ছোট হরিণার পথে পথে

শুভলং বাজার। আজ হাঁটবার, চারিদিকে নানান রকম পসরা নিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। বিক্রেতা আর ক্রেতার হাঁকডাকে এলাকা মুখরিত। তরমুজ বিক্রি হচ্ছে দেদার। পাশেই এক ফল বিক্রেতা ফল বিক্রি করছেন আর অনেকেই হুমড়ি খেয়ে তার বিক্রি দেখছেন। কেউ কেউ কিনেও নিচ্ছেন।

ফারুখ আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 August 2017, 09:01 AM
Updated : 13 August 2017, 09:02 AM

আমরা কাছে গিয়ে চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে দেখতে থাকলাম সেই ফল। বিক্রেতা আমাদের মুফতে কিছু ফল ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “খায়া দেহেন, ভালো না হইলে নিয়েন না।”

শুভলংয়ের ফল।

টক মিষ্টির অদ্ভুদ স্বাদের ফল, এমন ফল আগে কখনও দেখিনি, খাইনি। কামড়ে খাওয়ার কিছু নেই, ফলটির উপরের চামড়া ছিলে পরে অনেকটা লটকনের মতো চুষে চুষে খেতে হয়। আমরা যার পরনাই সে ফলের স্বাদে মজলাম।

স্থানীয়রা কেউ ফলের নাম বলতে পারলেন না, এই অতৃপ্তিটুকু নিয়েই আমরা শুভলং বাজার থেকে বরকলের দিকে বজরা ভাসালাম।

আমাদের আপাতত গন্তব্য বাঙ্গালটিলা, ভুষণছড়া হয়ে ছোট হরিণা। ঠেগামুখ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী শেষ বাজার হলেও ঠেগামুখ পর্যন্ত যাওয়া যায় না। বা বিজিবির অনুমতি পাওয়া যায় না বিধায় অনেকেই মনে করেন ছোট হরিণাই বাংলাদেশ ভারতের মিজোরাম সীমান্তবর্তী শেষ বাজার বা পাহাড়ি জনপদ।

কর্ণফুলি নদীতে ভেসে আমাদের নয়জনের দল মিল্টন চাকমার বজরায় চেপে সেদিকেই চললাম, ছোট হরিণায়!

ছোট হরিণার পথে পথে।

আমরা যাত্রা শুরু করেছি রাঙামাটির সমতা ঘাট থেকে রির্জাভ বজরায়। শুরুতে হিমেল হাওয়ার প্রলেপ থাকলেও দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড রোদের সঙ্গে প্রচণ্ড তাপদাহ সঙ্গী হয়। সবার মধ্যে অস্থিরতা আর এক অসহণীয় অবস্থা, বৃষ্টির জন্য কি যে হাহাকার!

রোদ পড়ে সঙ্গে নিয়ে আসা সব ধরনের রসদ, এমনকি তরমুজর গরম হয়ে উঠেছে। দুইটা বেজে গেলেও কারও মধ্যে খাবারের জন্য হাহাকার দেখা গেল না। তবু সবাই বরকলের অপেক্ষায় বসে থাকলাম।

ছোট হরিণার পথে পথে।

ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কিছু গ্রাম মানুষজন আর বাঁশের ভেলা দেখে দেখে এক সময় আমাদের ট্রলার বরকল পৌঁছাল। ট্রলার দেখে বরকল বিজিবির সদস্যরা এগিয়ে এসে আমাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর হাফ ছেড়ে বাঁচল। কারণ আমরা একঘণ্টা দেরিতে বরকল পৌঁছেছিলাম। তাই তাদের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করছিল।

বরকল উপজেলার বাজার এটা। আবার এটা বিজিবি চেকপোস্ট বা চৌকিও বটে। সেদিন সাপ্তাহিক ছুটির দিন- শুক্রবার। আমরা বাজার ঘুরে চকোরিয়ার এক পরিবারের ঘরে দুপুরের খাবার খেতে বসলাম। যখন আমরা বরকল ছাড়ি তখন বেলা প্রায় আড়াইটা।

বরকল ছাড়তেই সামনে ছোট্ট একটা দ্বীপের মতো চোখে পড়ল। একটা ছোট্ট বৌদ্ধমন্দির রয়েছে সেখানে। মিল্টন জায়গাটা সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারলো না।

ছোট হরিণার পথে পথে।

সন্ধ্যার আগে আমরা ছোট হরিণা পৌঁছবো, সে লক্ষ্যে মিল্টনকে বজরার গতি বাড়াতে বলি। কর্ণফুলির এই অংশে কোনো বসতি চোখে পড়ল না, শুধু জঙ্গল। আর বাঁকের পর বাঁক পেরিয়ে যাচ্ছি।

রোদ পড়ে এলে আমরাও বজরার ছাদে চড়ে বসি। এবার শুধু দৃশ্য অবলকোন আর অুনভব। সঙ্গে নিজেদের মধ্যে আমোদপ্রমোদ-যার সবটুকুই আনিচ মুন্সি জুগিয়ে যাচ্ছিলো। পাশের জঙ্গল দেখে মিল্টনকে আনিচ মুন্সির প্রশ্ন এ বনের নাম কি?

নির্লিপ্ত ভাবে মিল্টনের জবাব, জানি না। এ জঙ্গলে কি আছে আমরা জানি না।

বড়কল।

হঠাৎ আরমানের ভেতর চঞ্চলতা দেখে আমি ক্যামেরা বের করে গোলুইর কাছে গিয়ে বসতেই দেখি গাছে গাছে সব বিলুপ্তপ্রায় চশমা পরা হনুমান, ডাল থেকে ডালে লাফাচ্ছে আর একে অপরের সঙ্গে খুনসুটি করে চলেছে। আমার ভ্রমণসঙ্গীরা আমাকে আর আরমানকে ছবি তোলার সুযোগ করে দিতে চুপ মেরে গেলো। আর আমরা সমানে ক্লিক করে চললাম।

কিছুক্ষণের মধ্যে জঙ্গলের পাশের গা ছমছমে ভাব শেষ হলে চশমা পরা হনুমানদলের লাফালাফিও আড়াল পরে। এভাবেই আমরা এক সময় চলে আসি বাঙালটিলা।

দুপুরে বরকলবাজারের প্রায় সব খাবারের দোকান বন্ধ ছিল। সে অর্থে সেখানে আমাদের গুরুভোজন হয়নি। বাঙ্গালটিলা বাজার দেখে আমাদের পেট মোচড়ে ওঠে। বজরার পপুলার সেফট ভেঙে যাওয়ায় বাধ্যতাও ছিল এখানে বজরা থামাবার। আমরা বাঙালটিলায় নামি।

বড়কল।

বাঙালটিলায় সত্যি সত্যি বাঙালিদের বসবাস। তবে জানা গেলো বাঙাল টিলা নামটি বাঙালিদের কারণে হয়নি। বহু আগে এখানে বাঙাল নামের এক চাকমা কারবারি ছিল, তার নাম অনুসারেই লোকালয়ের নাম বাঙালটিলা।

আমরা গরম গরম জিলাপির সঙ্গে পেঁয়াজু ফুলুরি আর সিঙ্গারা সঙ্গে লাল চা খাই। কথা হয় স্থানীয় তপন বোসের সঙ্গে দেখা। তার কাছেই জানতে পারি ছোট হরিণা আর ঘন্টা খানেকের পথ, একটু এগিয়ে বাঙালটিলা গ্রাম দেখি।

চশমাপরা হনুমান।

এরপর যখন আমাদের যাত্রা শুরু হয়, তখন সোনারোদ আকাশে ছড়িয়েছে। সন্ধ্যা নামছে পাহাড়ে, কমছে আলো। তাপমাত্রাও কমে এসে ঠাণ্ডা বাতাসের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। কিছুদূর আসতেই একটা গাছে ঝাঁকে ঝাঁকে কালো মাথা কাস্তেচেরা পাখিদের ল্যান্ডিং করতে দেখা যায়। বাহ, কি অভূতপূর্ব দৃশ্য!

এভাবেই কোথাও না থেমে মাঝে মধ্যে নদীতে পানি কম থাকার কারণে বজরা ঠেলে ঠেলে আমরা শেষমেষ ছোট হরিণা পৌঁছি।

বড়কল।

একপাশে পাহাড় মাঝে কর্ণফুলি নদীর তীরবর্তী পাহাড়ি জনপদ ছোট হরিণা এক কথায় অসাধারণ।

ছোট হরিণা বাজারটি খুব বড়সড় নয়। পাঁচমিনিট হাঁটলেই দেখা শেষ হয়ে যায়। দুপুরের পর থেকে প্রায় তিনঘন্টা বাজার বন্ধ থাকে। বিদ্যুৎ বলতে জেনারেটর, সেও সন্ধ্যে ছয়টা থেকে ১০টা পর্যন্ত। বাকি সময় চলে সোলারে। ঠেগামুখের আগে এটাই এই এলাকার শেষ জনবসতি। এরপর বড় হরিণা এবং ঠেগামুখ। কর্ণফুলি নদীর উৎসমুখ ও বাংলাদেশের শেষ জনপদ। আমরা এখানে বিজিবি সদস্যদের অভ্যর্থনা পাই।

ছোট হরিণা।

জোন কমান্ডার ল্যাফটেনেন্ট কর্ণেল ফেরদৌস এর মাধ্যমে আমাদের সবার তথ্য ছোট হরিণা পৌঁছে যাওয়ার কারণে দেরী দেখে এখানেও বিজিবির সদস্যদের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখি। শেষে আমাদের পেয়ে হাসি ও আনন্দ-উল্লাস ও ছিল চোখে পড়ার মতো।

সাজানো গোছানো খুব সুন্দর ছোট হরিণা আর ভূষণ ছড়ার গল্প বলে শেষ করা যাবে না। মনে থাকবে বিজিবির জোন কমান্ডার থেকে শুরু করে নায়েক রহমতসহ প্রতিটি সদস্যের আন্তরিক সহযোগিতার কথা।

ছোট হরিণা।

সবার সঙ্গে মনে থাকবে বিজিবির মেডিক্যাল অফিসার ক্যাপ্টেন সজীবকে এবং অবশ্যই স্থানীয় বাথুয়া রাখাইনকে। বাথুয়াদা’র ঘরের রান্না আর তার আতিথিয়েতার গল্প অনেক!

প্রয়োজনীয় তথ্য

নদী পথই ছোট হরিনা যাওয়ার একমাত্র উপায়। রাঙামাটি থেকে ছোট হরিণা পর্যন্ত লঞ্চ সার্ভিস রয়েছে।

সমতাঘাট থেকে রিজার্ভ ট্রলার ভাড়া নিতে পারেন অথবা লঞ্চে চলে যেতে পারেন। প্রতিদিন রাঙামাটি থেকে ছোট হরিনার উদ্দেশ্যে সকাল সাড়ে সাতটা ও দুপুর বারোটায় লঞ্চ ছেড়ে যায়। সময় ও সাধ্যিমতো যেকোনো পথ বেছে নিয়ে যাত্রা শুরু করুন।

তারপর পাহাড় ও কর্নফুলি সৌন্দর্য গিলে খেতে খেতে চলে যান ছোট হরিণা।

ছোট হরিণায় টাটকা মাছের সঙ্গে দেশি মুরগি অবশ্যই ভালো খাবার বলতে হবে। তবে থাকার ব্যবস্থা ভালো না। রাত্রিযাপনের জন্য ছোট হরিণার বিদ্যুৎ ও টয়লেট বিহীন রেস্ট হাউজের ছোট্ট ঘরই একমাত্র ভরসা।

দুতিনটা খাবারের হোটেল থাকলেও আগে থেকে ফরমায়েশ না দিলে খাবার পাবেন না। তবে খাওয়া-দাওয়ার জন্য বাথুয়া রাখাইনের উপরই ভরষা করেতই পারেন।

ছোট হরিণার পথে পথে।

বাথুয়া রাখাইনের সু-স্বাদু খাবারের সঙ্গে রাত্রিযাপনও তার বাসায় ফ্রি!

ছবি: লেখক।