২৬০ বর্গমাইল এলাকায় ১,৬৬,০০০ একর জমি। যার পুরোটাই শষ্যক্ষেত্র, জলাশয় আর জনবসতি। যেখানে এক টুকরা জমিও অনাবাদি নয়।
ভাগ্যকূলের মান্দ্রাগাঁয়ে আমার এক বন্ধুর বাড়ি। তাদের কয়েক পাখি জমি আছে আড়িয়াল বিলের হাঁসাড়া অংশে। বন্ধু প্রায়ই বলে, ‘চল তরে জায়গাটা দেহায়া আনি।’
আমাকে বিলে বেড়াতে বা তাদের জমি দেখাতে নিতে কখনও সফল হন নাই তিনি। অথচ ভাগ্যকূলের মান্দ্রাগাঁও থেকে হাঁসাড়ার দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়।
শহরের ফাটক থেকে বিখ্যাত জনপদ শ্রীনগরের হাঁসারা মাত্র ৩৪ কিলোমিটারের পথ। আর বন্ধুর বাড়ি মান্দ্রা থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটারের পথ। এমন পরিস্থিতিতে আমার এক অনুজ একদিন আমাকে ধরে বসল, “চলেন আড়িয়াল বিল থেকে ঘুরে আসি।”
ভোর থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি টাপুরটুপুর। সেই বৃষ্টির মধ্যে আমরা সকাল সাতটায় বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতু বা বাবুবাজারের কাছ থেকে রওনা হয়ে আটটার মধ্যে চলে এলাম হাঁসাড়া বাজার। সেখানে সকালের নাস্তা সেরে আলমপুর। আলমপুর হাঁসাড়ার একটি প্রাচীন গ্রাম। আমরা আড়িয়াল বিলের আলমপুর অংশে আজ ঘুরে বেড়াব। সঙ্গে থেকে আড়িয়ল বিল দেখায় সার্বিক সহযোগিতা করবেন আমাদের শিক্ষক নুরে আলম রানা। যিনি আগে থেকেই ট্রলার ঠিক করে আমাদের অপেক্ষায়। আলমপুর পৌঁছে সেই ট্রলারে চেপে বসতেই যাত্রা শুরু হল।
এরমধ্যে নুরে আলম শুরু করেছেন আলমপুর এলাকা দিয়ে প্রবাহিত ইছামতি নদীর ইতিবৃত্ত- “ভাই এইটা কিন্তু নদী না, এটা হল খাল। কথিত আছে পদ্মায় গ্রাস হওয়া রাজানগরের রাজা রাজ বল্লভ রায় এই খাল খনন করেন। রাজ বল্লভ রায় ছিলেন আলিবর্দিখাঁর সহযোগী। সৈয়দপুর হয়ে খালটি রাজানগর, শেখেরনগর, আলমপুর থেকে দক্ষিণে আড়িয়াল বিলের ওপর দিয়ে শ্রীনগর হয়ে পদ্মায় মিশেছে।”
মগ্ন হয়ে ইতিহাস শুনি আর ভাবি এটা খাল হয় কী করে। এরমধ্যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেছে। বৃষ্টি দেখে যেই ক্যামেরা বাক্স বন্দি করতে যাব তখনই সামনে একটি কচুরিপানার ভেলা দেখে বৃষ্টি উপেক্ষা করে ক্যামেরা বের করে ফটাফট ছবি তুলে চলি। কচুরিপানার এই ধরনের ভেলার সঙ্গে প্রথম পরিচয়।
ইছামতি পারের মানুষেরা এমন ভরাতে বর্ষাকালে এবং বর্ষা চলে গেলে সবজির চাষ করে থাকে। সবজি বলতে লাউ ও কুমড়া।
ইতোমধ্যে আমাদের ট্রলার ইছামতির শাখা নদী বা নুরে আলমের ভাষায় ইছামতি খাল পেছনে ফেলে ছোট্ট এক সরু খালে প্রবেশ করেছে, এরপরই আড়িয়াল বিল।
এভাবেই দুপাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এক সময় আড়িয়াল বিলে পৌঁছাই পরি। বিশাল বিশাল সব ভেসাল আমাদের আড়িয়াল বিলে স্বাগত জানায়। স্বাগত জানায় ছোট্ট দুটি হিজল গাছ। সব চেয়ে আশ্চর্য হচ্ছে আমরা যখন সর্মন খাল দিয়ে আসছিলাম তখনও আশা করিনি সামনে এমন বিশালতা অপেক্ষা করছে।
বিলের চারিপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে নেই। সবুজ আর স্বচ্ছ নীল জলের খেলা। এখানকার জলাশয়ের স্বচ্ছ জল কোথাও গভীর কোথাও অগভীর। নীচে মাটি বা বৈচিত্র্যময় জলজ উদ্ভিদ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সামনে পেছনে কচুরিপানার ঝোঁপ। জলজ উদ্ভিদের মধ্যে কলমিই বেশি চোখে পড়ল।
একজন বয়স্ককে দেখলাম স্থানীয়ভাবে তৈলি ভেলাজাতীয় একটি ডিঙ্গিতে অলস ছুটে চলেছেন।
বিলের যত গভীরে যাচ্ছি সৌন্দর্য যেন ঠিকরে বের হচ্ছে। এমন বিশালতা দেখে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে- এইটা বিল না হাওড়। এত্ত বিশালতা যার, সে হাওড় না হয়ে পারেনা। আমার উত্তেজনা দেখে নুরে আলম মুচকি হাসেন। আমি তার হাসি দেখি আর ছবি তুলি।
আড়িয়াল বিল বিখ্যাত এসব দীঘির জন্য। যার স্থানীয় নাম ডেঙ্গা। পুরো আড়িয়াল বিলে কম হলেও ৫শ’টি ব্যক্তি মালিকানাধীন এমন সব ডেঙ্গা বা দীঘি রয়েছে। মাধবি দীঘি তারমধ্যে অন্যতম। এখানে আমাদের সঙ্গে দেখা হয় দীঘির ইজারাদার মোতালেব ব্যাপারীর।
আমাদের পেয়ে তার মুখ থেকে যেন কথার ফুলঝুরি ছোটে। এই সময় দীঘিতে বেড়ানো নিষেধ। তবু তিনি আমাদের তার কোসা নৌকায় তোলেন। পুরো দীঘি ঘুরে দেখান। তারপর পৌষ মাসে আবার আড়িয়াল বিলে আসার দাওয়াত দিয়ে আমাদের নামিয়ে দেন দীঘির পাড়ে।
আমরা মাধবি দীঘি থেকে সাগরদীঘিতে যাই। যেতে যেতে চোখে পরে একদল কচুরিপানা সংগ্রাহকের। এসব কচুরিপানা আর বাঁশ দিয়ে ঘিরে রাখা হবে পুরো দীঘি বা ডেঙ্গা। যাতে বিলের পানি নেমে গেলেও ডেঙ্গা বা দীঘিতে মাছ থেকে যায়। ডেঙ্গা দেখা শেষে এবার দেখা হয় একঝাঁক সাদা বকের সঙ্গে।
রানা ভাই আরেকটি তথ্য দিলেন, অনেকে মনে করেন এই বর্ষায় আড়িয়াল বিলে এলে প্রচুর পাখি দেখা যাবে। আসলে সে ধারণা ভুল। পানির দেশে বর্ষায় বেড়ানোর মজাই আলাদা। তবু আড়িয়াল বিলে বেড়ানোর সবচেয়ে মোক্ষম সময় পৌষ মাস। তখন পুরো বিলে মাছ ধরা আর ধান তোলার ধুম পড়ে। আর পাখিদের আনাগোনাও বেড়ে যায়।
প্রয়োজনীয় তথ্য
আড়িয়াল বিলে সারা বছর যাওয়া চলে না। এখানে বেড়ানোর প্রকৃত সময় বর্ষাকাল। বর্ষার আড়িয়াল বিল বেড়াতে হলে যেতে হবে শ্রীনগর। সেক্ষেত্রে নিজস্ব বাহন না হলেও চলবে। দলবেঁধে মাওয়া, শ্রীনগর কিংবা সিরাজদিখান বা টঙ্গিবাড়ির যে কোনো বাসে চড়ে বসুন।
বারৈখালি, হাঁসাড়া কিংবা শ্রীনগর নামলেই হবে। শ্রীনগরের বালাসুর বাজারেও নামতে পারেন। এখান থেকে আড়িয়াল বিলে প্রবেশ করতে পারবেন। তিন-চার ঘণ্টার জন্য ট্রলার ভাড়া নেবে ৫শ’ থেকে ৭শ’ টাকা। আর সরাদিনের জন্য ১ হাজার ৫শ’ টাকা। আমরা হাঁসাড়ার প্রাচীন গ্রাম আলমপুর হয়ে আড়িয়াল বিলে গিয়েছিলাম। আমার মনে হয় এই দিকটা দিয়েই আড়িয়াল বিলের মজা বেশি।
যাতায়াত খরচ চলতি পথে ঠিক করে নেবেন। আর যাত্রার শুরুতে হাঁসাড়া বাজারে সকালের নাস্তাটা সেরে নেবেন।
রঞ্জিত মদকের দোকানের পরোটা-ভাজির সে নাস্তার কথা আপনার আড়িয়াল বিলের মতোই গল্পের উপাদান হবে। আরেকটা কথা রঞ্জিত মদকের দোকানের রসগোল্লা খাওয়ার কথা কিন্তু ভুলবেন না। খেয়ে আসবেন, সঙ্গে নিয়েও আসবেন!