নামটাতেই রয়েছে অদ্ভূত মাদকতা। ভয় আনন্দ রোমাঞ্চ- এসব মিলিয়ে অচেনা ঠেগামুখ ভ্রমণ ছিল স্বপ্নের এক অভিজ্ঞতা।
ঠেগামুখের কথা পত্রিকা পড়ে জেনেছিলাম। সেই সঙ্গে বন্ধুদের মুখে সেখানে কোনো পর্যটকের পদচিহ্ন না পড়ার গল্প। ঠেগামুখে এখন পর্যন্ত কোনো পর্যটকের পদচিহ্ন পড়েনি। শুনে যাওয়ার জন্য পাগল হলাম। শুরু হল পরিকল্পনা।
পরিকল্পনার সঙ্গে সুযোগ হয়ে এল বাংলা নববর্ষের ছুটি। সহযোগিতা পেলাম সাংবাদিক হরি কিশোর চাকমা, বন্ধু গ্লোরি চাকমা এবং কমিউনিটি ম্যানেজার ও গুগল ড্রাইভার জাবেদ সুলতান পিয়াসের।
প্রথমে ১৬ জনের দল ঠিক হলেও অনুমতি না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত নয়জনে গিয়ে ঠেকলো। ১৩ তারিখ রাতে রওনা হলাম। নববর্ষের দিন রাঙামাটিতেই ছিলাম। পুরোদিন গ্লোরি চাকমার আপ্যায়নে কেটেছে। পরদিন ভোরবেলা বের হয়ে চলে আসি সমতাঘাট। এখানে আগে থেকেই ঠিক করা মিল্টন চাকমার ট্রলারে চেপে যখন ঠেগামুখের উদ্দেশ্যে সমতাঘাট ছাড়ি তখন পুব আকাশে মেঘেদের আনাগোনা!
বুদ্ধমূতির্র এমন অসাধারণ রূপে সঙ্গীরা সবাই আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লে সেখানেই আমাদের প্রথম যাত্রা বিরতি নিলাম, তারপর তো কেবল ছুটে চলার গল্প। এভাবেই শুভলং, বরকল ও বাঙাল টিলা হয়ে ঠিক সন্ধ্যেবেলা ছোট হরিণা পৌঁছি। সীমান্ত এলাকা বলে জোন কমান্ডার ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল ফেরদৌসের পরামর্শে সেদিন আর সামনে না গিয়ে ছোট হরিণাতেই রাত্রিযাপনের সিদ্ধান্ত নেই।
ভোর চারটা। তখনও আলো ফোটেনি। অন্ধকার ভেদ করে আমরা বের হয়ে পড়লাম। ট্রলার চলা শুরু করতেই অনুভব করি স্বপ্নের মতো ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে চারিদিক। নিঝুম চারিপাশ। আমাদের ভেতর উত্তেজনা। রাঙামাটি জেলার বরকল উপজেলার গ্রাম ছোট হরিনা থেকে এগিয়ে চলি বড় হরিণার দিকে।
বড় হরিণা পেরোতে পেরোতে কর্নফুলির উদ্দমতা মাতোয়ারা করেছিল আমাদের। পাশেই সবজু গাছে ভরা পাহাড়। পাহাড়ের ধাপে ধাপে ছোট ছোট বাড়ির মুগ্ধতা। এমন মুগ্ধতার মধ্যে আবানও হুহু ঠাণ্ডা বাতাস আমাদের জড়িয়ে ধরল।
আরাম পেয়েই কিনা সঙ্গীসাথীরা ঘুমের অতলে হারালো। আমি না ঘুমিয়ে সারারাতের ক্লান্তি সরিয়ে ট্রলারের ছাদে গিয়ে বসলাম, একটু পর দেখি আনিচ মুন্সি চলে এসেছেন। তারপর সঙ্গী হলেন সাংবাদিক নওরিন আক্তার এবং চিকিৎসক নাদিয়া।
প্রচণ্ড গরমের দিনেও কেমন কুয়াশা ভেজা প্রকৃতি। মধ্য এপ্রিলেও ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব আমাদের আঁকড়ে ধরেছিল।
এভাবেই এক সময় সূর্যের আলোরা পাখা মেলতেই কর্ণফুলি নদী চকচক করে উঠলো। সেই সৌন্দর্য বর্ণনাতীত, কেবল মাত্র হৃদয় দিয়ে উপলব্ধির। পাখির ডাক আলো ফোটার আগে থেকেই ছিল, এবার শুরু হল আমাদের কিচিরমিচির।
দুপাশে পাহাড় আর সে পাহাড়ের ঘন জঙ্গলের মধ্যিখানে প্রবাহিত কর্ণফুলি নদী দিয়ে বড় হরিণা পেছনে ফেলে আমাদের ট্রলার এগিয়ে চলল আরও সামনে বাংলাদেশের শেষ এবং সীমানা গ্রাম ঠেগামুখের দিকে।
কর্ণফুলি নদী ও তার আশপাশের সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দুচোখ ভরে দেখতে দেখতে এবং নদীতে পানি কম হওয়ায় একটু পর পর মারো ঠেলা হেইয়ো বলতে বলতে এক সময় পৌঁছে যাই বাংলাদেশে সীমানা প্রাচীরের শেষ গ্রাম থেগাদোর বা ঠেগামুখ।
ঠেগামুখ সম্পর্কে যেমন ভেবেছিলাম তার উল্টোই দেখলাম। দূর্গম এলাকা হলেও সীমান্ত ঘেরা ঠেগামুখ বা থেগাদোর গ্রাম ছিমছাম, বেশ সাজানো গোছানো। এখানে একশ পরিবারের বসবাস। তার মানে সব মিলে এখানে একশটির মতো বাড়ি বা ঘর আছে। আছে একটা চমৎকার বাজার।
এখানে রাত কাটানোর জায়গাও আছে। আর তা হল এখানকার চাকমা বা মারমাদের ঘর বা রেস্ট হাউজ। খাবার হোটেল আছে, খেতে চাইলে আগে থেকে খাবারের ফরমাশ দিতে হবে।
সপ্তাহের বুধ ও শুক্রবার এখানে হাঁট বসে। সেদুদিন এলাকা বেশ সরগরম থাকে। হাঁটে আসা ক্রেতার বেশিরভাগই ওপার মিজোরামের। ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরামে বাংলাদেশি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা।
বর্ষাকাল ঠেগামুখ যাওয়ার মোক্ষম সময়। রাঙামাটি থেকে ছোট হরিণা পর্যন্ত লঞ্চ সার্ভিস রয়েছে। ছোট হরিণা পর্যন্তই সাধারণের চলাচলের অনুমতি, তারপর আর অনুমতি নেই। কারণ এর পরের ছয় কিলোমিটার এলাকার পুরোটাতেই আদিবাসিদের বসবাস এবং সীমান্ত এলাকা। এখানে নদীর অর্ধেক বাংলাদেশের বাকি অর্ধেক ভারতের। নো ম্যানস ল্যান্ড বলতে যা বোঝায় পুরো ছয় কিলোমিটার এলাকা তাই। সুতরাং বড় হরিণা হয়ে ঠেগামুখ যেতে হলে অবশ্যই বিজিবির অনুমতি না নিয়ে যাওয়া যাবে না।
সুতরাং প্রথমে অনুমতি তারপর রাঙামাটি, তারপর সমতাঘাট বা রিজার্ভ বাজার থেকে ছোট হরিণা হয়ে ঠেগামুখ।
যাত্রার সময় পর্যাপ্ত শুকনা খাবার ও পানি সঙ্গে রাখবেন। ঠেগামুখে সাধারণের রাত কাটানোর ব্যবস্থা নেই। অনুমতি সাপেক্ষে ছোট হরিণা থেকে ঠেগামুখ দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসতে হবে।
তবে খাওয়া-দাওয়ার জন্য বাথুয়া রাখাইনের উপরই ভরষা করেতই পারেন। খরচ সর্বসাকুল্যে মাথাপিছু ৬ হাজার ৫শ’ টাকা!
ছবি: লেখক।