ঢাবি’তে উদরপূর্তি

অভিজাত রেস্তোরাঁ নেই তবে আড্ডা দিতে আসা অসংখ্য মানুষের মুখ চালু রাখতে আছে নানান ধরনের মুখরোচক খাবার।

তানভীর মাহমুদ নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Dec 2015, 08:32 AM
Updated : 6 Feb 2016, 10:58 AM

শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, বহু মানুষ এখানে আসেন বিভিন্ন খাবারের স্বাদ নিতে। পরিচিত ক্যান্টিনগুলো ছাড়াও কোনো কোনো খাবার জনপ্রিয়তা পেয়েছে বিক্রেতার নামে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলের এসব খাবার নিয়েই এই আয়োজন।

টিএসসি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের তারুণ্যের প্রাণ কেন্দ্র বলা চলে টিএসসি বা ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রকে। উঠতি কবি, সাহিত্যিক আর রাজনীতিবিদদের আড্ডা যখন এই টিএসসি, তখন সেখানে চা কিংবা চায়ের কাপে তুমুল ঝড় ছাড়া কিছু ভাবাই যায় না।

রং চা আর দুধ চায়ের পাশাপাশি হরেক স্বাদের চা-বিলাসীদের জন্য টিএসসিতে আছে শাহাবুদ্দিনের চায়ের দোকান। মূল্যতালিকায় ‘কণা টি স্টোর’ লেখা থাকলেও শাহাবুদ্দিনের চা নামেই বেশি পরিচিত দোকানটি।

টিএসসি চত্বরের সীমানা প্রাচীরের উপরের এই দোকান বসে সকাল ৭টায়, চলে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত। মিলবে মালটোভা চা, আদা, লেবু ও পুদিনা পাতার রং চা, টক, ঝাল, মিষ্টি চা, মালটা রং চা, কফি চা, গুড়ের চা, আপেল চা, মিক্সচার চা ।

শীতের সময় সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে জলপাই চা, দাম ছয় থেকে ১০ টাকা।

শাহাবুদ্দিনের চায়ের দোকানের ঠিক পাশেই আছে ইউনূস মামার চায়ের দোকান। প্রায় ৩০ বছর ধরে চলছে তার এই ব্যবসা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মুখে শোনা যায়, স্বয়ং কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহও এই চায়ের দোকানে এসে নিয়মিত চা খেতেন।

হাকিম চত্বর।

শাহাবুদ্দিনের চা আর ইউনূস মামার চা ছাড়াও টিএসসির সীমানা ঘেঁষে আরও কয়েকটি চায়ের দোকান আছে। এছাড়াও টিএসসির ভেতরের ক্যাফেটেরিয়ায় পাবেন ঐতিহ্যবাহী এক টাকার চা। ক্যাফেটেরিয়ায় আরও পাওয়া যায় শিঙাড়া (৩ টাকা), ফ্রাইড রাইস(২০ টাকা), প্যাটিস(৭ টাকা)।

এছাড়াও টিএসসির প্রাঙ্গনে অহরহই পাওয়া যাচ্ছে চানাচুর, বাদাম, ঝালমুড়ি, পানি পুরি, ঝাল পেয়ারা ইত্যাদি। তবে এদের মধ্যে অন্যতম আকর্ষণ পানি পুরী। মূলত এটি এক ধরনের ফুচকা। তবে পার্থক্য হল আকারে ছোট এবং আলাদাভাবে টক দেওয়ার পরিবর্তে তেঁতুলে টকের মধ্যেই ডোবানো থাকে ফুচকাগুলো। দাম এক বাটি ২০ টাকা।

হাকিম চত্বর: আড্ডার দিক থেকে টিএসসির পরে আসে হাকিম চত্বরের নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার সংলগ্ন জায়গার নামই হাকিম চত্বর। এর নামকরণ করা হয় 'হাকিম ভাই'য়ের নামানুসারে।

১৯৬৭ সালে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির পাশে নিজের চায়ের দোকান নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন হাকিম নামের ১৫ বছর বয়সি ছেলে। আশপাশে তেমন কোনো চায়ের দোকান না থাকায় সে সময় সমস্ত আড্ডা ছিল হাকিমের চায়ের দোকান কেন্দ্রিক। পাশাপাশি আন্তরিক ব্যবহার আর বাকিতে চা খাওয়ানোর সুনামে পুরো ক্যাম্পাসে 'হাকিম ভাই' নামে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠেন তিনি। তার দোকানটি ছিল সেসময়কার উঠতি নেতা-কর্মীদের আড্ডা ও রাজনৈতিক আলাপের স্থান। হাকিম ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে এই চত্বরের নামকরণ করা হয় তার নামে।

হাকিম চত্বর।

হাকিম ভাই আজ না থাকলেও সেখানে আছে তিনটি খাবারের দোকান। গ্রন্থাগারে পড়াশুনার ফাঁকে পড়ুয়ারা এসব দোকানেই চা-নাস্তা ও দুপুরের খাবার সেরে নেন। একটি দোকান গ্রন্থাগারের সদর দরজা বরাবর, দ্বিতীয়টি চত্বরের গেটের কাছে রোকেয়া হলের বিপরীতে, তৃতীয়টি মিলন চত্বরের দিকে, রাজু ভাস্কর্যের বিপরীতে। তিনটি দোকানেই খাবারের ধরণ ও দাম মোটামুটি একই।

গ্রন্থাগারের সামনের দোকানে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে স্যান্ডউইচ, পাটিসাপটা ইত্যাদি হালকা খাবার পাওয়া যায়।

মূল বিক্রি শুরু হয় সকাল সাড়ে ১০টার দিকে। এর মধ্যে আছে ডিম চপ, চিংড়ি চপ, টোস্ট, পাকোড়া, মাশরুম চপ, চিকেন ফ্রাই, ভেজিটেবল বান, দাম ৫ থেকে ২০ টাকা। এছাড়াও আছে লাচ্ছি ২৫ টাকা ও পেঁপের জুস ৩০ টাকা। দোকান খোলা থাকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত।

হাকিম চত্বরের বিশেষ সুনাম আছে খিচুড়ি আর ফ্রাইড রাইসের জন্য। পাওয়া যায় দুপুর ১২টা থেকে ২টার মধ্যে। খিচুড়ি প্রতি প্লেট ৩০ টাকা, ফ্রাইড রাইস ৩৫ টাকা। পার্সেলও নেওয়া যায়।

কবির মামার পানিপুরি।

ডাকসু ক্যান্টিন:
বাংলাদেশের মিনি পার্লামেন্ট বা দ্বিতীয় সংসদ নামে খ্যাত ছিল ডাকসু। এককালের জাতীয় নেতা তৈরির সূতিকাগার ডাকসু এখন কার্যত অচল থাকলেও অচল হয়নি ক্যান্টিনটি। এখানকার বিখ্যাত খাবার হল এক টাকার চা আর খিচুড়ি। খিচুড়ির দাম প্লেট প্রতি ২০ টাকা, পাওয়া যাবে সাড়ে ১২টা থেকে ২টার মধ্যে।

কবির মামার পানিপুরি: ডাকসু ক্যান্টিনের ঠিক পাশেই পাওয়া যায় কবির মামার পানিপুরি। প্রতি প্লেট ২০ টাকা, পাওয়া যায় সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত।

মধুর ক্যান্টিন: মধুসূদন দে বা মধু দা’র ক্যান্টিন ছিল মুক্তিযুদ্ধ পুর্ববর্তী সময়ের ছাত্র রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, তাই ৭১ সালে মধুদা’কে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। মধুদা’র জীবদ্দশাতেই তার এই রেস্তোরাঁ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল মধুর রেস্তোরাঁ বা মধুর ক্যান্টিন নামে। মধুর ক্যান্টিনের খাবার সাধাসিধে হলেও সেখানকার ছানা মিষ্টি আর রসগোল্লা চেখে না দেখলে ভুল করবেন।

ছানা মিষ্টি এক প্লেট ২০ টাকা, রসগোল্লা প্রতিটি ৫ টাকা।

শ্যাডো ক্যান্টিন: লেকচার থিয়েটার ভবনের পাশ দিয়ে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের দিকে যাওয়ার পথে হাতের বামে পড়বে এই খাবারের দোকান। বলে রাখা ভালো ক্যান্টিনের লাগোয়া একটি গাড়ি রাখার শেইড ও তার বিপরীতে শেইড দেওয়া সাইকেলের স্ট্যান্ড থাকার কারণেই সম্ভবত এই ক্যান্টিনের নাম শ্যাডো ক্যান্টিন।

শ্যাডো আইসক্রিম।

এখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয়র নাম লেবুর শরবত, লেমনেইডও বলা হয়। মাত্র ১০ টাকা এই ‘লেমনেইড’ গ্রীষ্মকালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনের বহুল কাঙ্ক্ষিত একটি পানীয়র। এছাড়াও পাওয়া যায় ৫ টাকার দুধ চা ও ১৫ টাকার কফি।

শ্যাডো ক্যান্টিনের আরেকটি জনপ্রিয় খাবার হচ্ছে ডাল-লুচি। প্রতি প্লেটের দাম ১০ টাকা। পাওয়া যায় বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। এছাড়া সুলভ মূল্যে পাওয়া যায় ভেজিটেবল রোল, পাটিসাপটা, পিৎজা, বার্গার, হটডগসহ বিভিন্ন ফাস্টফুড।

ক্যান্টিন খোলা হয় সকাল সাড়ে ৭টার দিকে, খোলা থাকে রাত সাড়ে ৯টা-১০টা পর্যন্ত।

শ্যাডোর আইসক্রিম: শ্যাডো ক্যান্টিনের অংশ না হয়েও বেশ বিখ্যাত হয়ে উঠেছে ‘শ্যাডোর আইসক্রিম’। শ্যাডো ক্যান্টিনের ঠিক বিপরীত দিকে একটি বিশেষ আইসক্রিমের মেশিন নিয়ে বসেন একজন আইসক্রিম বিক্রেতা। সেখান থেকে আইসক্রিম বের করে, তা কোন-আইসক্রিম আকারে বিক্রি করেন তিনি। বসেন সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। চমৎকার স্বাদের কারণে অল্প দিনেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই শ্যাডোর আইসক্রিম।

প্রতিটি কোন-আইসক্রিম ২০ টাকা।

চারুকলার সামনের চিকেন ফ্রাই: ইন্সটিটিউটের গেটের সামনে একটি ভ্যানগাড়িতে প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বিক্রি হয় চিকেন ফ্রাই। এছাড়াও আছে আলুর চপ ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। চিকেন ফ্রাই প্রতিটি ১০ টাকা, আলুর চপ ৫ টাকা, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই প্লেট প্রতি ২৫ টাকা।

চারুকলার সামনের চিকেন ফ্রাই।

ছবির হাট:
চারুকলার ইন্সটিটিউটের বিপরীতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশ পথে অবস্থিত ছবির হাট নামে পরিচিত জায়গাতেও বসে মুখরোচক সব খাবারের পসরা। দুপুর তিনটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত পাওয়া যায় এসব খাবার।

এর মধ্যে আছে পাকোড়া (৫ টাকা), আলুর চপ (৫ টাকা), মাশরুম চপ (৫ টাকা), ডিম চপ (৫ টাকা), পুদিনা পাতার চপ (৫ টাকা)সহ হরেক রকমের খাবার।

কার্জন হল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবিচ্ছেদ্য ইতিহাস জড়িয়ে আছে কার্জন হল ঘিরে। হলের ভেতরে চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ভবনগুলোর প্রাচীন নকশা ও নিজস্বতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরানো ঐতিহ্য আজও স্বগর্বে ঘোষণা করে চলেছে।

কার্জন হল এলাকার একটি উল্লেখযোগ্য খাবার হচ্ছে, আলুপুরি। হলের শেষ মাথায় বায়োকেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের পেছনে সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে একটি টং দোকানে এই পুরি বিক্রি হয়। পাওয়া যায় সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। আলু পুরি প্রতিটি ৫ টাকা।

এছাড়াও শহীদুল্লাহ হল সংলগ্ন পুকুর পাড়ের শেইড দেওয়া খাবারের দোকানগুলোতে পাওয়া যায় বিভিন্ন মৌসুমি ফলের জুস। যেমন এখন পাওয়া যাচ্ছে, আনারসের জুস ও পেঁপের জুস। গ্লাস প্রতি ২০ টাকা।

কার্জন হলের বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে আরও অনেক স্থায়ী ও অস্থায়ী খাবারের দোকান।

এফবিএস ফুডকোর্ট।

এফবিএস ফুডকোর্ট:
যদি একই সঙ্গে স্বাস্থ্যসম্মত ও একটু দামি বিদেশি খাবার খেতে চান এবং হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকে তাহলে যেতে পারেন এফবিএস বা ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ‘ফুডকোর্ট’য়ে। কুক, বাবুর্চি- ইত্যাদি স্বনামধন্য খাবারের দোকানের শাখা আছে এফবিএস ক্যান্টিনে। এসব দোকানে পাবেন কফি, জুসসহ বিভিন্ন বিদেশি খাবার, যার মধ্যে আছে বিভিন্ন থাই ও চাইনিজ খাবার।

ডাস চত্বর: টিএসসির বিপরীতে ভাস্কর শামীম শিকদারের ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’ নামক ভাস্কর্যের সঙ্গেই আছে ডাস ক্যান্টিন। সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খোলা থাকে। পাওয়া যায় লাচ্ছি, ৩৫ টাকা। কোল্ড কফি, ৩৫ টাকা)। এর বাইরেও আছে বিভিন্ন স্ন্যাকস ও ফাস্টফুড।

ছবি: আব্দুল মান্নান।