মুক্তিযুদ্ধের ঘ্রাণ জড়ানো স্থাপনা

সারাদেশেই মুক্তিযদ্ধের সঙ্গে জড়িত স্থাপনাগুলো ছড়িয়ে রয়েছে। রাজধানীতেও আছে বেশ কিছু সৌধ।

মুস্তাফিজ মামুনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2016, 02:48 AM
Updated : 16 Dec 2016, 02:48 AM

১৬ই ডিসেম্বর কিংবা ২৬শে মার্চ নয়, সারা বছরই এসব জায়গায় ঘুরে বেড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ডুবে থাকা যায়।

মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ: মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত অন্যতম একটি স্থান হল মেহেরপুরের মুজিবনগর। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ আম্রকাননে বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার শপথ গ্রহণ করেছিল। এর আগে ১০ এপ্রিল বাংলাদেশে বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ওইদিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এবং মন্ত্রীসভা শপথ গ্রহণ করেন। এরপরে বৈদ্যনাথতলার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মুজিবনগর।

১৯৭১ সালের এই ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে ১৯৮৭ সালের ১৭ এপ্রিল এখানে উদ্বোধন করা হয় এই স্মৃতিসৌধ। এটির নকশা প্রণয়ন করেন স্থপতি তানভীর করিম।

সৌধটির স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য হল ১৬০ ফুট ব্যাসের গোলাকার স্তম্ভের উপর মূল বেদিটি কেন্দ্র করে ২০ ইঞ্চি পুরু ২৩টি দেয়াল রয়েছে। যা উদীয়মান সূর্যের প্রতিকৃতি ধারণ করে। সৌধের ২৩টি স্তম্ভ ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরের সংগ্রমের প্রতীক। ৩০ লাখ শহীদের স্মৃতিকে স্মরণ করে রাখতে বসানো হয়েছে ৩০ লাখ পাথর।     

অপরাজেয় বাংলা। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

অপরাজেয় বাংলা:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন চত্বরে মুক্তিযুদ্ধের ভাষ্কর্য অপরাজেয় বাংলা। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলার নারী পুরুষের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং বিজয়ের প্রতীক এই ভাস্কর্যের স্থপতি সৈয়দ অব্দুল্লাহ খালিদ।

জাতীয় স্মৃতিসৌধ।ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

জাতীয় স্মৃতিসৌধ:
রাজধানী থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে ঢাকা আরিচা মহাসড়কের পাশে সাভারের নবীনগরে নির্মিত হয়েছে জাতীয় স্মৃতিসৌধ। স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাণ উৎসর্গকারী শহীদদের স্মরণে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম বিজয় দিবসে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই দিন তাঁর সঙ্গে ছিলেন সদ্যপ্রয়াত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান।

১৯৮২ সালে জাতীয় স্মৃতিসৌধের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এর স্থপতি সৈয়দ মঈনুল হোসেন। সৌধটির উচ্চতা ১৫০ফুট। সাতজোড়া ত্রিভুজাকার দেয়ালের মাধ্যমে ছোট থেকে ধাপে ধাপে উঠে গেছে সৌধটি। কংক্রিটের এই সাত জোড়া দেয়ালের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি সময়কাল নির্দেশ করা হয়েছে।

মোট ১০৮ একর উঁচু নিচু টিলা আকৃতির জায়গার উপর বিস্তৃত সবুজ ঘাসের গালিচায় আবৃত দেশি বিদেশি গাছের বাগান আর লাল ইটের রাস্তা সমৃদ্ধ এই সৌধ ভ্রমণকারীদের আকর্ষণ করে।

স্মৃতিসৌধ চত্বরের পাশেই রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের দশটি গণকবর। আর এর চারপাশ ঘিরে রয়েছে কৃত্রিম লেইক। জাতীয় স্মৃতিসৌধে যেতে কোন প্রবেশ মূল্য লাগে না। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এটি খোলা থাকে।

ঢাকার কল্যাণপুর ও গাবতলী থেকে জে আর পরিবহন, মেহেরপুর ডিলাক্স, চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স এবং শ্যামলী পরিবহনের বাস সরাসরি যায় মেহেরপুর ও মুজিবনগর।

জাগ্রত চৌরঙ্গী। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

জাগ্রত চৌরঙ্গী:
ঢাকার অদূরে গাজীপুরে মুক্তিযুদ্ধের এই ভাস্কর্য অবস্থিত। ঢাকা থেকে যাওয়ার পথে শহরের কিছুটা আগে জয়দেবপুর চৌরাস্তার সড়ক দ্বীপে এর অবস্থান। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ গাজীপুরে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘটিত প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামে আত্মদানকারী হরমত আলী ও অন্যান্য শহীদদের স্মরণে ১৯৭১ সালেই নির্মিত হয় হয় এ ভাস্কর্য। স্থপতি শিল্পী আব্দুর রাজ্জাক।

ভাস্কর্যটি অস্ত্র উঁচিয়ে ধরা বলিষ্ঠ এক মুক্তিযোদ্ধার। উচ্চতায় এটি প্রায় একশ ফুট। এর দু’পাশের ফলকে ১৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২০৭ জন শহীদ সৈনিকের নাম খোদাই করা আছে।

শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ, ময়মনসিংহ। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ ময়মনসিংহ:
শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ ময়মনসিংহ ময়মনসিংহে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ। শম্ভুগঞ্জে বাংলাদেশ চীনমৈত্রী সেতুর কাছে অবস্থিত এই স্থাপনা নির্মাণ করেছে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন। এই স্মৃতিসৌধে কেন্দ্রে রয়েছে একটি রাইফেল। রাইফেলের বেয়োনেটে ফুটন্ত শাপলা। ৫০ ফুট উচুঁ স্তম্ভটি দাঁড়িয়ে আছে মশালের আকৃতিতে।

সৌধটির চারদিকের চারটি দেয়ালে রয়েছে চার-রকমের প্রাচীরচিত্র। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান এবং ৭১’র স্বাধীনতা সংগ্রামের বিমূর্ত চিত্র।

বিজয় ৭১, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

বিজয় ৭১:
ময়মনসিংহের কৃষিবিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য বিজয় ৭১। মহান মুক্তি সংগ্রামে বাংলাদেশের সকল শ্রেণির মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মূর্ত প্রতীক এ সৌধ। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রবেশপথেই জয়নুল আবেদিন মিলনায়তনের ঠিক সামনেই এর অবস্থান।

ভাস্কর্যটিতে একজন নারী, একজন কৃষক ও একজন ছাত্র মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি রয়েছে। কৃষক মুক্তিযোদ্ধাটির হাতে বাংলাদেশের পতাকা। পাশেই রাইফেল হাতে বাংলার সংগ্রামী এক নারী দৃঢ় চিত্তে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের দীপ্ত আহ্বান জানাচ্ছেন। তার পাশে একজন যোদ্ধা ছাত্র গ্রেনেড ছোড়ার ভঙ্গিমায় হাতে রাইফেল নিয়ে দণ্ডায়মান।

ভাস্কর্যটির দেয়াল জুড়ে আছে পোড়া মাটিতে খোদাই করা মুক্তিযুদ্ধের নানান ঘটনাবলি। ২০০০ সালে নির্মিত এ ভাস্কর্যের শিল্পী শ্যামল চৌধুরী।

কামালপুর স্মৃতিসৌধ: কামালপুর স্মৃতিসৌধ জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার কামালপুর স্বাস্থকেন্দ্র সংলগ্ন এই স্মৃতিসৌধ অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় কামালপুরে ছিল পাক বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি। ৩১ জুলাই ১১নং সেক্টরের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাটালিয়নের যোদ্ধারা কামালপুর আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মোমতাজ, আহাদুজ্জামান, আবুল কালাম আজাদসহ ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

এসব শহীদদের স্মরণেই এখানে নির্মাণ করা হয়েছে এ স্মৃতিসৌধ।

সাবাশ বাংলাদেশ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

সাবাশ বাংলাদেশ:
মুক্তিযুদ্ধের এই স্মারক ভাস্কর্যটি রাজশাহীতে অবস্থিত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার সবুজ চত্বরের মুক্তাঙ্গনের উত্তরপাশে এটির অবস্থান। রাকসু এবং দেশের ছাত্রজনতার অর্থ সাহায্যে শিল্পী নিতুন কুণ্ড এই ভাস্কর্য বিনা পারিশ্রমিকে নির্মাণ করেন। ১৯৯২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।

প্রায় চল্লিশ বর্গফুট জায়গার উপরে ভাস্কর্যটি নির্মিত। এই স্মৃতিস্তম্ভে আছে দুজন মুক্তিযোদ্ধার মূর্তি। একজন অসম সাহসের প্রতীক, অন্য মুক্তিযোদ্ধার হাত বিজয়ের উল্লাসে মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে পতাকার লাল সূর্যের মাঝে। এ দুইজন মুক্তিযোদ্ধার পেছনে আছে ৩৬ ফুট উঁচু একটি দেয়াল। এর উপরের দিকে আছে একটি শূণ্য বৃত্ত, যা দেখতে অনেকটা সূর্যের মতো।

ভাস্কর্যের নিচে ডান ও বামে দুটি দেয়ালে খোদাই করা আছে যুদ্ধের কিছু চিত্র।

স্মৃতি অম্লান: স্মৃতি অম্লান মহান মুক্তিযুদ্ধের এই স্মৃতিসৌধ রয়েছে রাজশাহী শহরের কেন্দ্রস্থলে। শহরের শহীদ ক্যাপ্টেন বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর সড়কের দ্বীনেভদ্রা এলাকায় এর অবস্থান। ১৯৯১ সালের ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। নির্মাণ করেন স্থপতি রাজিউদ্দিন আহমদ। স্মৃতিসৌধটি বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রতীক।

সৌধে মোট তিনটি স্তম্ভ আছে। প্রতিটি স্তম্ভের গায়ে ২৪টি করে ধাপ, ধাপগুলোর বৈশিষ্ট্য হল ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত আন্দোলনের ক্রমবিবর্তণ ও স্বাধীনতার ফসল। মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের নির্দেশ করা হয়েছে স্তম্ভের গায়ের ৩০টি ছিদ্রের মাধ্যমে। প্রতিটি স্তম্ভে রয়েছে ১০টি করে ছিদ্র। বেদিমূলে রাখা আছে নীল শুভ্র পাথরের আচ্ছাদন, যা দুই লাখ নির্যাতিত নারীর বেদনাময় আর্তির কথা ইঙ্গিত করে।

সৌধের চূড়ায় রয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্রের লালগোলক যা স্বাধীনতা যুদ্ধের উদীয়মান লাল সূর্যের প্রতীক।

বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের সমাধি। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের সমাধি:
বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের সমাধি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার ঐতিহাসিক ছোট সোনা মসজিদের আঙিনায় রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ বিলিয়ে দেওয়া বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের সমাধি। মসজিদ প্রাঙ্গণের ভেতরে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে দুটি কবরের একটিই হল তাঁর। অন্যটি বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর নাজমুল হক-এর।

১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর মহানন্দা নদী অতিক্রম করে শত্রু সৈন্যদের ধ্বংস করার জন্য নবাবগঞ্জের দিকে অগ্রসর হন। ১৪ ডিসেম্বর তিনি শত্রুদের অনেকগুলো দুর্ভেদ্য অবস্থান ধ্বংস করেন। একটি মাত্র শত্রু শিবির ধ্বংস করা বাকি থাকতে মুখোমুখি সংঘর্ষে শত্রুর বুলেটে শহীদ হন তিনি।

১৫ ডিসেম্বর শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মৃতদেহ ঐতিহাসিক সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়। সোনা মসজিদের দক্ষিণ পাশেই আছে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্মৃতিসৌধ।

সোনা মসজিদ থেকে স্থল বন্দরের দিকে কিছুটা সামনে সড়কের পশ্চিম পাশে আছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গণকবর।

অদম্য বাংলা: অদম্য বাংলা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের সামনেই মহান মুক্তিযুদ্ধের চমৎকার একটি ভাস্কর্য ‘অদম্য বাংলা’। ভাস্কর্যটি উচ্চতায় প্রায় ২৩ ফুট। বলিষ্ঠ ও তেজোদীপ্ত চার মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি আছে এ ভাস্কর্যে।

নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সর্বস্তরের বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মূর্ত প্রতীক এটি।

একটি উঁচু বেদির উপরে স্থাপিত হয়েছে মূল ভাস্কর্য। বেদীর চারদিকের পোড়া মাটির প্রাচীরচিত্রে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, জাতীয় চার নেতার প্রতিকৃতি, বধ্যভূমির বর্বরতা ও পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের চিত্র। এটির স্থপতি শিল্পী গোপাল চন্দ্র পাল।

বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ:
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী ধলই চা বাগানে অবস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ধলই সীমান্ত ফাঁড়ির পাশেই এটির অবস্থান। এখানেই ৭১ সালের ২৮ অক্টোবর পাক হানাদর বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন তিনি। সঙ্গী যোদ্ধারা তাঁর লাশ ভারতের আমবাসায় নিয়ে তখন চিরনিদ্রায় শুইয়ে দেন। পরে বাংলাদেশ সরকার তার দেহাবশেষ এনে ঢাকার মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাধিস্থ করেন।

তবে ধলই সীমান্তে নির্মাণ করা হয় একটি স্মৃতিসৌধ। মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল শহর থেকে সৌধটির দূরত্ব প্রায় ২২ কিলোমিটার।

রায়ের বাজার বধ্যভূমি। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

রায়ের বাজার বধ্যভূমি:
ঢাকা শহরের পশ্চিমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধেঁর পাশেই শহীদ বুদ্ধিজীবি স্মৃতিসৌধ অবস্থিত। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দেশের প্রখ্যাত সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করে এই স্থানে পরিত্যক্ত ইটের ভাটার পেছনের জলাশয়ে ফেলে রাখা হয়েছিল।

সেজন্যই এখানে ইটের ভাটার আদলে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। লাল ইট ও সিমেন্টের গাঁথুনির প্রাধান্যই বেশি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় খোলা আকাশের নিচে সৌধের একমাত্র দেয়ালটি নির্ভীক প্রহরীর মতো মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। এর স্থপতি ফরিদ উদ্দীন আহমেদ।

সপ্তাহের সাতদিনই সকাল ৮ থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এটি খোলা থাকে। এখানেও কোনো প্রবেশ ফি লাগে না।

শহীদ বুদ্ধিজীবি স্মৃতিসৌধ। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

শহীদ বুদ্ধিজীবি স্মৃতিসৌধ:
রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে বেড়িবাঁধ সড়ক ধরে গাবতলীরও পরে মিরপুরে অবস্থিত শহীদ বুদ্ধিজীবি স্মৃতিসৌধ। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনী রাজাকার আলবদরদের সহায়তায় এদেশের সূর্যসন্তান বুদ্ধিজীবিদের নির্বিচারে হত্যা করে। তাঁদের স্মরণে ’৭১য়ের ২২ ডিসেম্বর মিরপুরে এ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়।

রায়ের বাজার বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভ। রায়ের বাজার বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভ। জল্লাদখানা বধ্যভূমি: মিরপুর দশ নম্বর থেকে এগারো নম্বরের দিকে কিছুটা গেলেই বেনারসি পল্লীর সড়ক ধরে সোজা পূর্বদিকে শেষ মাথায় জল্লাদখানা বধ্যভূমি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় এ এলাকা ছিল প্রায় জনমানবহীন। হানাদারের দোসররা তাই এ জায়গাই বেছে নেয় মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার জন্য। সেসময়ে এখানে ছিল পরিত্যক্ত একটি পাম্প হাউস। ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে এখানকার দুটি কূপের একটিতে ফেলা হত খণ্ডিত মাথা, অন্যটিতে দেহাবশেষ।

১৯৯৯ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় এর খনন কাজ শুরু হয়। সে সময়ে পরিত্যক্ত পাম্প হাউসের কূপ থেকে ৭০টি মাথার খুলি এবং ৫৩৯২টি হাড় উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়াও উদ্ধার করা হয় মেয়েদের শাড়ি, ফ্রক, ওড়না, অলঙ্কার, জুতা, তসবিসহ শহীদদের ব্যবহার্য নানা জিনিসপত্র।

জল্লাদখানা বধ্যভূমিতে একটি জাদুঘর নির্মাণ করে কিছু নিদর্শন রাখা হয়েছে প্রদর্শনের জন্য। পাম্প হাউসের অভিশপ্ত কূপটি বাঁধাই করে কাচ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে নৃশংসতার চিহ্ন হিসেবে।

আর এখানে 'জীবন অবিনশ্বর' নামে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বর্বর হত্যাকাণ্ডের স্মরণে।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর:
জাতীয় মসজিদ থেকে কিছুটা পশ্চিমে পাঁচ নম্বর সেগুন বাগিচার পুরানো দ্বিতল বাড়িতে অস্থায়ীভাবে বসেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

বাংলাদেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত নিদর্শন ও স্মারকচিহ্নগুলো সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য ১৯৯৬ সনের ২২ মার্চ এ জাদুঘরের যাত্রা।

সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য, প্রমাণাদি, নিদর্শন, রৈকর্ডপত্র ইত্যাদি সংগ্রহ করে এখানে রাখা হয়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ছয়টি গ্যালারি রয়েছে।

প্রথম গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়েছে বাঙালির ঐতিহ্যের পরিচয় এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চিহ্ন। দ্বিতীয় গ্যালারিতে ১৯৪৭ এর দেশভাগ-পরবর্তী পাকিস্তানি শাসন-শোষণের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। তৃতীয় গ্যালিরিতে প্রদর্শিত হয়েছে একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, ২৫ মার্চ সংঘটিত গণহত্যা, স্বাধীনতার ঘোষণা, প্রতিরোধ ও শরণার্থীদের জীবনচিত্র।

স্বাধীনতার সংগ্রাম: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ফুলার রোডের ব্রিটিশ কাউন্সিল ছাড়িয়ে সামান্য দক্ষিণে দৃষ্টি নন্দন ভাস্কর্যের বাগান।

এখানকার ২৫ ফুট উঁচু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের প্রতিকৃতি ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, লালন শাহ, হাসন রাজার মতো অনেক বরেণ্য ব্যক্তির ছোট প্রতিকৃতি রয়েছে।

এছাড়া স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শহীদ নূর হোসেনেরও একটি প্রতিকৃতি আছে এখানে। এগুলোর স্থপতি শামীম সিকদার।

স্বাধীনতা স্তম্ভ। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

স্বাধীনতা স্তম্ভ:
রমনা রেসকোর্স, বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। আমাদের স্বাধীনতার সঙ্গে এ নামটি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তি পেলে তাঁকে এখানেই সংবর্ধনা দেওয়া হয় এবং বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রমনার এই রেসকোর্সের মহাসমাবেশেই বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। দীর্ঘ নয়মাস যুদ্ধের পরে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক সেনারা এখানেই নতি স্বীকার করে। ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বক্তব্য দেন।

সেই ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই গড়ে তোলা হয়েছে স্বাধীনতা স্তম্ভ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী স্মরণীয় করে রাখতে এর আগে ১৯৯৯ সালে এখানে স্থাপন কর হয় ‘শিখা চিরন্তনী’।

প্রায় ৬৭ একর জায়গাজুড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কেন্দ্রস্থলে গড়ে তোলা হয়েছে স্বাধীনতা স্তম্ভ। চারপাশে রয়েছে তিনটি জলাশয়। একপাশে শিখা চিরন্তনী আর স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেন্দ্র করে নির্মিত বিভিন্ন দেয়ালচিত্র।

মূল আকর্ষণ প্রায় ১৫০ ফুট উঁচু একটি গ্লাস টাওয়ার। রাতে এ টাওয়ারের আলোকরশ্মি বহু দূর থেকেও দেখা যায়। স্বাধীনতা স্তম্ভের ভেতরে আছে স্বাধীনতা জাদুঘর। ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও পাক হানাদারদের গণহত্যার নানান নিদর্শন সুরক্ষিত আছে এখানে।

জল্লাদখানা বধ্যভূমি। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

জল্লাদখানা বধ্যভূমি:
মিরপুর দশ নম্বর থেকে এগারো নম্বরের দিকে কিছুটা গেলেই বেনারসি পল্লীর সড়ক ধরে সোজা পূর্বদিকে শেষ মাথায় জল্লাদখানা বধ্যভূমি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় এ এলাকা ছিল প্রায় জনমানবহীন। হানাদারের দোসররা তাই এ জায়গাই বেছে নেয় মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার জন্য। সেসময়ে এখানে ছিল পরিত্যক্ত একটি পাম্প হাউস। ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে এখানকার দুটি কূপের একটিতে ফেলা হত খণ্ডিত মাথা, অন্যটিতে দেহাবশেষ।

১৯৯৯ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় এর খনন কাজ শুরু হয়। সে সময়ে পরিত্যক্ত পাম্প হাউসের কূপ থেকে ৭০টি মাথার খুলি এবং ৫৩৯২টি হাড় উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়াও উদ্ধার করা হয় মেয়েদের শাড়ি, ফ্রক, ওড়না, অলঙ্কার, জুতা, তসবিসহ শহীদদের ব্যবহার্য নানা জিনিসপত্র।

জল্লাদখানা বধ্যভূমিতে একটি জাদুঘর নির্মাণ করে কিছু নিদর্শন রাখা হয়েছে প্রদর্শনের জন্য। পাম্প হাউসের অভিশপ্ত কূপটি বাঁধাই করে কাচ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে নৃশংসতার চিহ্ন হিসেবে।

আর এখানে 'জীবন অবিনশ্বর' নামে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বর্বর হত্যাকাণ্ডের স্মরণে।