কর্ণফুলির উৎসে ঠেগামুখ

কর্নফুলি নদীর উৎসমুখে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী শেষ গ্রাম। স্থানীয়রা বলে থেগামুখ বা থেগাদোর। এখানে চাকমা ও মারমা নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস।

ফারুখ আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 June 2017, 11:51 AM
Updated : 12 June 2017, 12:21 PM

নামটাতেই রয়েছে অদ্ভূত মাদকতা। ভয় আনন্দ রোমাঞ্চ- এসব মিলিয়ে অচেনা ঠেগামুখ ভ্রমণ ছিল স্বপ্নের এক অভিজ্ঞতা।

ঠেগামুখের কথা পত্রিকা পড়ে জেনেছিলাম। সেই সঙ্গে বন্ধুদের মুখে সেখানে কোনো পর্যটকের পদচিহ্ন না পড়ার গল্প। ঠেগামুখে এখন পর্যন্ত কোনো পর্যটকের পদচিহ্ন পড়েনি। শুনে যাওয়ার জন্য পাগল হলাম। শুরু হল পরিকল্পনা।

পরিকল্পনার সঙ্গে সুযোগ হয়ে এল বাংলা নববর্ষের ছুটি। সহযোগিতা পেলাম সাংবাদিক হরি কিশোর চাকমা, বন্ধু গ্লোরি চাকমা এবং কমিউনিটি ম্যানেজার ও গুগল ড্রাইভার জাবেদ সুলতান পিয়াসের।

প্রথমে ১৬ জনের দল ঠিক হলেও অনুমতি না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত নয়জনে গিয়ে ঠেকলো। ১৩ তারিখ রাতে রওনা হলাম। নববর্ষের দিন রাঙামাটিতেই ছিলাম। পুরোদিন গ্লোরি চাকমার আপ্যায়নে কেটেছে। পরদিন ভোরবেলা বের হয়ে চলে আসি সমতাঘাট। এখানে আগে থেকেই ঠিক করা মিল্টন চাকমার ট্রলারে চেপে যখন ঠেগামুখের উদ্দেশ্যে সমতাঘাট ছাড়ি তখন পুব আকাশে মেঘেদের আনাগোনা!

সেদিন মেঘ আর বৃষ্টি হয়ে ঝরেনি। তবে কর্নফুলির সেই সকালটা ছিল দারুণ। সেই সঙ্গে অসম্ভব ভালোলাগার পরশ বুলালো শুভলংয়ের কাছের বৌদ্ধবিহার। পাহাড় ভেদ করে দাঁড়িয়ে থাকা বুদ্ধমূর্তির গায়ে পরা সূর্যালোকে স্বর্ণের মতোই ঝিকিমিকি করছিল।

বুদ্ধমূতির্র এমন অসাধারণ রূপে সঙ্গীরা সবাই আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লে সেখানেই আমাদের প্রথম যাত্রা বিরতি নিলাম, তারপর তো কেবল ছুটে চলার গল্প। এভাবেই শুভলং, বরকল ও বাঙাল টিলা হয়ে ঠিক সন্ধ্যেবেলা ছোট হরিণা পৌঁছি। সীমান্ত এলাকা বলে জোন কমান্ডার ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল ফেরদৌসের পরামর্শে সেদিন আর সামনে না গিয়ে ছোট হরিণাতেই রাত্রিযাপনের সিদ্ধান্ত নেই।

সাজানো গোছানো খুব সুন্দর ছোট হরিণা আর ভূষণ ছড়ার গল্প বলে শেষ করা যাবে না। মনে থাকবে বিজিবির জোন কমান্ডার থেকে শুরু করে নায়েক রহমতসহ প্রতিটি সদস্যের আন্তরিক সহযোগিতার কথা। সবার সঙ্গে মনে থাকবে অবশ্যই বাথুয়া রাখাইনকে। বাথুয়াদা’র ঘরের রান্না আর তার আতিথিয়েতার গল্প অনেক।

ভোর চারটা। তখনও আলো ফোটেনি। অন্ধকার ভেদ করে আমরা বের হয়ে পড়লাম। ট্রলার চলা শুরু করতেই অনুভব করি স্বপ্নের মতো ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে চারিদিক। নিঝুম চারিপাশ। আমাদের ভেতর উত্তেজনা। রাঙামাটি জেলার বরকল উপজেলার গ্রাম ছোট হরিনা থেকে এগিয়ে চলি বড় হরিণার দিকে।

বড় হরিণাতে আমাদের সেদিনের প্রথম যাত্রা বিরতি। সেখানে সীমান্ত চৌকি বা বর্ডার আউটপোস্টে (বিওপি) আমাদের ঠেগামুখ যাত্রা বিষয়ে তথ্য দেওয়া ছিল। আমরা নাম এন্ট্রি করে বিজিবির দেওয়া হালকা চা-নাস্তার আতিথিয়তা নিয়ে তবলাবাগ হয়ে ছুটে চলি ঠেগামুখ পানে।

বড় হরিণা পেরোতে পেরোতে কর্নফুলির উদ্দমতা মাতোয়ারা করেছিল আমাদের। পাশেই সবজু গাছে ভরা পাহাড়। পাহাড়ের ধাপে ধাপে ছোট ছোট বাড়ির মুগ্ধতা। এমন মুগ্ধতার মধ্যে আবানও হুহু ঠাণ্ডা বাতাস আমাদের জড়িয়ে ধরল।

আরাম পেয়েই কিনা সঙ্গীসাথীরা ঘুমের অতলে হারালো। আমি না ঘুমিয়ে সারারাতের ক্লান্তি সরিয়ে ট্রলারের ছাদে গিয়ে বসলাম, একটু পর দেখি আনিচ মুন্সি চলে এসেছেন। তারপর সঙ্গী হলেন সাংবাদিক নওরিন আক্তার এবং চিকিৎসক নাদিয়া।

এভাবেই এক সময় ঘুম সরিয়ে আরমান, লিওন, জিলানী, নাসরিন ও চিকিৎসক নাজমুল হকসহ বাকি সবাই জায়গা করে নিল ট্রলারের ছাদ।

প্রচণ্ড গরমের দিনেও কেমন কুয়াশা ভেজা প্রকৃতি। মধ্য এপ্রিলেও ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব আমাদের আঁকড়ে ধরেছিল।

এভাবেই এক সময় সূর্যের আলোরা পাখা মেলতেই কর্ণফুলি নদী চকচক করে উঠলো। সেই সৌন্দর্য বর্ণনাতীত, কেবল মাত্র হৃদয় দিয়ে উপলব্ধির। পাখির ডাক আলো ফোটার আগে থেকেই ছিল, এবার শুরু হল আমাদের কিচিরমিচির।

দুপাশে পাহাড় আর সে পাহাড়ের ঘন জঙ্গলের মধ্যিখানে প্রবাহিত কর্ণফুলি নদী দিয়ে বড় হরিণা পেছনে ফেলে আমাদের ট্রলার এগিয়ে চলল আরও সামনে বাংলাদেশের শেষ এবং সীমানা গ্রাম ঠেগামুখের দিকে।

এখানে আমাদের ট্রলার ও এলাকার অন্যান্য ট্রলারের সঙ্গে ভারতের পতাকাবাহী ট্রলার চলতে দেখে দারুণ রোমাঞ্চিত আমরা। এখানে খাবার পানির বড্ড অভাব। কতোনা চড়াই পার হয়ে এলাকার মানুষকে দেখেছি খাবার পানি সংগ্রহ করতে কর্ণফুলির তীরে ছুটে এসেছে। খাবার পানি বলতে স্বচ্ছ নদীর পানিই তাদের ভরসা। সেজন্য এলাকায় ডায়রিয়ার প্রকোপ বেশি বলে জানিয়েছিলেন এলাকার একমাত্র ডাক্তার বিজিবির মেডিক্যাল অফিসার ক্যাপ্টেন সজীব।

কর্ণফুলি নদী ও তার আশপাশের সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দুচোখ ভরে দেখতে দেখতে এবং নদীতে পানি কম হওয়ায় একটু পর পর মারো ঠেলা হেইয়ো বলতে বলতে এক সময় পৌঁছে যাই বাংলাদেশে সীমানা প্রাচীরের শেষ গ্রাম থেগাদোর বা ঠেগামুখ।

পুরো থেগামুখ এলাকা অনাবিল মুগ্ধতা নিয়ে দাঁড়িয়ে। সে মুগ্ধতা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল ঠেগামুখ বিওপির প্রবেশমুখের টাইটানিক জাহাজের ডিজাইন। দূর থেকে ঠেগামুখ চৌকিকে মনে হচ্ছিল যেন একটা আস্ত টাইটানিক জাহাজ দাঁড়িয়ে। ধারণার চেয়ে আধা ঘণ্টা দেরিতে ঠেগামুখ পৌঁছায় ঠেগাদোরের জোন কমান্ডার তার উৎকন্ঠার কথা আমাদের জানালেন, তারপর হালকা নাস্তা দিয়ে আপ্যায়িত করলেন। নাস্তা সেরে এবার আমরা বের হই থেগা গ্রাম ঘুরে দেখতে, পাশেই সাজেকের দিকে বয়ে গেছে থেগা নদী।

ঠেগামুখ সম্পর্কে যেমন ভেবেছিলাম তার উল্টোই দেখলাম। দূর্গম এলাকা হলেও সীমান্ত ঘেরা ঠেগামুখ বা থেগাদোর গ্রাম ছিমছাম, বেশ সাজানো গোছানো। এখানে একশ পরিবারের বসবাস। তার মানে সব মিলে এখানে একশটির মতো বাড়ি বা ঘর আছে। আছে একটা চমৎকার বাজার।

এখানকার কারবাড়ি বা গ্রাম প্রধানের নাম পুলিন চাকমা। একমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তখন ক্লাস চলছিল। আমাদের দেখে ছাত্ররা বের হয়ে বিস্ময় চোখে তাকালো, তারপর আমাদের ক্যামেরায় পোজ দেওয়া শুলু করল।

এখানে রাত কাটানোর জায়গাও আছে। আর তা হল এখানকার চাকমা বা মারমাদের ঘর বা রেস্ট হাউজ। খাবার হোটেল আছে, খেতে চাইলে আগে থেকে খাবারের ফরমাশ দিতে হবে।

থাকার জায়গার আশপাশের এলাকার লোকজন বা পাশের ভারতে মিজোরামের ডেমাক্রির অতিথি ছাড়া অন্য আর কারো থাকার সৌভাগ্য হয়নি। খাবার ব্যবস্থাও তাদের জন্যই জানালেন কারবারি পুলিন চাকমা।

সপ্তাহের বুধ ও শুক্রবার এখানে হাঁট বসে। সেদুদিন এলাকা বেশ সরগরম থাকে। হাঁটে আসা ক্রেতার বেশিরভাগই ওপার মিজোরামের। ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরামে বাংলাদেশি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা।

স্কাই টিভির অ্যানটেনা প্রতিটি ঘরে ঘরে। বাজারে আছে ভিডিও ও মোবাইলের দোকান। এখানে বাংলাদেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ না করলেও ভারতের মিজোরামের ডেমাক্রির মোবাইল টাওয়ার একেবারে কাছে হওয়ায় সেই নেটওয়ার্ক দিয়ে তারা ছোট হরিনাসহ বরকল হয়ে রাঙামাটি তথা সারাদেশেই যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে। আমরা পুরো গ্রাম ঘুরে ঠেগামুখ বাজারের বটগাছ তলায় বসে কারবারি পুলিন চাকমার আতিথিয়তা নেই। চা-বিস্কুট খাই, সঙ্গে মিজোরামের কোমল পানীয়। এভাবেই ঠেগামুখে ঘন্টা দুয়েক কাটিয়ে লুসাই পর্বতমালা বা মিজোরামের নীল পাহাড়ের (ব্লু মাউন্টেইন) জলধারার স্রোতের মিলন স্থল কর্নফুলি নদীর উৎসমুখ দেখে ফিরতি পথ ধরি, ঠেগামুখ তখন পেছনে!
প্রয়োজনীয় তথ্য

বর্ষাকাল ঠেগামুখ যাওয়ার মোক্ষম সময়। রাঙামাটি থেকে ছোট হরিণা পর্যন্ত লঞ্চ সার্ভিস রয়েছে। ছোট হরিণা পর্যন্তই সাধারণের চলাচলের অনুমতি, তারপর আর অনুমতি নেই। কারণ এর পরের ছয় কিলোমিটার এলাকার পুরোটাতেই আদিবাসিদের বসবাস এবং সীমান্ত এলাকা। এখানে নদীর অর্ধেক বাংলাদেশের বাকি অর্ধেক ভারতের। নো ম্যানস ল্যান্ড বলতে যা বোঝায় পুরো ছয় কিলোমিটার এলাকা তাই। সুতরাং বড় হরিণা হয়ে ঠেগামুখ যেতে হলে অবশ্যই বিজিবির অনুমতি না নিয়ে যাওয়া যাবে না।

অনুমতির জন্য রাঙামাটির জিএসও (ইন্টেলিজেন্স) ৩০৫ পদাতিক ব্রিগেড বরাবর আবেদন করতে হবে। শুধুমাত্র অনুমতি পেলেই ঠেগামুখ যেতে পারবেন। না হলে নয়। দল যত ছোট হবে ততই সুবিধা ও অনুমতি পাওয়ার সুযোগ থাকবে।

সুতরাং প্রথমে অনুমতি তারপর রাঙামাটি, তারপর সমতাঘাট বা রিজার্ভ বাজার থেকে ছোট হরিণা হয়ে ঠেগামুখ।

যাত্রার সময় পর্যাপ্ত শুকনা খাবার ও পানি সঙ্গে রাখবেন। ঠেগামুখে সাধারণের রাত কাটানোর ব্যবস্থা নেই। অনুমতি সাপেক্ষে ছোট হরিণা থেকে ঠেগামুখ দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসতে হবে।

এক কিংবা দুই রাত ছোট হরিণা থাকতে হবে। রাত কাটানোর জন্য ছোট হরিণার বিদ্যুৎ ও টয়লেটহীন রেস্ট হাউজে ছোট্ট ঘরই একমাত্র ভরসা। দুতিনটা খাবারের হোটেল থাকলেও আগে থেকে বলে না দিলে খাবার পাওয়া যাবে না।

তবে খাওয়া-দাওয়ার জন্য বাথুয়া রাখাইনের উপরই ভরষা করেতই পারেন। খরচ সর্বসাকুল্যে মাথাপিছু ৬ হাজার ৫শ’ টাকা!

ছবি: লেখক।