সাদা পাথরের দেশে

স্ফটিক স্বচ্ছ জল কেটে এগিয়ে যেতে যেতে চোখ পিছলাবে সবুজের আস্তরণে। পানি পথ শেষে মিলবে সাদা পাথরের দেশ।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Sept 2016, 10:02 AM
Updated : 16 Sept 2016, 10:02 AM

ভোলাগঞ্জ দেশের সর্ববৃহত্তম পাথর কোয়ারির অঞ্চল। এখান থেকে ছাতক পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে বা রজ্জুপথ। সেই এলাকা ঘুরে এসে বেড়ানো নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন পরিব্রাজক ও চিত্রগ্রাহক ফারুখ আহমেদ।

সবুজ চোখে কি আছে জানি না। বার বার চেয়ে দেখছিলাম সেই চোখ। সে দেখা উস্কে দিলো জাহাঙ্গীর-এ-বাবর। আমি গোলুইতে বসে ছিলাম, কাছে এসে বললো ছেলেটার চোখ দুটো দ্যাখছেন কেমন সবুজ, ছবি তুইলা রাখেন। তারপর তো সারা পথই সবুজ চোখের ছেলেটির ছবি তুলেছি।

মজার বিষয় হচ্ছে তাকে একবারও বলতাম না আমি তোমার চোখের ছবি তুলছি, তবু সে চোখের পলক ফেলতো না। আমি এক নাগাড়ে শার্টার টিপে যেতাম, সে অপলক চেয়ে থাকত।

বলছি কাজলের কথা, সবুজ চোখের কাজল। পরিচয় সিলেটের বাদাঘাটে। সে ট্রলার চালকের সহযোগি হিসেবে কাজ করে। নিজেদেরই ট্রলার সুতরাং কাজ করে বলাটাও ভুল, সে আসলে নিজেদের ট্রলার দেখভাল করে। আমি তার সবুজ চোখে মজলাম, সে আমার ক্যামেরায়। তারপর শুধু বয়ে চলার গল্প। যে বয়ে চলা আমাদের পৌঁছে দেবে ভোলাগঞ্জ।

এখানে দেখবো ধলাই নদীর রূপ, সারি সারি পাথর তোলার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য, সবুজ পাহাড় বন্দি সাদাপাথর আর পাহাড় থেকে পাথর ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়া স্ফটিক স্বচ্ছ জল!

বর্ষার শেষ, তবু বৃষ্টি একটুও কমেনি। সারাদেশেই প্রতিদিন বৃষ্টি, সিলেটে একটু বেশি। বৃষ্টি মাথায় আমাদের যাত্রা শুরু হল সিলেটের বাদাঘাট থেকে। চলা শুরুর একটু পরই বিশাল সুরমা নদী সরু হয়ে গেলো। তারপর তো আমরা সুরমার শাখা নদী দিয়ে চলা শুরু করলাম।

স্বচ্ছ পানি দেখে এক আঁজলা পানি মুখে মাখলাম, পা ঝুলিয়ে দিলাম নদীল জলে। এ ভাবেই এক সময় আমাদের বজরা গিলে নিলো বিশাল এক বিল।

আঁকাবাঁকা সে বিলের দুপাশ অসাধারণ সবুজ। হিজল গাছগুলো দিব্যি ডুবে ডুবে দাঁড়িয়ে। এখন ধানকাটার মৌসুম নয়, ধানের চারা লাগানোর দিন। বিলের জল থৈ থৈ, সেই জল থৈ থৈ বিলের পাশে সবুজ জমিতে ধানের চারা লাগানোর উৎসব দেখে বলা যায় বাংলার শ্বাশত রূপ দেখে দেখে তিন থেকে চারঘণ্টার লম্বা পথ পারি দিতে হবে।

এখানে কৃষকের দিন শুরু হয় চারা লাগানোর ব্যস্ততা নিয়ে। বিলে শাপলা ছিল তবে খুব কম। আর কচুরিপানা দেখিনি বললেই চলে। বিল থেকে এবার আমরা ছোট্ট খালে এসে পড়ি।

স্থানীয়রা যাকে চেনেন কাটাগাঙ্গ হিসেবে। এক সময় ছোট্ট নালার মতো ছিল, মাঝখানে রাস্তা। নালা বড় করে পানির ব্যবস্থা করতেই খাল কাটা হয়। সেই থেকে এর নাম কাটা খাল, কেউ কেউ বলেন কাটাগাঙ্গ।

আমরা কাটাগাঙ্গ’র পাশের গ্রামে প্রথম যাত্রা বিরতি নেই, নাম উমর গাঁও। উমর গাঁওয়ে চা পান করে আবার আমাদের যাত্রা শুরু। এখনও অনেকটা পথ যেতে হবে।

ট্রলার চালক গতি বাড়িয়ে দেয়। আমরা বাম দিকে পাহাড় আর ডান দিকে সবুজ গ্রাম দেখে দেখে ভোলাগঞ্জ অভিমূখে চলি। এভাবেই চলতে চলতে খালির গাঁও ও ডাকাতের বাড়ি (গ্রামের নাম) ওপর দিয়ে ট্রলার চালিয়ে এক সময় ধলাই নদীতে পড়ি।

এবার আমরা কোম্পানিগঞ্জ বাজারে যাত্রা বিরতি নেই। কোম্পানিগঞ্জ বাজার ঘুরে দেখি। চলে আসি বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুল চত্বরে। ২০০২ সালে স্থাপিত এই স্কুলটির শহীদ মিনারটি দেখার মতো, আমাদের মন ছুঁয়ে গেল আপনারও যাবে, তারপর চলে ছবি তোলার ধুম।

বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলে কতক্ষণ ছিলাম জানি না। ট্রলার চালকের ডাকে শহীদ মিনারের ধ্যান ভাঙে। তারপরের গল্প শুধু ধলাই নদী আর ভোলাগঞ্জ সাদা পাথরের।

কোম্পানিগঞ্জ যতই পেছনে পড়ছিল ততই চোখের সামনে স্পষ্ট হচ্ছিল ভোলাগঞ্জ, ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে আর মেঘালয় রাজ্য।

ভোলাগঞ্জ দেশের সর্ববৃহত্তম পাথর কোয়ারির অঞ্চল। এখান থেকে ছাতক পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে বা রজ্জুপথ।

ভারতের খাসিয়া জৈন্তা পাহাড় থেকে বরষা মৌসুমে ঢল নামে, সেই ঢলে নেমে আসা পাথর বহন করার জন্য ১৯৬৪ সালে এই রোপওয়ে নির্মাণ করা হয়।

সাদা পাথর ও তার স্বচ্ছ জল দেখতে আসা দর্শনার্থীদের কাছে ধলাই নদী ও খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড় আর সীমান্ত এলাকার মতোই সমান জনপ্রিয় রোপওয়েটি। যদিও ১২ বছর ধরে রোওয়েটির বেকার জীবর-যাপণ।

আমাদের সামনে এখন খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়। এই পর্বতমালার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমোহিত আমরা মন খারাপ করে দেখি বোমা মেশিন। বোমা মেশিনের গর্জন আর তর্জনে ধলাই নদী পেরিয়ে এরমধ্যে আমরা চলে এসেছি ভোলাগঞ্জ বাজার। এখানে ট্রলার পরিবর্তন। শেষ হয় সবুজ চোখের কাজলের সঙ্গে তিন ঘণ্টার সম্পর্ক।

ভোলাগঞ্জ বাজারে সামান্য নাস্তা সেরে নতুন একটি ট্রলার ভাড়া করে এবার এগিয়ে চলি জিরো পয়েন্ট অভিমূখে, আমাদের কাংক্ষিত সাদাপাথর এলাকায়।

শান্ত স্তব্ধ পাহাড়, তার সঙ্গে মিশেছে আকাশের নীল। শরত মৌসুম শুরু না হলেও আকাশের গায়ে ছোপছোপ শরতের শ্বেতশুভ্র মেঘ। আমাদের ট্রলার এগিয়ে চলেছে প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে। পরিবেশের এই সম্মোহন হাতছানির মধ্যে বোমা মেশিনের গর্জন অবশ্য সেই গর্জন মিশে যায় রোপওয়ের সৌন্দর্যে।

আমরা জিরো পয়েন্টে দৃষ্টি প্রসারিত করি, চারিদিকে পাথর আর পাথর, এখানে সব পাথর সাদা রঙা। পাথর তোলার প্রচুর নৌকা চোখে পড়ল, তবে এখানে দর্শনার্থী নেই। নির্জন সাদা পাথরের অসাধারণ এলাকায় আমরা পা রাখি। সামনে সবুজ পাহাড়, পাশে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া প্রচণ্ড স্রোতের স্বচ্ছ শীতল জল আর সে জল থেকে গড়িয়ে নামা সাদা পাথর, কি অপরূপ তা বলে বোঝানোর নয়।

আমরা পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া শীতল জলে ঝাঁপিয়ে পড়ি, আহা কী ঠাণ্ডা। পানি আর সাদা পাথরের জাদুকরি শীতল স্পর্শে আমরা বিমোহিত। উফ! জীবনের বিস্ময়কর এক অভিজ্ঞতা বটে।

একসঙ্গে এত এত সাদা পাথর জীবনে কখনও দেখিনি, ভাবতে ভাবতে আর সাদা পাথর দেখে দেখে সঙ্গে পাথর জলে গোসল করে সময় এগিয়ে যায়। এভাবে কখন পাহাড়ি রোদ তার কোলে আশ্রয় নিয়েছে টের পাইনি।

অন্ধকার জেঁকে বসার আগেই তাই সেই অসম্ভব সুন্দরকে বিদায় জানাই!

প্রয়োজনীয় তথ্য

অক্টোবর পর্যন্ত ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর এলাকায় যাওয়ার মোক্ষম সময়। সিলেট শহর থেকে ভোলাগঞ্জ এর দূরত্ব ৩৩ কিলোমিটারের মতো। এই পথে কোনো বাস চলাচল নেই, কোনো লেগুনা চলে না। যাতায়াতের একমাত্র বাহন সিএনজি চালিত অটো রিক্সা, জনপ্রতি ভাড়া ২৫০ টাকা।

রাস্তা এত খারাপ যে বিশ্বের সবচেয়ে বাজে রাস্তা হিসেবে সিলেট-ভোলাগঞ্জ সড়ককে যে কেউ এক কথায় মেনে নেবেন।

রাস্তা খারাপের জন্যই আমরা নদী পথ বেছে নিয়েছিলাম। এই পথে জন প্রতিখরচ ২শ’ টাকা। সংখ্যায় বেশি হলে ট্রলার রিজার্ভ নিয়ে নিন। ভাড়া নিবে ৬ হাজার টাকা যাওয়া-আসা।

যাতায়াতের সময় সড়ক পথের মতোই নদী পথেও তিন ঘণ্টার মতো। দিনে গিয়ে দিনেই ফেরত আসা যাবে।

মনে রাখবেন ভোলাগঞ্জ থেকে সিলেট বাদাঘাটের শেষ ট্রলার ছেড়ে আসে বিকেল চারটায়। তাই সময় ব্যাপারটা সব সময় আপনার মাথায় রাখতে হবে। ট্রলার মিস করলে সড়ক পথ ভরষা, সে ক্ষেত্রে দূর্বিসহ যন্ত্রনা পোহাতে হবে। আর নদী পথে যাতায়াতে একটু বাড়তি সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে। সম্ভব হলে সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট রাখবেন।

শুকনা খাবার এবং প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধ সঙ্গে রাখবেন।

একটা বিষয় খেয়াল রাখবেন আপনার বা আপনার ভ্রমণ সঙ্গীদের দ্বারা পরিবেশ হুমকিতে পড়ে এমন কোনো কিছু অবশ্যই করা চলবে না, পলিথিন বা প্লাস্টিকের বোতলসহ পরিবেশ বিপন্ন হয় তেমন কিছু ফেলে আসবেন না।

ছবি: লেখক।