প্রাচীনকালে কৃষকদের কাছে ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত বাংলা বর্ষের মাসগুলোর নামকরণ হয়েছে বিভিন্ন নক্ষত্রের নামে।
Published : 13 Apr 2016, 04:33 PM
‘ঐতিহ্য অন্বেষণ’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার সংস্থা। এর সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক শারমিন রেজওয়ানা বাংলা সনের প্রবর্তন, পহেলা বৈশাখ উৎসবের বিষয়টি বিশ্লেষণ করেন গভীর থেকে।
কীভাবে এলো পহেলা বৈশাখ!
বাংলা সনের শুরু কোথা থেকে অথবা কেনো বাংলা সন প্রবর্তন করা হল এইসবের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখে যায় পান্তা ইলিশ তো বাংলার হাজার বছরের সংস্কৃতি পাওয়াই যায় না উপরন্তু আমরা যে ১৪২৩ সালকে আমন্ত্রণ জানাতে যাচ্ছি এর গণনাও এক, দুই থেকে শুরু হয়নি।
ইতিহাস অনুসারে বাংলা সনের প্রবর্তনের সময় ধরা হয় ১৫৫৬ সাল থেকে, প্রবক্তা ছিলেন মুঘল সম্রাট জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবর। ওই সালেই তিনি দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে আদিল শাহ শূরের সেনাপতি হিমুকে পরাজিত করে দিল্লীর সিংহাসনে বসেছিলেন।
সে সময়ের কৃষকদের কাছে এটি ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত হয়, যা পরে ‘বাংলা সন’ বা ‘বঙ্গাব্দ’ হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেই সময়ে প্রচলিত রাজকীয় সন ছিল ‘হিজরি সন’, যা চন্দ্রসন হওয়ার প্রতি বছর একই মাসে খাজনা আদায় সম্ভব হতো না।
এ কারণে সম্রাট আকবর একটি সৌরভিত্তিক সন প্রচলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন, যা কৃষকদের ফসল উৎপাদনের সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। নতুন এই সাল আকবরের রাজত্বের ২৯তম বর্ষে চালু হলেও তা গণনা আরম্ভ হয় ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকেই, কারণ ওই দিনেই দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে তিনি হিমুকে পরাজিত করেছিলেন।
যেভাবে হল বাংলা মাসগুলির নামাকরণ
প্রথমদিকে মাসের নাম ছিল ফারওয়ারদিন, খোরদাদ, তীর, মুরদাদ, শাহরিয়ার, আবান, আযার, দে, বাহমান ইত্যাদি। পরে নাক্ষত্রিক নিয়মে বাংলা সনের মাসগুলোর নামকরণ করা হয়। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন এই নামগুলো নেওয়া হয়েছে ৭৮ খ্রিস্টাব্দে সাকা জাতির রাজত্বের সময় প্রচলিত শাকাব্দ থেকে:
১. বিশাখা থেকে বৈশাখ। ২. জাইষ্ঠা থেকে জৈষ্ঠ্য। ৩. আষাঢ়া থেকে আষাঢ়। ৪. শ্রাবনা থেকে শ্রাবন। ৫. ভাদ্রপাদা থেকে ভাদ্র। ৬. আশ্বিনী থেকে আশ্বিন। ৭. কৃতিকা থেকে কার্তিক। ৮. পুস্যা থেকে পৌষ। ৯. আগ্রৈহনী থেকে আগ্রহায়ণ। ১০. মাঘা থেকে মাঘ। ১১. ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন। ১২. চিত্রা থেকে চৈত্র
বাংলাসনের প্রথম বছর ছিল ৯৬৩ হিজরি। এর আগে কোনো বাংলাসন নেই।
সঠিক হিসাবের জন্য পরিবর্তিত বাংলা সালের দৈর্ঘ্য হয় ৩৬৫ দিন। কিন্তু পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড লাগে। এই ঘাটতি দূর করার জন্য গ্রেগরিয়ান সালে প্রতি চার বছর পর পর ফেব্রুয়ারি মাসের সঙ্গে একদিন যোগ করা হয় (শুধু যে শত বছর ৪০০ দিয়ে ভাগ হয় সে বছর যোগ করা হয় না)।
শুরুর দিকে বাংলা সাল এই অতিরিক্ত সময়কে গণনায় নেয়নি। পরে এই ঘাটতি দূর করার জন্য বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে এবং মুহাম্মদ শহীদুল্লাহের পরিচালনায় একটা কমিটি গঠন করা হয় ১৯৬৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। ১৯৮৮ সালের ১৯ জুন থেকে বাংলা একাডেমির সুপারিশ করা পঞ্জিকা গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালন করা হয়।
যেমন ছিল প্রাচীন বর্ষবরণ
বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, সম্রাট আকবরের অনুকরণে বৈশাখের প্রথম দিন সুবেদার ইসলাম চিশতি তাঁর বাসভবনরে সামনে সব প্রজার শুভ কামনা করে মিষ্টি বিতরণ এবং আনুষাঙ্গিক উৎসব পালন করতেন। সেখানে সমাজের সকল স্তরের মানুষ উপস্থিত থাকত। প্রজাদের খাজনা আদায় ও হিসাব-নিকাশের পাশাপাশি চলত গান-বাজনা, গরু-মোষের লড়াই, কাবাডি খেলা ও হালখাতা অনুষ্ঠান।
পরে ঢাকা শহরে মিটর্ফোডের নলগোলার ভাওয়াল রাজার কাচারিবাড়ি, বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী ঢাকার নবাবদের আহসান মঞ্জিল, ফরাশগঞ্জের রূপলাল হাউস, পাটুয়াটুলীর জমিদার ওয়াইযের নীলকুঠির সামনে প্রতি পহেলা বৈশাখে রাজ পুণ্যাহ অনুষ্ঠান হত।
প্রজারা নতুন জামাকাপড় পরে জমিদারবাড়ি খাজনা দিতে আসত। জমিদাররা আঙিনায় নেমে এসে প্রজাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতেন। সবশেষে ভোজপর্ব দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হত।
কালের পরিবর্তনে পহেলে বৈশাখ ‘খাজনা আদায়ে’র জন্য নির্ধারিত দিন থেকে বাঙালিদের নুতন বছরের পদার্পণের উৎসবের ঐতিহ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে।
এরপর আবার পহেলা বৈশাখ উদযাপনের খবর পাওয়া যায় ১৯৩৮ সালে, তখন তা ছিল ব্রিটিশবিরোধী চেতনার অংশ। তবে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি বাংলায়।
রবি ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গানের মধ্যে দিয়ে স্বাগত জানায় বৈশাখকে। সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে।
১৯৭২ সালের পর থেকেই এটি জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃত হয়। ১৯৮০ সালে এর সঙ্গে যোগ হয় চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা।