পরিবার বলতে সবার মনে একটা নিখুঁত ছবি সাজানো থাকে। সেখানে বাবা থাকে মা থাকে সন্তান থাকে। বাবা মায়ের আলাদা আলাদা দায়িত্ব কর্তব্য থাকে। এই সুন্দর নিয়মের ছন্দ পতন হয় যখন পরিবার থেকে বাবা অথবা মা কেউ একজন চলে যান।
এরকম পরিবারগুলোকে সমাজবিজ্ঞানে ‘সিঙ্গেল প্যারেন্টিং ফ্যামিলি’ বলার হয়। দুজন মিলে সন্তান মানুষ করাই বেশ কঠিন কাজ। এই কাজ যখন একজনের উপরে এসে পড়ে তখন দায়িত্ব একজনের উপর বেড়েও যায়।
একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষক জুয়েনা আহমেদ। বিবাহ বিচ্ছেদের পরে, চার বছরের একটি ছেলে নিয়ে একা বাস করছেন কয়েক বছর হল।
জুয়েনা বলেন, ‘সিঙ্গেল প্যারেন্টিং বিষয়টি হচ্ছে, একটি শিশুর শুধুমাত্র একজন অভিভাবকের সঙ্গে বেড়ে ওঠা। সেটা মা হতে পারে, আবার বাবাও হতে পারে। বিষয়টা খুব সাধারণ, আবার একই সঙ্গে অনেক সংবেদনশীল।”
বিচ্ছেদ যে কারণেই হোক অধিকাংশ ক্ষেত্রে একক অভিভাবকের পরিবারগুলো মায়ের পরিবার হয়। আর একক অভিভাবকের পরিবার যদি বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে হয় তবে সেটা রক্ষণাবেক্ষণ করা সব সবসময়ই আলাদা এবং কিছুটা কষ্টকরও।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট রুবাইয়া জাফর খান জানান, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বিচ্ছেদের পরে পুরুষেরা খুব কমই একা থাকেন। এছাড়া বিচ্ছেদ সংক্রান্ত আইনও কিছুটা পুরুষতান্ত্রিক বলে মনে করেন তিনি।
“বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত আইন অনুযায়ী, সন্তানের বাবা তার প্রকৃত অভিভাবক এবং মা হেফাজতকারী মাত্র।”
বিচ্ছেদের পরে সন্তান কার কাছে থাকবে এটা নির্ভর করে সন্তানের বয়স এবং লিঙ্গের উপর। সাধারণত পুত্র সন্তানের বেলায় সাত বছর বয়স পর্যন্ত সে মায়ের কাছে থাকতে পারে আর কন্যা সন্তান বয়ঃসন্ধি কাল পর্যন্ত মায়ের হেফাজতে থাকে। এর পরে সন্তানদের বাবার কাছে যাওয়ার বিধান রয়েছে।
এই অ্যাডভোকেট আরও জানান, যদিও এখন বিচার ব্যবস্থায় বেশ পরিবর্তন এসেছে এবং সন্তানকে বাবা অথবা মায়ের মধ্যে একজনকে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া হয়। তবে মা যদি আবার বিয়ে করেন সেক্ষেত্রে সন্তানকে বাবার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার একটা সাধারণ নিয়ম রয়েছে। যা একজন নারী বা ‘একক মা’কে একা থাকতে বল প্রয়োগ করে থাকে।
সিঙ্গেল প্যারেন্টিং-এ বড় হওয়া একজন মানুষ এলভিরা আহমেদ। পেশায় প্রভাষক। কাজ করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অফ লাইফ সায়েন্সে।
তিনি বলেন, “ভাঙা একটি পরিবারে বড় হওয়ার কারণে মানসিক কিছু টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালে। যদিও আমার মা আমার জন্য সম্ভব সব কিছুই করতেন। তবুও মায়ের সঙ্গে আমার নানান কারণে বিরোধ লেগেই থাকত।”
“বাবা নেই আর বাবা একসঙ্গে থাকে না, দুটো যে আলাদা বিষয় সেটা আমার চক্ষুগোচর হয় যখন আমার এক কাজিনের বাবা মারা যান। আমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারি, সিঙ্গেল প্যারেন্টিং আমার মায়ের জন্য অন্য ক্ষেত্রের চেয়ে কষ্টকর। কোথাও এক জায়গায় আমারও উচিত তাকে সহযোগিতা করা, তার পাশে দাঁড়ানো। তার শক্তি হওয়া।” বললেন এলভিরা আহমেদ।
একটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থায় কর্মরত একক মা ইশরাত। এক বছরের কন্যা নিয়ে ফিরে আসেন বাবা মায়ের সংসারে। সেই থেকে একাই আছেন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ড. আহমেদ হেলাল বলেন, “আমাদের সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদকে এখনও খুব ভালো চোখে দেখা হয় না। স্বাভাবিক নিয়মে যে কিছু সম্পর্ক টেকে না এই কথাটা মানার মতো মানসিকতা এখনও সাধারণের মধ্যে তৈরি হয়নি। যার ফলে আলাদা হয়ে যাওয়া পরিবার নিয়ে সকলের অসীম আগ্রহ এবং কোনো এক পক্ষকে দোষারোপ করার বা কার দোষ খুঁজে বের করার একটা প্রবণতা সকলের মধ্যেই থাকে যা সন্তান এবং বাবা-মা উভয়কেই মানসিকভাবে চাপ দেয়।”
এরকম একটি পরিস্থিতিতে সন্তানের লালন পালন করা একটি কঠিন এবং অবশ্যই স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত। অনেক ক্ষেত্রেই বাবা-মা অথবা পরিবারের লোকজন বিচ্ছেদের বিষয়টা সন্তানের কাছে খোলামেলা ভাবে তুলে ধরেন না। সবার মধ্যে একটা রাখঢাক কাজ করে যেন পরিবারের বাইরে বেশি কেউ এই ঘটনা জানতে না পারে।
“যত দ্রুত এই বিষয়টা সন্তান সহজভাবে নিতে শিখবে তত দ্রুত সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে।” বললেন ড. হেলাল।
অনেক সময় দুই পরিবারের স্বজনরা নিজেদের মধ্যকার বিরোধের ‘বিষ’ সন্তানের মধ্যেও ঢেলে দেন। এতে তাদের মনে আস্থাহীনতা এবং অবিশ্বাস তৈরি হয়। যা খুবই ক্ষতিকর। সন্তানকে জানতে হবে বিচ্ছেদ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, এখানে কোনো একজনের দোষ নয়, স্বাভাবিক নিয়মে কিছু সম্পর্ক ভেঙে যায়।
ড. হেলাল বলেন, “ভেঙে যাওয়া একটি পরিবারের সন্তানকে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি দিতে হবে সেটা হচ্ছে সময়। হতে পারে সময় পরিমাণে কম তবে সেই সময়ের উৎকর্ষতা বেশি থাকতে হবে। যেন সন্তান সেই সময়টি উপভোগ করতে পারে। এই সময়ে অবশ্যই পারস্পরিক ভাবের আদান প্রদান থাকতে হবে। সব মিলিয়ে এমন কিছু করতে হবে যেন সে স্বনির্ভর হওয়ার শিক্ষা পায় এবং নিজের গুরুত্ব অনুধাবন করতে শেখে।”
পাশাপাশি একা হয়ে যাওয়া মানুষদের স্বজনদের উচিত তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। সামাজিক এবং মানসিক সহায়তা পেলে তাদের জীবন যেমন সহজ হয় তেমনি সন্তান পালনও নির্বিঘ্ন ভাবে করা সম্ভব হয়।
মা ও মেয়ের প্রতীকী ছবির মডেল: নাজিয়া খান এবং ওফেলিয়া। ছবি: আব্দুল মান্নান দীপ্ত।
বাবা ও মেয়ের প্রতীকী ছবির মডেল: শামীম ও অহনা। ছবি: অপূর্ব খন্দকার।