আমরা কাছে গিয়ে চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে দেখতে থাকলাম সেই ফল। বিক্রেতা আমাদের মুফতে কিছু ফল ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “খায়া দেহেন, ভালো না হইলে নিয়েন না।”
স্থানীয়রা কেউ ফলের নাম বলতে পারলেন না, এই অতৃপ্তিটুকু নিয়েই আমরা শুভলং বাজার থেকে বরকলের দিকে বজরা ভাসালাম।
আমাদের আপাতত গন্তব্য বাঙ্গালটিলা, ভুষণছড়া হয়ে ছোট হরিণা। ঠেগামুখ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী শেষ বাজার হলেও ঠেগামুখ পর্যন্ত যাওয়া যায় না। বা বিজিবির অনুমতি পাওয়া যায় না বিধায় অনেকেই মনে করেন ছোট হরিণাই বাংলাদেশ ভারতের মিজোরাম সীমান্তবর্তী শেষ বাজার বা পাহাড়ি জনপদ।
কর্ণফুলি নদীতে ভেসে আমাদের নয়জনের দল মিল্টন চাকমার বজরায় চেপে সেদিকেই চললাম, ছোট হরিণায়!
রোদ পড়ে সঙ্গে নিয়ে আসা সব ধরনের রসদ, এমনকি তরমুজর গরম হয়ে উঠেছে। দুইটা বেজে গেলেও কারও মধ্যে খাবারের জন্য হাহাকার দেখা গেল না। তবু সবাই বরকলের অপেক্ষায় বসে থাকলাম।
বরকল উপজেলার বাজার এটা। আবার এটা বিজিবি চেকপোস্ট বা চৌকিও বটে। সেদিন সাপ্তাহিক ছুটির দিন- শুক্রবার। আমরা বাজার ঘুরে চকোরিয়ার এক পরিবারের ঘরে দুপুরের খাবার খেতে বসলাম। যখন আমরা বরকল ছাড়ি তখন বেলা প্রায় আড়াইটা।
বরকল ছাড়তেই সামনে ছোট্ট একটা দ্বীপের মতো চোখে পড়ল। একটা ছোট্ট বৌদ্ধমন্দির রয়েছে সেখানে। মিল্টন জায়গাটা সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারলো না।
রোদ পড়ে এলে আমরাও বজরার ছাদে চড়ে বসি। এবার শুধু দৃশ্য অবলকোন আর অুনভব। সঙ্গে নিজেদের মধ্যে আমোদপ্রমোদ-যার সবটুকুই আনিচ মুন্সি জুগিয়ে যাচ্ছিলো। পাশের জঙ্গল দেখে মিল্টনকে আনিচ মুন্সির প্রশ্ন এ বনের নাম কি?
নির্লিপ্ত ভাবে মিল্টনের জবাব, জানি না। এ জঙ্গলে কি আছে আমরা জানি না।
কিছুক্ষণের মধ্যে জঙ্গলের পাশের গা ছমছমে ভাব শেষ হলে চশমা পরা হনুমানদলের লাফালাফিও আড়াল পরে। এভাবেই আমরা এক সময় চলে আসি বাঙালটিলা।
দুপুরে বরকলবাজারের প্রায় সব খাবারের দোকান বন্ধ ছিল। সে অর্থে সেখানে আমাদের গুরুভোজন হয়নি। বাঙ্গালটিলা বাজার দেখে আমাদের পেট মোচড়ে ওঠে। বজরার পপুলার সেফট ভেঙে যাওয়ায় বাধ্যতাও ছিল এখানে বজরা থামাবার। আমরা বাঙালটিলায় নামি।
আমরা গরম গরম জিলাপির সঙ্গে পেঁয়াজু ফুলুরি আর সিঙ্গারা সঙ্গে লাল চা খাই। কথা হয় স্থানীয় তপন বোসের সঙ্গে দেখা। তার কাছেই জানতে পারি ছোট হরিণা আর ঘন্টা খানেকের পথ, একটু এগিয়ে বাঙালটিলা গ্রাম দেখি।
এভাবেই কোথাও না থেমে মাঝে মধ্যে নদীতে পানি কম থাকার কারণে বজরা ঠেলে ঠেলে আমরা শেষমেষ ছোট হরিণা পৌঁছি।
ছোট হরিণা বাজারটি খুব বড়সড় নয়। পাঁচমিনিট হাঁটলেই দেখা শেষ হয়ে যায়। দুপুরের পর থেকে প্রায় তিনঘন্টা বাজার বন্ধ থাকে। বিদ্যুৎ বলতে জেনারেটর, সেও সন্ধ্যে ছয়টা থেকে ১০টা পর্যন্ত। বাকি সময় চলে সোলারে। ঠেগামুখের আগে এটাই এই এলাকার শেষ জনবসতি। এরপর বড় হরিণা এবং ঠেগামুখ। কর্ণফুলি নদীর উৎসমুখ ও বাংলাদেশের শেষ জনপদ। আমরা এখানে বিজিবি সদস্যদের অভ্যর্থনা পাই।
সাজানো গোছানো খুব সুন্দর ছোট হরিণা আর ভূষণ ছড়ার গল্প বলে শেষ করা যাবে না। মনে থাকবে বিজিবির জোন কমান্ডার থেকে শুরু করে নায়েক রহমতসহ প্রতিটি সদস্যের আন্তরিক সহযোগিতার কথা।
প্রয়োজনীয় তথ্য
নদী পথই ছোট হরিনা যাওয়ার একমাত্র উপায়। রাঙামাটি থেকে ছোট হরিণা পর্যন্ত লঞ্চ সার্ভিস রয়েছে।
সমতাঘাট থেকে রিজার্ভ ট্রলার ভাড়া নিতে পারেন অথবা লঞ্চে চলে যেতে পারেন। প্রতিদিন রাঙামাটি থেকে ছোট হরিনার উদ্দেশ্যে সকাল সাড়ে সাতটা ও দুপুর বারোটায় লঞ্চ ছেড়ে যায়। সময় ও সাধ্যিমতো যেকোনো পথ বেছে নিয়ে যাত্রা শুরু করুন।
তারপর পাহাড় ও কর্নফুলি সৌন্দর্য গিলে খেতে খেতে চলে যান ছোট হরিণা।
ছোট হরিণায় টাটকা মাছের সঙ্গে দেশি মুরগি অবশ্যই ভালো খাবার বলতে হবে। তবে থাকার ব্যবস্থা ভালো না। রাত্রিযাপনের জন্য ছোট হরিণার বিদ্যুৎ ও টয়লেট বিহীন রেস্ট হাউজের ছোট্ট ঘরই একমাত্র ভরসা।
দুতিনটা খাবারের হোটেল থাকলেও আগে থেকে ফরমায়েশ না দিলে খাবার পাবেন না। তবে খাওয়া-দাওয়ার জন্য বাথুয়া রাখাইনের উপরই ভরষা করেতই পারেন।
ছবি: লেখক।