‘ফিজিট স্পিনার’- ঘূর্ণিতে কি কমে অস্থিরতা?

‘স্পিনার’টি ঘুরছে। দুই আঙুলে চেপে ধরে থাকা ঘূর্ণির ঘোরে আটকে আছে চোখ। মনোযোগ সেদিকে। মস্তিষ্কের অস্থির চিন্তাগুলো গুলিয়ে যাচ্ছে ঘূর্ণন খেলনায়। আর এই ঘূর্ণিতেই নাকি কমতে থাকে মনের অস্থিরতা। মনকে শান্ত করার এই প্রচলিত হাতিয়ারের নাম ‘ফিজিট স্পিনার’। তবে সত্যি কি সেটা কাজের?

তৃপ্তি গমেজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Oct 2017, 09:28 AM
Updated : 20 Oct 2017, 09:28 AM

এই বছরের সবচেয়ে আলোচিত খেলনা নাম ‘ফিজিট স্পিনার’। বিশ্বে তো অবশ্যই এদেশেও ঘূর্ণির ঘোর লেগেছে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে।

এই ঘূর্ণিযন্ত্র কতটা জনপ্রিয় তা বোঝার জন্য রয়টার্স’য়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান থেকে আন্দাজ করা যায়।

‘এবছর গ্রীষ্মে খেলনা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্তরাষ্ট্রের খেলনা বিক্রির প্রতিষ্ঠান ‘টয়েস ‘আর’ ইউএস’কে বিশেষভাবে তৈরি ১ লাখ ‘ডিসি কমিকস ফিজিট স্পিনার’ সরবরাহ করেছে।’

তবে বছরের আলোচিত এই খেলনার ইতিহাস কিন্তু বেশ কয়েক বছরের পুরানো।

খেলনা-বিষয়ক একটি ওয়েবসাইটের সূত্র মতে, এই ধরনের ঘূর্ণন খেলনার প্রতি মানুষের আকর্ষণ সবসময় ছিল। যেমন ‘ইয়ো ইয়ো’ কিংবা ‘ফ্রিজবি’। তবে ‘ফ্রিজিট স্পিনার’য়ের ধারণাটি প্রথম যিনি নিয়ে আসেন বলে ধারণা করা হয় তার নাম ক্যাথরিন হেটিঙ্গার।

‘দ্য গার্ডিয়ান’, ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’, ‘দ্য নিউ ইয়র্ক পোস্ট’সহ বেশ কয়েকটি খবরের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ওর্লান্ডো’তে বসবাসরত এই মহিলাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

রসায়ন প্রকৌশলী হিসেবে প্রশিক্ষিত ষাটোর্ধ এই নারী শিকাগো ট্রিবিউন’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি একজন ঝালাইমিস্ত্রি। ১৯৯৩ সালে, প্লাস্টিক গলিয়ে একটি গোলাকার ঘূর্ণিয়মান যন্ত্র তৈরি করি। যেটা আঙুলের উপর ঘুরে। আর এটার  পেটেন্ট’য়ের জন্য আমি আবেদন করি।”

১৯৯৭ সালে তিনি এই যন্ত্রের পেটেন্ট’ও লাভ করেন। তারপর নিজের লন্ড্রিরুমে বসে তৈরি করে বিভিন্ন মেলায় বিক্রি করা শুরু করেন।

তবে বার্তাসংস্থা ‘ব্লুমবার্গ নিউজ’য়ের করা একটি প্রতিবেদনে উঠে আসে যে, ক্যাথরিন নয় ‘ফিজিট স্পিনার’য়ের আসল আবিষ্কারক হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্কট ম্যাককোস্কেরি। তিনি ২০১৪ সালে যে বস্তুটি তৈরি করেন সেটার নাম ‘টর্কবার’; যেটা শক্ত ধাতু দিয়ে তৈরি। বর্তমানে প্রচলিত ‘ফিজিট স্পিনার’য়ের সঙ্গে সেটার বেশ মিল রয়েছে। আর এই বিষয়ে ক্যাথরিনও একমত পোষণ করেন।

ইতিহাস যাই হোক। এই ঘূর্ণন খেলনা কি সত্যিই মানুষের অস্থিরতা কমায়? কমালে সেটা কীভাবে?

এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট’য়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন।

“মানসিক চাপ কমাতে ও মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে ফিজেট স্পিনার সাহায্য করতে পারে। দুশ্চিন্তা দূর করা এবং নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই স্পিনার ব্যবহার করা যেতে পারে।”

“স্পিনারটি ছোট, হাতের দুই আঙুলের মাঝেই ঘুরতে পারে। যখন ঘোরা শুরু করে তখন এর দিকে তাকিয়ে থাকা হয়। ফলে চোখ কাজ করে। হাত দিয়ে এবং হাতের মাঝে ঘুরে বলে হাতের মাংসপেশি সক্রিয় হয়। তাছাড়া এটা যখন হাতের মাঝে ঘুরতে থাকে তখন সম্পূর্ণ মনোযোগ এর দিকে থাকে ও মনোযোগ বৃদ্ধি পায়। এতে জগতের অন্য কিছু তখন মাথায় থাকে না অর্থাৎ মনোযোগ নিবিষ্ট হয়। এভাবেই মানসিক চাপ কমাতে ফিজিট স্পিনার কাজ করে।”

তবে অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না বলে জানান এই চিকিৎসক। অতিরিক্ত ব্যবহারে এই স্পিনারের প্রতিও আসক্তি তৈরি হতে পারে। দৈনন্দিন কাজ বাদ দিয়ে কেবল স্পিনারে ব্যস্ত থাকা বা কারণে অকারণে এতে সময় দিলে মানসিক চাপ বাড়াতে পারে।

বিবিসি’তে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘আয়াল্যান্ডের কাস্টমস কর্মকর্তারা প্রায় ২ লাখ ফিজিট স্পিনার জব্দ করেছে। কারণ সেগুলো ছিল বাজে মানের।’

প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, ‘অটিজম’য়ে ভোগা শিশুদের জন্য তৈরি করা হলেও বহুল প্রচালিত এই খেলনা যুক্তরাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ হিসেবে জানানো হয়, এটা শিক্ষার্থীদের অমনোযোগী করে দিচ্ছে।’

এই বিষয়ে ডা. হেলাল বলেন, “তিন বছরের পর থেকে যে কেউ স্পিনার ব্যবহার করতে পারেন। শিশুদের মনোযোগ বৃদ্ধিতে স্পিনার কাজে লাগে ঠিকই। তাই বলে অতিরিক্ত ব্যবহারে শিশুদের পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ কমিয়ে ফেলে। তাছাড়া শিশুদের হাতে সবসময় স্পিনার রাখা হলে তা তাদের অন্যান্য কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।”

“শিশুর সকল মনোযোগ কেবল স্পিনারের দিকে থাকায় অন্য জিনিসের প্রতি আগ্রহ কমে যায়। ফলে শিশুর বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।”

এই চিকিৎসকের মতে, ফিজিট স্পিনারের ব্যবহার পরিমিত ও যৌক্তিক হওয়া উচিত। এর যথোপযুক্ত ব্যবহার যেমন মনোযোগ বাড়ায় ও মানসিক চাপ কমায় অন্যদিকে এর অযৌক্তিক ব্যবহার অস্থিরতা ও মনোযোগ বিচ্যুতির কারণ হতে পারে।

ছবি: রয়টার্স।

আরও পড়ুন