পাংখোয়াদের স্বর্গপল্লী

যেখানে মেঘের দল ঘুরে বেড়ায় মানুষের সঙ্গে। পানি আর পাহাড় ঘেরা স্বর্গভূমি, উঁচু সেই গ্রাম উপভোগ করতে যেতে হবে রাঙামাটির শুভলংয়ে।

সমির মল্লিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 July 2016, 08:45 AM
Updated : 22 July 2016, 08:45 AM

বৃষ্টি উপেক্ষা করে লংগদু পৌঁছে শুভলং’য়ের লঞ্চ পেলাম। ভরা বর্ষায় কাপ্তাই লেককে সমুদ্র বলে মনে হয়। বিস্তৃত জলরাশির ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাহাড়ের পাদদেশে।

কাপ্তাই লেকে চলাচলকারী কাঠের দোতলা লঞ্চগুলো বৃষ্টি উপভোগের জন্য বেশ, লঞ্চের পেছনের ছাদে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখাটা মায়াবী অনুভূতির জন্ম দেয়!

ঘন বৃষ্টির মধ্যে লঞ্চ শুভলং বাজারে পৌঁছাল দুপুরে। এখানের বাজারে কিছুক্ষণ যাত্রা বিরতি, শুভলং বাজার রাঙামাটির প্রধানতম নৌরুট। জেলার বেশিরভাগ উপজেলায় যাতায়াত এই শুভলং বাজার হয়ে। তবে এবারে আমাদের যাত্রাপথ জুরাছড়ির কুকিমন পাহাড়ের পাংখোয়া পল্লী।

জুরাছড়ি’র স্থানীয় এক আদিবাসী বন্ধুর মুখে প্রথম এই পাড়ার নাম শুনলাম। সেই পথেই এবার যাত্রা।

শুভলং বাজারে দুপুরের খাবার খেয়ে বিকাল ৩টার লঞ্চে রওনা হলাম জুরাছড়ির পথে। জলের স্রোত কেটে লঞ্চ চলেছে সবুজে ঘেরা জলাভূমির পথ ধরে। কাপ্তাই লেকের একটা অংশ জুরাছড়িতে এসে শেষ হয়ে গেছে।

এখানকার পানির রং নীল। রয়েছে ঘন শ্যাওলা। লেকের পাড়ে পাহাড়ের ডানায় বসবাস করা পাহাড়ের আদিবাসীদের বসতি আর জুম ফসলের আবাদ। বিকালের রঙিন আকাশের ছায়া পড়েছে গেরুয়া পাহাড়ের গায়ে। নিঃশব্দের জলাভূমি থেকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে জুরাছড়ি'র কুকিমন পাহাড়ের চূড়াগুলো ঢেকে গেছে সাদা মেঘের আচ্ছাদনে।

নীল জলের নিচে সবুজের বাগান। পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করা ছোট্ট কুটিরগুলোও ঢেকে আছে ঘন মেঘের চাদরে।

মেঘের কারণে সবুজ বর্ণগুলো মুহূর্তে সাদা হয়ে যাচ্ছিল। বিকাল নাগাদ জুরাছড়ির ঘাটে পৌছলাম। 

এখান থেকে দেশি নৌকায় রওনা হলাম।

জুরাছড়ি থেকে কিছুটা গেলেই বনযোগীছড়া বাজার। চারপাশে পানি আর পানি। তাই ইজ্ঞিন চালিত নৌকাই একমাত্র ভরসা। বনযোগীছড়া বাজার থেকে কিছুটা মোটর বাইকে যাওয়ার পর বাকি পথ ঝিরির। পাথুরে ঝিরিতে পাহাড় থেকে বয়ে আসা  পানির স্রোত। সবুজে ঢাকা বুনো ট্রেইল! ঝিরির পথ বয়ে নেমে গেছে কুকিমন পাদদেশ ঘেষে। ঝিরি পথে জলের বাঁক পেরিয়ে কুকিমন পথে পা ফেললাম।

কুকিমনের পাংখোয়া পল্লীতে যাওয়ার একমাত্র পথে হাঁটা শুরু হল। পুরোটায় খাড়া পথ। পাহাড়ে উঠতে মেঘের দল এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, পথের দুপাশের ঘন বন। কোথাও কোনো বসতি চোখে পড়ছে না। মেঘ-বৃষ্টি-রৌদ্দুর পেরিয়ে পাংখোয়া পল্লীতে পৌঁছতে দিন প্রায় শেষ হয়ে গেল।

পাড়ার সীমানায় ঢুকতেই লাল-সবুজের পতাকা স্বাগত জানাল। সমতল ভূমি থেকে এত উপরে এই বুনো পরিবেশে ঘেরা পাহাড়ের চূড়োয় একটি স্কুলে উড়ছে দেশের পতাকা। পাংখোয়া ছেলে-মেয়েরা এই স্কুলের শিক্ষার্থী, ৪৫জন পাংখোয়া ছাত্র-ছাত্রী এই স্কুলে।

পাড়াটিতে শুধুমাত্র পাংখোয়া আদিবাসীদের বসবাস। যেন ছবির মতো সুন্দর। পাড়াটি যেন পাংখোয়াদের স্বর্গপল্লী।

কুকিমন পাহাড় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতায় প্রায় ১৬১০ ফুট উপরে। পাহাড়ের উপর থেকে যতটুকু চোখ যায় কেবল সুনীল পাহাড়ের বন্ধনী। নিচের পৃথিবীটা জলের দখলে। সুনীল আকাশ আর সাদা জলের দেশে সুউচ্চ পাহাড়ে সুদীর্ঘ কালের বসতি পাংখোয়া পল্লী।

২৫টি পাংখোয়া বসতি আকাশ ছূঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্যাথলিক এবং ব্যাপিস্ট দুটি গির্জা আছে পাড়ার শুরু আর শেষ প্রান্তে। পাহাড়ের কোল ঘেষে দণ্ডমান দোতলা মাচাং ঘরগু্লো, সহসাই সেখানে ধরা দেয় মেঘের দল। যতক্ষণ পাড়ায় ছিলাম পুরো সময় মেঘ-বৃষ্টি-বাতাসের অবগাহন। 

পাংখোয়া পাড়ার চারপাশে তেঁতুল, বট ও নারিকেল গাছের প্রাকৃতিক বেষ্টনী। ধবধবে জোছনায় এমন একটি পাড়ায় একটি রাত যাপনটা স্বপ্নের মতোই সুন্দর।

যেভাবে যাবেন

জুরাছড়ি'র পাংখোয়া পল্লী যেতে হলে- প্রথমে ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে বাসে যেতে হবে রাঙামাটি পর্যন্ত। শ্যামলী, হানিফ, এস আলমসহ বিভিন্ন পরিবহন প্রতিদিন  রাঙামাটিতে যাতায়াত করে।

তাছাড়া চট্টগ্রামের অক্সিজেন থেকে পাহাড়িকা বা বিআরটিসি পরিবহনে রাঙামাটি পৌঁছানো যায়। রাঙামাটি থেকে লঞ্চে করে যেতে হবে জুরাছড়ি পর্যন্ত। সেখান থেকে দেশি নৌকায় বনযোগীছড়া। বাকি পথ পায়ে হেঁটে কুকিমন পাহাড়ের পাংখোয়া পল্লীতে পৌঁছানো যায় ।

 

প্রয়োজনীয় তথ্য

পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয় করে এমন কোনো কর্মকাণ্ড করা যাবে না। আদিবাসীদে নিজস্ব সংস্কৃতি প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। কাপ্তাই লেকের গভীরতা অনেক। সাঁতার না জানলে লেকের জলে নামবেন না। কোনো প্ল্যাস্টিক বা অপচনশীল জিনিস পাহাড়ে ফেলে আসবেন না, সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন।

রাঙামাটি বা জুড়াছড়ি ভ্রমণের জন্য যোগাযোগ করতে পারেন ০১৮১৫-৮৫৬৪৯৭, ০১৫৫৬-৭১০০৪৩ নম্বরে।