মা ও শিশুর প্রয়োজনে দিবাযত্ন কেন্দ্র

শুধুমাত্র কর্মজীবী মায়ের কাজের স্বার্থেই নয়, দিবাযত্ন কেন্দ্র সন্তানের সঠিক বিকাশ ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য একান্ত প্রয়োজন।

মাকসুদা আজীজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Oct 2016, 10:49 AM
Updated : 1 Oct 2016, 10:49 AM

বন্যেরা বনে সুন্দর শিশু মাতৃক্রোড়ে। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই লাইন যত সুন্দর এবং হৃদয়গ্রাহীই হোক না কেনো, একজন মায়ের একার পক্ষে সর্বক্ষণ শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রায় অসম্ভব। সময়ের পালাবদলে, বর্তমান মায়েরা অনেক বেশি কর্মজীবী এবং বহির্মুখী। অপরদিকে যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ার ফলে শিশুর প্রতিপালনে তারা অনেকটা নিরুপায়ও।

এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ ও সার্বিক বিকাশের সঙ্গী হতে পারে দিবাযত্ন কেন্দ্র।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক ড. সানজীদা আখতার বলেন, “বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত দিবাযত্ন কেন্দ্রের ধারণাটি কর্মজীবী নারীদের কর্মের সুবিধা-অসুবিধার সঙ্গে মিলিয়ে ভাবা হয়। তবে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র নারীর সামগ্রিক ক্ষমতায়নের সঙ্গে জড়িত। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কয়েকটি বিষয় অত্যাবশ্যক। যেমন: নারীর শিক্ষা, নারীর অর্থ উপার্জন, নারীর সুস্বাস্থ্য, ঘরে ও বাইরে নারীর জ্ঞান ও দক্ষতা চর্চা।”

“সন্তানকে রাখার অসুবিধার কারণে নগরায়িত একক পরিবারে অনেক নতুন মাকে কর্মক্ষেত্র ছেড়ে দিতে হয় শুধুমাত্র সন্তান দেখাশুনার সুবিধার্থে। এতে তার নিজস্ব উপার্জন থেমে যায়। উপার্জন থামলে স্বাভাবিকভাবে পরিবারে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে, যার ফল তার সার্বিক ক্ষমতায়নে প্রভাব পড়ে।” ব্যাখ্যা করেন ড. সানজীদা।

বাংলাদেশ সরকার শ্রম আইন- ২০০৬ এর সংশোধনীতে ৯৮ ধারায় শিশু-কক্ষ বিষয়ক আইন যুক্ত করা হয়। যাতে বলা হয়েছে, একটি অফিসে ৪০ জন বা এর বেশি মহিলা থাকলে এবং তাদের ছয় বছরের কম বয়সি শিশু সন্তান থাকলে তাদের সুবিধার্থে কর্মক্ষেত্রে একটি শিশু-কক্ষ স্থাপন করতে হবে।

ইশরাত জাহান রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংক কর্মরত রয়েছেন। তার চার বছর ও দুই বছর বয়সি দুইটি সন্তান আছে।

শিশু-কক্ষ বিষয়ক আইনটি কেনো খুব ভালো কাজে আসে না এই বিষয়ে তিনি বলেন, “এমন অনেক কর্মক্ষেত্রে আছে যেখানে একটি অফিসে ৪০ জনের কম সংখ্যক কর্মচারীই থাকে। তখন আমাদের মতো মায়েদের ভরসা করতে হয় বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের অথবা অনভিজ্ঞ, অশিক্ষিত কাজের লোকের। তার মতো এমন অনেক নারী আছেন যারা বিভিন্ন ব্যাংকের শাখায় আছেন অথবা এমন কোনো কর্মক্ষেত্রে আছেন যা এই আইনের আওতায় পরে না। ফলে কিছু কিছু ব্যাংকের মূল শাখায় শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র থাকলেও একই প্রতিষ্ঠানের অন্যরা এখন পর্যন্ত বাইরে থেকে যাচ্ছেন।”

“যদিও আমার আয় সংসারের ব্যবহৃত হয় তবুও দিন শেষ আশা করা হয়, আমি সংসারের সব কাজের দায় নিজের ঘাড়ে তুলে নেব। প্রতিনিয়ত গৃহিনী হিসেবে অদক্ষ, কর্মক্ষেত্রে নারীদের মন ঘরেই পরে থাকে কাজ হয় না গোছের কথার মধ্যে থাকতে হয়। বাড়ির বয়োজ্যষ্ঠদের সঙ্গে থেকে সন্তানরাও আমাকেই দোষারোপ করা শিখছে অথচ একজন পুরুষের দ্বিগুণ কাজ আমাকে ঘরে বাইরে মিলিয়ে করতে হয়। এর বিনিময়ে সামান্য ‘ধন্যবাদ’ও পাওয়া যায় না।” যোগ করেন ইশরাত।

ড. সানজীদার মতে, “ক্ষমতায়নের বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গেলে শুধুমাত্র তরুণ জনগোষ্ঠীর কথাই যেন ভেবে থাকি। মায়েরা যারা নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়েন, তাদেরও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ও দেওয়ার, পছন্দ-অপছন্দ প্রকাশের ক্ষমতা থাকা উচিত।”

তিনি আরও বলেন, “শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের অভাবে বা সেগুলোতে রাখার অনুশীলন না থাকায়, নগরায়িত জীবনে মা-শাশুড়িদের হাতে শিশুকে রেখে তরুণ মায়েরা কর্মক্ষেত্রে থাকে। মা শাশুড়িদের বার্ধক্যের অবসরটুকু যেন অনেকাংশেই শিশু লালন-পালনের অবসাদে পরিণত হয়। শিশুদিবা যত্ন কেন্দ্র তাদের জন্যও সহায়ক হতে পারে।”

“এছাড়াও ইতিমধ্যেই কিছু সংখ্যক পরিবারের নারীদের দ্বিতীয় প্রজন্ম কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, মা বা শাশুড়ি যখন তার কর্ম জীবনের সর্বশেষ এবং শীর্ষ পর্যায় আছেন। এরকম অবস্থায় তাদের কাছে শিশুর রক্ষণাবেক্ষণের সহায়তা চাওয়াও একটা অন্যায়। এটা যে শুধু তাদের পেশার জন্য ক্ষতিকর তাই নয়। দেশের সার্বিক কর্মক্ষেত্রও দক্ষ একজনের সেবা হারাচ্ছে। যা অবশ্যই কাম্য নয়।”

“এমনও হতে পারে, বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলাটি একটি শিশুর রক্ষণাবেক্ষণের মতো সুস্থ নয়। সব কিছুর ফল ঘুরে ফিরে একই, কোনো না কোনো একজন নারী চাকরি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে।” মত দেন ড. সানজীদা।

এ ছাড়াও একটা গোষ্ঠী সব সময় সব রকমের মাতৃত্ব-কালীন আইন এবং এর সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তারা হলেন শিক্ষাবস্থায় সন্তান জন্ম দেওয়া মায়েরা।

ড. সানজীদা বলেন, “আমাদের দেশে অল্প বয়সে বিয়ের প্রবণতা অত্যন্ত বেশি। এক্ষেত্রে দেখা যায় স্কুল বা কলেজে থাকার সময় বিয়ে এবং সন্তান জন্মদানের হারও খুব বেশি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হল সেই সেই মায়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া। কারণ, বাচ্চা দেখাশুনার করার জন্য সর্বক্ষণ সন্তানের কাছে থাকতে হবে তার। ক্ষমতায়নের প্রথম ধাপ শিক্ষার ইতি ঘটে এখানেই। একটি সুন্দর শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র থাকলে হয়ত ঐ মা তার সন্তানকে কিছু সময়ের জন্য রেখে তার পড়াশুনা চালিয়ে নিতে পারতেন।”

শুধু যে মায়ের কাজ বা আরাম তাই নয় একটি দিবাযত্ন কেন্দ্র শিশুর বৃদ্ধির জন্যও বেশ উপকারী।

একটি দিবাযত্ন কেন্দ্র ‘শৈশব’য়ের কর্ণধার নজরুল ইসলাম জানান, আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ চাইল্ড হেলথ অ্যান্ড হিউমেন ডেভেলপমেন্টের একটি চলমান গবেষণা বলে যে, একটি দিবাযত্ন কেন্দ্র যদি মানসম্মত হয় তবে, শিশুর যত্নের পাশাপাশি তার বুদ্ধিবৃত্তিতেও ইতিবাচক প্রভাব রাখে। এছাড়াও শিশুদের সামাজিকতা শিক্ষা, অন্য শিশুদের সঙ্গে মানিয়ে চলা ইত্যাদি বিষয় ঘরে বসে দাদী নানী বা আয়ার কাছে পাওয়া সম্ভব নয়।”

তবে আনন্দের কথা এই যে বর্তমানে অনেক সরকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে তাদের কর্মীদের সুবিধার কথা ভেবে দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠান মধ্যে এমন রয়েছে সরকারী বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, তেমনি আছে বেসরকারি, বহুজাতিক সংস্থা, সহায়তা সংস্থায়ও। তবে এখনও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই এই ধরনের সুবিধা দেওয়ার কথা পরিকল্পনাই করেনি।

খালেদা আক্তার একজন উন্নয়ন কর্মকর্তা। কাজ করছেন একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায়। তার মতে, “কর্মক্ষেত্রে যদি শিশুকে রাখার সুবিধা না পাওয়া যেত তবে হয়ত চাকরিটাই আর করা হত না তার।”

তার অফিসে ২০০৬ সাল থেকে খুব ছোট পরিসরে একটা ডে কেয়ার রয়েছে। সেখানে শিশুকে মাত্র তিন বছর বয়স পর্যন্ত রাখা যায় এবং যার যার সন্তান দেখাশোনা করার লোক সঙ্গে করে আনতে হয়। তারপরেও খালেদা মনে করেন এটা একটি খুব ভালো ব্যবস্থা কেননা তাদের কর্মক্ষেত্র শিশু-কক্ষ আইনের আওতায় পরে না যেহেতু সেখানে ৪০ জন পাঁচ বছরের ছোট শিশুসহ মহিলা কাজ করছেন না।

খালেদা আরও বলেন, “একটা শিশু দুই বছর পর্যন্ত মায়ের দুধ খায়। ছয় মাস বয়সে যখন সন্তাকে রেখে কাজে যোগ দেওয়া লাগে তখন সে মাত্র অন্য খাবারের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করে। দুধটা তখনও তার প্রধান খাবারই থাকে। আবার এক থেকে পাঁচ বছরের শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হয় তারা নানান অসুখে পড়ে। অসুস্থ শিশুকে দূরে রাখা যেমন মায়ের জন্য কষ্টের তেমনি শিশু জন্যও। তাই সেটা যদি একদম আদর্শ নিয়ম মেনে যত্ন কেন্দ্র নাও হয় তবুও অনেক উপকারী হয়।”

একদম নিয়ম মেনে তৈরি হওয়া দিবাযত্ন কেন্দ্র রয়েছে রবি আজিয়াটা লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ে।

এই কার্যক্রমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নওরিয়া যিনাত বলেন, ২০১১ সালে এই দিবাযত্ন-কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল, আমাদের নারী কর্মীরা যেন শিশুর জন্মের পরে নির্বিঘ্নে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারেন। এর সঙ্গে আমরা শিশুদের নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে কক্ষটি ব্যবসায়িক ভবনে তৈরি না করে পাশে একটি আবাসিক ভবনে তৈরি করেছি। ছয় মাস থেকে ছয় বছর পর্যন্ত শিশুরা এখানে থাকতে পারে। তাদের দেখাশোনার জন্য আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করা হয়। শুধু রক্ষণাবেক্ষণ নয়, তাদের সার্বিক বেড়ে ওঠা এবং শিক্ষার বিষয়েও এই দিবাযত্ন দায়িত্ব নিয়ে থাকে। এখন পর্যন্ত আমরা আমাদের এই কার্যক্রমে সফল।”

তেমন কোনো সুবিধা ছাড়াও শুধু সবাই মিলে চেষ্টার ভিত্তিতে একজন মায়ের চাকরিটা বাঁচিয়ে রাখা যায়; এই অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে ম্যাগনিটো ডিজিটাল লিমিটেড নামে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা। এখানে কর্মরত একজন মায়ের সন্তানের জন্য তাদের অফিসে কর্মীদের বসার জায়গাতেই একটা বেবিকট (বাচ্চাদের বিছানা) রেখে তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ম্যাগনিটো ডিজিটালের সিওও খাওয়ার সাউদ আহমেদ বলেন, “আমাদের দক্ষ একজন ডিজাইনার চো শোয়ে চিং কিছুদিন আগে মা হওয়ার পর শুধুমাত্র বাচ্চাকে রাখার অসুবিধার কারণে চাকরি ছাড়তে উদ্যত হন। এই বিষয়টা আমাদের বেশ খারাপ লাগে। শুধুমাত্র বাসায় সন্তান দেখাশোনার মতো কেউ নেই বলে আমাদের একজন চাকরি ছেড়ে দেবে বিষয়টি আমরা মানতে পারিনি। আমাদের সিইও রিয়াদ শাহির আহমেদ হোসেনের সঙ্গে পরামর্শক্রমে আমরা একটা বেবিকট কিনে আনি। কটটা আমাদের কাজের জায়গাতেই থাকে। শিশুর মা তো বটেই, পর্যায়ক্রমে অন্যরাও শিশুটিকে দেখে-শুনে রাখতে পারে। শিশুটি এখন আমাদের জীবনেরই একটা অংশ হয়ে গিয়েছে।”

ছবি: শৈশব ডে কেয়ার।