লাউড় হ্রদ, লাউড়ের টিলা ও লাকমাছড়ার গল্প

মেঘালয় পর্বতমালা আর প্রাচীন লাউড় রাজ্যের শোভা দেখতে হলে যেতে হবে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার ট্যাকেরঘাট।

ফারুখ আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 April 2017, 11:45 AM
Updated : 12 June 2017, 12:26 PM

ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে তাহিরপুর থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম। ফাগুন মাস হলেও হঠাৎ বৃষ্টিতে জানা হয়ে গেলে পাহাড়ি অঞ্চলে বর্ষা শুরু হয়ে গেছে। প্রতি বছরের মতো এ যাত্রাতেও টাঙ্গুয়ার হাওড় ও আশপাশের অঞ্চল ঘোরাফেরা আমাদের।

যাত্রার শুরুর পর থেকেই পুরো জলপথের প্রাকৃতিক শোভা প্রাণ কেড়ে নেয়। হাওড়ের স্বচ্ছ নীলজলের সঙ্গে চারিদিকে হিজল-করচ শোভা ভারি সুন্দর। সারাদিন হাওড় চষে রাতে চলে আসি সীমান্তবর্তী এলাকা ট্যাকেরঘাট।

লাকমাছড়া।

এলাকাটা মজার। যার একদিকে বয়ে চলেছে বাংলাদেশের হাওড় আর অন্য পাশে ভারতের মেঘালয় পর্বতমালা। আরও আছে একটি চুনা পাথর প্রকল্প যা বর্তমানে পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।

রাতে ট্যাকেরঘাটে বন্ধু তৌফিকের কয়লার ডিপোতে রাত্রিযাপন করলাম। চাঁদভরা সে রাতে চাঁদের সঙ্গে আমাদের মিতালি। পাহাড় আর হাওড় পাড়ে আমরা। রাতভর গান চলে, চলে খানাপিনা। যখন ঘুমাতে যাই তখন মসজিদে আজান হচ্ছে।

সেদিন আমাদের দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার উপায় ছিলনা। দশটার মধ্যে খানাদানা তৈরি। চলে আসে মোটরবাইক, আমাদের বাহন। তারপর আবার যাত্রা শুরু। এবার গন্তব্য লাউড়ের হ্রদ।

লাকমাছড়া

প্রাচীন সিলেটের তিনটা ভাগ ছিল। এগুলো হচ্ছে গৌড়, লাউড় আর জয়ন্তিয়া। ধারণা করা হয় সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও আশপাশের এলাকা নিয়ে গঠিত ছিল সেই লাউড় রাজ্য। যার চিহ্ন পুরো এলাকা জুড়ে বিদ্যমান। যদিও দিনে দিনে লাউড় রাজ্যের দূর্গ ও প্রাচীর নানাভাবে ধ্বংস হতে চলেছে।

আমরা প্রাচীন লাউড় রাজ্যের একটা অংশে রয়েছি এখন। লাউড়ের হ্রদ হয়ে চলে যাব লাকমাছড়া। লাউড়ের হ্রদ সমতলে, আর কয়েকশ ফুট ওপরে লাউড়ের টিলা। মেঘালয় পর্বতমালা ঘেঁষা লাউড়ের হ্রদ একবার দেখলে হাজার বার দেখতে ইচ্ছে করবে। এখানে এলে মনে হয় জীবন বোধ হয় কোনো না কোনোভাবে সৃজনশীলতার পরীক্ষা দিয়ে চলেছে। সেজন্য চোখে শোভা পায় সুন্দরের ছটা।

লাকমাছড়া।

নীলাভ জলের লাউড় হ্রদ এক কথায় অসাধারণ। এমন সৌন্দর্যে অভিভূত ভ্রমণসঙ্গী ফারাবী হাফিজ বলে ওঠেন, “কল্পনার চেয়ে বেশি সুন্দর। বিস্ময়কর মানে এতটা বিস্ময়কর যে আমার চোখ সরছে না।”

আসলে আমাদের কারও চোখ সরেনি, তবু সয়ে আসতে হয়। নয়নজুড়ানো লাউড়ের হ্রদ ঘুরে চলে আসি টিলার পাদদেশে, তারপর ওপরে ওঠা।

মেঘালয় পর্বতমালা।

বেশ উঁচু সে টিলার চড়াইপথ। কত রকম চেনা অচেনা গাছ। কত ফুলে ফুলে ভরা। আবার ফুল ছাড়াও অনেক বুনো গাছ। এখানে পাহাড়ি-তুলসি মন ভালো লাগার আবেশে জড়িয়ে নিল। ফুলে ফুলে প্রজাপতিরা কী যে খুঁজে বেড়াচ্ছে কে জানে! এভাবেই আমরা এক সময় লাউড়ের টিলার ওপর চলে আসি।

পুরো টিলাটাই যেন একটা পাথর। আবার বিশাল বিশাল সব গোলাকার পাথর পড়ে আছে পুরো এলাকা জুড়ে। এখান থেকে দৃষ্টি চলে যায় দূর থেকে বহুদূর। মেঘালয় পর্বতমালার একেবারে কাছাকাছি আমরা, এতটা কাছে যেন মনে হয় হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে।

ট্যাকেরঘাটে নতুন শহীদ মিনার।

দলের সবাই রোমাঞ্চিত, সেকি উত্তেজনা। ভাবটা যেন এভারেস্ট জয় করে ফেলেছি। ফটোসেশন পর্ব জমে উঠে, অসাধারণ কিছু মুহূর্ত ফ্রেমে আটকে রাখা বলা চলে।

ফটোসেশন শেষে আমরা টিলার ওপর থেকে নিচে নামা শুরু করি। নামতে নামতে ভ্রমণসঙ্গী রাজীব, রাসেল, বাবর আর তৌফিক ভাই টিলার ওপর মুক্তিযুদ্ধে শহীদের গল্প করেন। এভাবেই এক সময় আমরা লাকমাছড়া চলে আসি। আসলে লাকমাছড়া আমাদের মূল পরিকল্পনায় ছিল না। আমাদের বাইক চালক রাতে বলে রেখেছিলেন এর সৌন্দর্যগাঁথা। চড়াই নয় সহজপথ, না গিয়ে উপায় কী! ভেবেছিলাম দুরের পথ হবে। তবে এতটা কাছে বুঝতে পারিনি।

ট্যাকেরঘাট।

ট্যাকেরঘাট থেকে পাঁচ মিনিটে চলে আসি লাকমাছড়া। সে আরেক ভূস্বর্গ। চোখে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। দেখতে অনেকটা জাফলং’য়ের মতো। আবার মনে হবে ভুলে বিছনাকান্দি চলে এসেছি।

এখানে মেঘালয় পর্বতমালা থেকে প্রবাহিত ঝরানাধারার পানি নেমে ছড়া হয়ে নাম হয়েছে লাকমাছড়া।

ট্যাকেরঘাট।

আমাদের চালক লাকমাছড়ার পানি প্রবাহের ওপর দিয়ে বাইক চালিয়ে মেঘালয় পর্বতমালার দিকে নিয়ে চলে। আশ্চর্য কী নির্বিঘ্নে আমরা পানির ওপর দিয়ে এগিয়ে চলি, তারপর সীমানার প্রান্তে এসে বিরতি। হাতের কাছে টলটলে পানি আর সামনে মেঘালয়।

লাকমাছড়া ঢোকার পর বিস্ময়ের যে ঘোরের শুরু তা কাটতেই চাইছিল না। এবার আরও বিস্ময় নিয়ে দেখি সঙ্গী-সাথী সবাই যার যার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে লাকমাছড়ার জলে, আমিও বাদ যাব কেনো। দেরি না করে ঝাঁপিয়ে পরশ নেই লাকমাছড়ার সু-শীতল জলের!

ট্যাকেরঘাট।

প্রয়োজনীয় তথ্য:
লাউড়ের হ্রদ, টিলা আর লাকমাছড়া দেখতে হলে যেতে হবে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার ট্যাকেরঘাট। অবশ্যই বর্ষাকাল এখানে বেড়ানোর জন্য সবচেয়ে মোক্ষম।

টাঙ্গুয়ার হাওড় ঘুরে ট্যাকেরঘাট। এখানে রাত কাটানোর জন্য কিছু গেস্ট হাউজ আছে। চাইলে দলবেঁধে নৌকাতেও রাত কাটানো যায়। পরের দিন লাউড়ের হ্রদ, টিলা ও লাকমাছড়া দর্শন করতে পারেন। তারপর আবার ট্যাকেরঘাটে  রাত্রিযাপন। তারপর দিন বারিকটিলা ও জাদুকাটা নদী হয়ে ঘরে ফেরা।

ট্যাকেরঘাট।

ঢাকা সুনামগঞ্জ সরাসরি বাস সার্ভিস আছে। ভাড়া ৭২০ টাকার মতো। সেখান থেকে মোটরবাইকে তাহিরপুর, তারপর টাঙ্গুয়ার হাওড় ঘুরে ট্যাকেরঘাট। আর ট্যাকেরঘাট মানেই তো লাউড়ের হ্রদ, লাউড়ের টিলা আর লাকমাছড়ার গল্প।

সঙ্গে বাড়তি পাওনা হবে এখানকার বিশাল সব খনিজ কয়লার ডিপো এবং নতুন গড়ে ওঠা শহীদ মিনারটি!

ট্যাকেরঘাট সীমান্তে কয়লার ডিপো।

সচেতনতা:
একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে, পরিবেশ যাতে হুমকিতে পড়ে এমন কিছু অবশ্যই করা চলবে না। পলিথিন বা প্লাস্টিকের বোতলসহ পরিবেশ বিপণ্ন হয় তেমন কিছুই শুধু লাউড়ের হ্রদ বা কোথাও মনের অজান্তেও ফেলে আসবেন না।

ছবি: লেখক।