বাগান হতে পারে ছাদে, বারান্দায়, সিঁড়ির কিনারায়, জানালার পাশে, টি টেবিলের উপরে অথবা বাথরুমের ভেন্টিলেটরেও।
শহুরে পরিবেশে বাগান করার বিভিন্ন সম্ভাবনা নিয়ে কিছু তথ্য ও পরামর্শ দিয়েছেন শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এএফএম জামাল উদ্দিন।
ছাদে বাগান করার আগে
ধারণ ক্ষমতা: আমরা মনে করি মাটির আর কত ওজন হবে। তবে আপনি যদি একটা বাগান বা বড় গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেন তাহলে যে পরিমাণে মাটি লাগবে তার ওজন নেহায়েত কম নয়। নিয়মিত গাছে পানি দেওয়ার ফলে ভেজা মাটির ওজন আরও বেড়ে যায়।
তাই যখন ছাদে বাগান করার পরিকল্পনা করবেন অবশ্যই জেনে নেবেন ছাদের ধারণ ক্ষমতা কতটুকু। যেন পরে বাড়ির কোনো ক্ষতি না হয়।
বাড়ির ধারণ ক্ষমতার উপর নির্ধারণ করতে হবে কোন ধরনের গাছ লাগানো সম্ভব। কোনো কারণে যদি ধারণ ক্ষমতা কম হয় তাহলেও চিন্তার কিছু নেই। অল্প মাটিতে ছোট গুল্মজাতীয় গাছের বাগান করাও সম্ভব।
বাগানের গাছ বাছাই করতে হবে রোদের অবস্থানের উপর নির্ভর করে। সাধারণত ছাদে সরাসরি সূর্যের আলো অনেক সময় ধরে পাওয়া যায়। তাই সবজির চাষ করা বেশ সুবিধাজনক। তবে রেলিংযের অবস্থান বা পাশের বাড়ির উচ্চতার কারণে বাগানে ছায়া পড়তে পারে। এক্ষেত্রে সারাদিনে কতক্ষণ এবং কোনদিকে বেশি রোদ পাওয়া যাবে এসব বিবেচনা করে তারপর বাগানের নকশা করতে হবে।
বাতাসের দিক: সাধারণ বাগানের থেকে ছাদের বাগানে বাতাসের চলাচল একটু বেশিই হয়ে থাকে। এমনিতে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল সব ধরনের গাছের জন্যই ভালো। তবে অতিরিক্ত বাতাস গাছের আর্দ্রতা কমিয়ে দেয়। এছাড়াও ঝড়ো বাতাসে গাছ নুয়ে পড়তে পারে। তাই ছাদে বাগানের নকশায় রোদের অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের দিকও বিবেচনায় রাখা দরকার।
ছাদ যদি খুব উঁচুতে হয় এবং আশপাশে আর কোনো উঁচু দালান না থাকে তবে বাতাসের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য বেড়া দিতে হবে। বাতাস যেন মাটির আর্দ্রতাও কেড়ে না নেয় তা নিশ্চিত করতে মাটির উপর খড়ের বা প্লাস্টিক চাদরের আবরণও দিতে পারেন।
যদি টবে গাছ বোনা হয় তাহলে এর নিচে আরও একটি মাটির ট্রে রাখা হয়। এটি অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত নয়। উপরন্তু মাটির ট্রে পানি শোষণ করে সেটিকে ছাদের মেঝেতেই পৌঁছে দেয়। সবচেয়ে ভালো হয় যদি ছাদের মেঝেতে পানি নিরোধক কোনো রং, টাইলস বা আলকাতরার একটা স্তর তৈরি করে তার উপরে যথাযথ একটা নিষ্কাশন নালার ব্যবস্থা করা যায়। নালার উপরে একটা ছাঁকনি রাখা যেতে পারে। এতে পানির সঙ্গে ধুয়ে যাওয়া মাটি নিষ্কাশন নালা বা ছাদে না পড়ে ছাঁকনিতে আটকে থাকবে। এভাবে মাটি এবং ছাদ উভয়ের ক্ষয় রোধ করা যাবে।
অনেকেই পানি নিষ্কাশনের জন্য ছাদের এক কিনারা সামান্য ঢালু রাখেন এটিও বেশ ভালো উপায়। তবে কিছুতেই ছাদের কোনো কিনারা ভেঙে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা যাবে না। এতে স্থাপনার বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
বাগান করা
মাটি দেওয়া: ছাদের বাগানে দুভাবে মাটি স্থাপন করা যায়। কোনো পাত্র বা টবের মধ্যে অথবা ছাদকে পানিরোধী করে সরাসরি মাটি ফেলে।
দ্বিতীয় ক্ষেত্রে পানি নিষ্কাশন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। প্রথম ক্ষেত্রে ছোট ছোট টব বাছাই না করে বড় ট্রে বা প্লাস্টিকের বাক্স নেওয়া যেতে পারে। অনেকেই সিমেন্টে ঢালাই করা বড় টব বানিয়ে নেন। তবে এ ধরণের টবের ওজন অনেক বেশি হয় ফলে ছাদের ধারণ ক্ষমতার বড় অংশই কংক্রিটের টব দখল করে ফেলে।
টব বা সরাসরি মেঝে যেভাবেই মাটি ফেলা হোক না কেন, মাটির ধরণ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সাবধান হতে হবে। ছাদের বাগানের মাটি এমন হতে হবে যেন তা হালকাও হয় এবং পানিও ধরে রাখতে পারে।
বেলে মাটির সঙ্গে সবুজ সার মিলিয়ে তৈরি করা মাটিই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হয়।
লম্বা কাণ্ডের কম ডালপালার গাছের অসুবিধা হচ্ছে এই ধরনের গাছ অল্প বাতাসেই নুয়ে যাওয়ার বা কাণ্ড ভেঙে যেতে পারে। ছাদে বোনার জন্য লতানো এবং কম উচ্চতার গাছ নেওয়া সবদিক দিয়ে ভালো সিদ্ধান্ত।
যেসব গাছের শিকড় বেশি গভীরে প্রবেশ করে সেসব গাছও ছাদের বাগানে লাগাবেন না। শিকড় পাশের দিকে বেশি ছড়ায় এমন গাছই ছাদের বাগানের জন্য উৎকৃষ্ট।
ছাদের বাগানে লাগানোর মতো কিছু গাছ
ফল: পেয়ারা, পেঁপে, কলা ইত্যাদি হালকা ওজনের গাছ লাগানো যেতে পারে। বড় গাছ যেমন আম বা লিচু লাগালে গাছের আকার যতটা সম্ভব ছোট হতে হবে। এছাড়াও আঙুরের মতো লতানো বা স্ট্রবেরির মতো একদম মাটিতেই জন্মানো গাছ বেছে নেওয়া যেতে পারে।
সবজি: প্রায় সব ধরনের সবজিই ছাদের বাগানে বোনা যায়। সব ধরনের শাক, লতানো-সবজি যেমন লাউ, কুমড়া, শিম থেকে শুরু করে মূলা, গাজর, ফুলকপি, ব্রোকলি, ক্যাপসিকাম, মরিচ বেগুন সবই বোনা সম্ভব।
ফুল: ফুলের বড় গাছ এড়িয়ে যে কোনো ধরনেরর ছোট ফুলের গাছ লাগানো যায়। গোলাপ, গাদা, বেলির মতো ছোট গাছের ফুল অথবা অপরাজিতা, মর্নিং গ্লোরি ইত্যাদি লতানো গাছ বেড়া তুলে দিয়ে চাষ করা সম্ভব।
ছাদের গাছের যত্নের মূল বিষয় হচ্ছে পর্যাপ্ত সূর্যলোক এবং পর্যাপ্ত পানি। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় মাটির আর্দ্রতা দেখে পানি দিতে হবে। এছাড়াও ছাদের গাছে পোকা মাকড়ের আক্রমণ কম হলেও পাখি এবং বাদুরের উৎপাত খুব বেশি হয়। পাখির আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য ফল বা সবজির উপর জাল দিয়ে দেওয়া যায়।
এত পরিশ্রমের পরে নিজের বাগানে যখন ফুল ফল আসে তখন মন খুশিতে ভরে ওঠে। গাছের যত্ন একজন করলেও ফসলের খুশি পৌঁছে যায় সবার কাছে। যান্ত্রিক জীবনে সবুজের আনন্দ ছুঁয়ে যাবে সকলের হৃদয়। ধোঁয়া দূষণের শহরে প্রতিটি বাড়ির ছাদ হবে একটি করে অক্সিজেনের ছোট্ট কারখানা। এভাবেই হয়তো দূষণ থেকে শহরকে রক্ষা করার সামান্য একটি অবদান রাখতে পারি আমরা সবাই।
ছবি: আব্দুল মান্নান।