পাইলস বা অর্শরোগ

মলদ্বারের রোগ মানেই পাইলস! এটি একটি অত্যন্ত প্রচলিত ভুল ধারণা।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Nov 2016, 10:30 AM
Updated : 1 Nov 2016, 10:30 AM

এই বিষয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন সার্জারি বিশেষজ্ঞ [এমবিবিএস (ডিএমসি), এফসিপিএস (সার্জারি) বিশেষ ট্রেনিং বৃহদন্ত্র ও পায়ুপথ সার্জারি] ডা. মীর রাশেখ আলম অভি।

পাইলস শব্দটির অর্থ পিলার। মেডিকেলের ভাষায় একে হেমোরয়েড বলা হয়ে থাকে। সহজ বাংলায় মলদ্বারের রক্তনালী ফুলে যাওয়াকে পাইলস বলা হয়ে থাকে। তরুণ এবং বৃদ্ধরা সাধারণত পাইলসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন।

৪৫ থেকে ৬৫ বছর বয়স সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। নারী পুরুষ নির্বিশেষে রোগটির বিস্তার দেখা যায়। গবেষণায় দেখা যায় যে বিশ্বে শতকরা চার থেকে পাঁচজন এই রোগে আক্রান্ত।

পাইলস দুই প্রকার- ১. আভ্যন্তরীণ পাইলস। ২. বহিস্থ পাইলস।

আভ্যন্তরীণ পাইলস: মলদ্বারের দুতিন সে.মি. ভেতরের পাইলসকে আভ্যন্তরীণ পাইলস বলা হয়। আভ্যন্তরীণ পাইলসকে তাদের আকার ও আচরণ অনুযায়ী পুনরায় চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে।

শ্রেণি ১- সম্পূর্ণ মলদ্বারের ভেতর থাকে। বাহির থেকে বোঝা যায় না।

শ্রেণি ২- মলদ্বারের ভেতর থাকে। তবে মলত্যাগের সময় বাহিরে বের হয় আসে এবং শেষে নিজে নিজে ভেতরে চলে যায়।

শ্রেণি ৩- মলদ্বারের ভেতর থাকে, মলত্যাগের সময় বাহিরে বের হয়ে আসে কিন্তু শেষে নিজে নিজে ভেতরে চলে যায় না, আংগুল দিয়ে ঠেলা দিতে হয়।

শ্রেণি ৪- মলদ্বারের ভেতর থেকে সবসময় বাহিরে বের হয়ে থাকে, ঠেলে ভেতরে দেওয়া যায় না।

বহিঃস্থ পাইলস: মলদ্বারের বাহিরের পাইলসকে বহিস্থ পাইলস বলে। কখনও কখনও একই সঙ্গে আভ্যন্তরীণ ও বহিস্থ পাইলস থাকতে পারে।

মলত্যাগের সময় চাপ দেওয়ার বদ অভ্যাস ও কোষ্ঠকাঠিন্য পাইলস হওয়ার মূল কারণ। কারও কারও ক্ষেত্রে পাইলস বংশগত রোগও হয়ে থাকে। গর্ভকালীন সময়ে এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাইলস হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া স্থূলকায়, যকৃতের রোগী, বৃহদান্ত্রের প্রদাহ জনিত কারণ, বৃহদান্ত্র ও মলাশয় ক্যান্সারের রোগী, মলদ্বারের পূর্বের অপারেশন, আইবিএস ইত্যাদি রোগ থাকলে পাইলস হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।

মলত্যাগের সঙ্গে রক্ত পাইলসের প্রধান উপসর্গ। মলের সঙ্গে তাজা রক্ত যায়। রোগীরা ফিনকি দিয়ে কিংবা টপ টপ করে রক্ত যাওয়ার অভিযোগ করেন। এছাড়া মলদ্বারে বাড়তি মাংস, চুলকানি, ভেজা ভেজা ভাব ও অস্বস্তি ইত্যাদি উপসর্গ থাকতে পারে।

পাইলসে সাধারনত ব্যথা হয় না। তবে জটিলতা হলে (রক্ত জমাট বাঁধা, রক্তনালী বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি) ব্যথা হতে পারে।

রোগ নির্ণয় করতে চিকিৎসকরা রোগীর উপসর্গগুলো শুনে মলদ্বার পরীক্ষা করেন। এক্ষেত্রে মলদ্বারের ভেতরে একটি ছোট যন্ত্র দিয়ে দেখা হয় (প্রোক্টসকোপি)। প্রয়োজন বোধ করলে কোলন্সকোপি, রক্ত পরীক্ষা ইত্যাদি করা লাগতে পারে।

পাইলসের চিকিৎসা প্রকারভেদে বিভিন্ন হতে পারে। প্রচলিত কয়েকটি চিকিৎসা পদ্ধতি হল-

রক্ষণশীল পদ্ধতি- অভ্যাস পরিবর্তন ও ওষুধের মাধ্যমে। ইঞ্জেকশন। রিং লাইগেশন। অপারেশন- সাধারণ পদ্ধতি অথবা লংগো (এক প্রকার যন্ত্র)। লেজার ব্যবহার। আল্ট্রাসনোগ্রাফির সাহায্যে রক্তনালী বন্ধকরণ।

মলত্যাগের সময় চাপ দেওয়ার বদভ্যাস ত্যাগ, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় টয়লেটে বসে থাকা ইত্যাদি বদভ্যাস ত্যাগ করা পাইলস চিকিৎসায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রচুর পানি ও তরলজাতীয় খাবার পান করতে হবে। খাদ্যতালিকায় আঁশজাতীয় খাবার বেশি (শাকসবজি, ইসপগুলের ভুষি ইত্যাদি)  এবং মাছ-মাংস পরিমাণ মতো রাখতে হবে। এরকম নিয়ম মেনে এবং সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ (মলদ্বারের মলম, ক্রিম, ঢুশ, ওষুধ ইত্যাদি) ব্যবহার করে শতকরা ৮০ ভাগ পাইলস বিনা অপারেশনে চিকিৎসা সম্ভব।

শ্রেণি ১ ও অধিকাংশ শ্রেণি ২ পাইলস এভাবে চিকিৎসা করা যায়। অবশ্য একাধিক স্থানে শ্রেণি ১ পাইলস থাকলে কখনও কখনও লংগো অপারেশন করা হয়ে থাকে।

শ্রেণি ২ ও শ্রেণি ৩য়ের পাইলস রিং লাইগেশন অথবা অপারেশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। কোন পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হবে সেটি চিকিৎসক রোগীর সমস্যার উপর নির্ভর করে ঠিক করে থাকেন।

শ্রেণি ৪য়ের ক্ষেত্রে অপারেশন ভিন্ন অন্য উপায় থাকে না। বহিঃস্থ পাইলসের ক্ষেত্রে অপারেশন প্রয়োজন হয়। লেজার এবং আল্ট্রাসনোগ্রাফির সাহায্যে রক্তনালী বন্ধকরণ আমাদের দেশে চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে তেমন জনপ্রিয় নয়।

পাইলস জনিত অপচিকিৎসার ভয়াবহ পরিণাম থেকে মুক্তির একমাত্র অবলম্বন হল রোগীদের সচেতনতা। পাইলস একটি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য রোগ, অথচ হাতুড়ে ও অপচিকিৎসার কারণে বহু রোগী প্রতিনিয়ত মলদ্বারের চিরস্থায়ী ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।

সঠিক সময়ে, সঠিক চিকিৎসকের কাছে সঠিক চিকিৎসা নিন, স্বাস্থ্যকর খাবার খান ও নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করুন। পাইলস থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকুন- সুস্থ থাকুন।

ছবি: রয়টার্স।