পাশের দোকান থেকে আগরবাতি মোমবাতি আর সুতা কিনে নিচ্ছেন এখানে আসা ভক্ত সকল। মোমবাতি মাজারের খাদেমের হাতে ধরিয়ে দেবে। আর আগরবাতি প্রাচীন অশ্বত্থ গাছের ডালে বেঁধে মানত করে জ্বালিয়ে দেবেন। ভক্তদের বিশ্বাস মানত পূর্ণ হবে। আর সেদিন তারা এসে সেই সুতা খুলে নেবেন।

তবে আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। মানত পূর্ণ না হয় হল, কিন্তু হাজারো সূতার ভিড়ে চিনবে কি করে নিজের সুতাটা। এসব নানান ভাবনা মাথায় নিয়ে সঙ্গে নিয়ে আসা মোমবাতি খাদেমের হাতে ধরিয়ে দিলাম, তারপর পুরো মাজার এলাকা ঘুরে দেখা।

শ্রীরাম রাজার দীঘির দক্ষিণ পাশে পাশাপাশি তিনটা কবর। মাঝের বড় কবরটি গাজীর, পশ্চিমদিকে কালুর কবর আর পূর্বদিকের ছোট কবরটি চম্পাবতীর।

পুরো মাজার ঘিরে ছায়া দিচ্ছে বিশাল একটি বটগাছ। এখানকার ভক্তকূল সেই অশ্বত্থ গাছে একটি ছোট্ট ফোঁকর দেখিয়ে দিলেন। অনেকে সেই ফোঁকরটিকে আরেকটি কবর বলে মানেন। মনে করা হয় সেটা দক্ষিণা রাওয়ের কবর।

গাজী, কালু, চম্পাবতী’র কথা দেশের দক্ষিণাঞ্চলে শোনেনি এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সুন্দরবনের মৎসজীবী হিন্দিুরা এখনও গাজীর নামে পাঠা বলি দেয়! জনশ্রুতি আছে গাজীকালুর আধ্যাত্মিক প্রভাবে বাঘ-কুমিরে একঘাটে জল পান করত।

হিন্দুধর্মবলম্বলীরা বনদূর্গার বদলে যাদের পূজা করে তাদের মধ্যে গাজী-কালু অন্যতম। তাদের নিয়ে অনেক পৌরাণিক গল্প চালু আছে। রয়েছে কবিতা ও পুঁথি।

বারোবাজার গাজী, কালু, চম্পাবতী’র মাজারে এলে এখানের একটি ফলকে ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়াস দেখতে পাবেন। গাজী-কালু শুধু দরবেশ ছিলেন না। ইসলাম ধর্ম প্রচারে তার অবদান অনেক! অথচ সেখানের সনাতন ধর্মাবলম্বীরও সমানভাবে মানেন তাদের। কি সুন্দর সাম্যবাদ।

শ্রীরাম রাজার দীঘিটি এখনও আছে। যে কেউ এখানে এলে গাজী-কালু-চম্পাবতী’র মাজার দর্শনের সঙ্গে সঙ্গে শ্রীরাম রাজার দীঘিটির সৌন্দর্যেও মজবেন।

আমরা পুরো মাজার এলাকা ঘুরে দীঘির পাড়ে গিয়ে বসি। সেখানে গল্পে গল্পে কখন যে দুঘন্টা চলে গেছে বুঝতে পারিনি।

গাজী, কালু, চম্পাবতী মাজারের পথ

ঝিনাইদহের প্রাকৃতিক দৃশ্য যেমন মুগ্ধ করবে তেমনি রোমাঞ্চিত হবেন ঐতিহাসিক স্থাপণা, বিশেষ করে মোগল আমলের মসজিদ ও গাজী, কালু, চম্পাবতী’র মাজার দর্শন করে।

ঢাকা থেকে ঝিনাইদহ সরাসরি বাস পাবেন। তবে ট্রেনে আসলে ভ্রমণ আরামদায়ক হবে।

প্রতিদিন ঢাকার কমলাপুর থেকে খুলনার উদ্দেশ্যে সন্ধ্যা সাতটায় ছেয়ে যায় চিত্রা ট্রেনটি। তবে আপনাকে নামতে হবে কোটচাঁদপুর বা মোবারকগঞ্জ। তবে মোবারকগঞ্জে ট্রেন থামে না। তাই কোটচাঁদটপুরই ভরসা। সময় নিয়ে যাবেন। এখানে খাওয়ার ব্যবস্থা ভালোই তবে থাকার ব্যবস্থা ঝিনাইদহ শহরে করে নিতে হবে। যদিও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এখানে আবাসিক হোটেল দাঁড়িয়ে নেই! তবে দেখবার আছে অনেক কিছু!