পিঁপড়ে ও অহংকারী রাজা

এক ছিলেন রাজা। পশুপাখি শিকার করা তার শখ। প্রতি সপ্তাহে তিনি শিকার করতে চলে যেতেন বনে। সঙ্গে থাকে রাজার দেহরক্ষী আর পাইক-পেয়াদা।

>> বিএম বরকতউল্লাহ্বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 June 2014, 10:11 AM
Updated : 4 June 2014, 10:11 AM

একদিন একটা পিঁপড়ে এসে বলল, “রাজামশাই, আমরা অতি ছোট্ট প্রাণী। এ বনে আমরা আমাদের মতো করে চলি-ফিরি। কিন্তু আপনি এ বনে এসে আমাদের অনেক বড় ক্ষতি করছেন। আমরা কী অপরাধ করেছি, রাজামশাই?”

রাজা নিচের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কে? কে কথা বলে?”

পিঁপড়েটি মাথা উঁচু করে বলল, “রাজামশাই, আমি পিঁপড়ে কথা বলছি।”

“কী ক্ষতি করছি আমি, শুনি?”

“আপনি যখন এ বনে শিকার করতে আসেন, তখন আপনার ও আপনার সঙ্গীদের পায়ের নিচে পড়ে অসংখ্য পিঁপড়ে মারা পড়ে। এভাবে চলতে থাকলে আমরা বাঁচব কীভাবে, রাজামশাই?”

রাজা ধমক দিয়ে বললেন, “আমি হলাম রাজা। শিকার করা আমার শখ। তোর মতো ছোট পিঁপড়ের জন্য কি আমি শিকার করা বন্ধ করে দেব?”

“আমরা ছোট্ট বলে এত অবহেলা করবেন না, রাজামশাই। আমরা তো আপনার কোনো উপকারেও আসতে পারি।”

একথা শুনে রাজা হো-হো করে হাসতে শুরু করলেন। হাসতে হাসতেই বললেন, “তোরা করবি আমার উপকার? হা-হা-হা।”

“তাহলে আপনার এত বড় রাজ্যে কি আমাদের একটুও মূল্য নেই?”

“তোদের আবার কীসের মূল্য-মর্যাদা! তোরা এমনই এক অকেজো আর কমজোর প্রাণী, তোরা কোনো উপকার করতে পারিস না; এমনকি কোনো ক্ষতিও করতে পারিস না। তোরা পায়ের নিচে পড়ে মরলে আমাদের কিছুই যায়-আসে না।”

“উপকার না করতে পারি, তবে অপকার তো করতে পারি আমরা?”

এ কথা বলেই পিঁপড়েটি পটাপট রাজার পায়ে কুট্টুস করে বসিয়ে দিল কামড়। রাজা ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে বললেন, “এত বড় সাহস তোর। আমার পায়ে কামড় বসিয়ে দিলি? আমি কোনো শত্রুকে বাঁচিয়ে রাখি না। এই নে তোর পুরস্কার।”

রাজা পা দিয়ে পিষে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ফেললেন পিঁপড়েটিকে।

এ পিঁপড়েটির মৃত্যুতে অন্য পিঁপড়েরা খুব কষ্ট পেল। তারা পরামর্শ করতে বসল-- এখন কী করা যায়?

তারা গেল পিঁপড়েরানির কাছে। খুলে বলল সব।

পিঁপড়েরানি বললেন, “আমরা কারও কোনো ক্ষতি করি না-- উপকার করি না বলে, আমাদের কোনো দাম নেই? এখন আমাদের একটা কিছু করে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, আমাদেরও প্রয়োজন আছে। আমাদেরও জোর আছে, বুদ্ধি আছে। ইচ্ছা করলে কিছু একটা করতে পারি আমরা।”

অন্য পিঁপড়েরা বলল, “তাহলে আমরা এখন কী করতে পারি, রানিমা?”

“আগে আমাদের এ পিঁপড়ে মারার প্রতিশোধ নিতে হবে।”

যেমন কথা তেমন কাজ।

দল বেঁধে পিঁপড়েরা চলল রাজপ্রাসাদের দিকে। অসংখ্য পিঁপড়ে অসংখ্য দলে লেজ তুলে চোটেপাটে হেঁটে চলল।

গভীর রাত। রাজা-রানি ঘুমিয়ে আছেন। রাজা ধড়ফড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে হাতে-পায়ে চুলকাতে লাগলেন। অসহ্য হয়ে বাতি জ্বাললেন। দেখেন, পিঁপড়েরা দলবেধে তাঁকেই আক্রমণ করছে। সহ্য না করতে পেরে চিৎকার চেঁচামেচি করতে লাগলেন রাজা। রানি লাফিয়ে উঠে বললেন, “কী হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেন, রাজামশাই?”

রাজা আঙুলে পিঁপড়ের দল দেখিয়ে বললেন, “দেখো, দেখো অবস্থা। ছোট ছোট পিঁপড়েরা কত ভয়ংকরভাবে কামড়াচ্ছে আমাকে। উফ! কী যন্ত্রণারে বাবা! আমাকে বাঁচাও।”

রানি দুহাতে সমানে পিঁপড়ে মারতে লাগলেন। একটা মারেন তো দশটা এসে কুট্টুস কুট্টুস করে কামড়ায়। রাজার সঙ্গে সঙ্গে রানিও লাফালাফি শুরু করে দিলেন। তারপর ডাকতে লাগলেন চাকর-বাকরদের। দৌড়ে এল সবাই। এসে দেখে, রাজা নাচছে আর সমস্ত শরীর চুলকাচ্ছে। রানি ভয়ে পালঙ্কে পা তুলে বসে আছেন।

মন্ত্রী, পাইক-পেয়াদা সবাই ছুটে এল। বলল, “রাজামশাই, আপনার কী হয়েছে? এমন করছেন কেন?”

রাজা বলল, “আমার সমস্ত শরীরে পিঁপড়েরা সমানে কামড়াচ্ছে। কুট-কুট-কুট। জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে শরীর। উফ্, আহ্।”

তারা রাজার পিঠ-পেট চুলকে দিতে লাগলেন। কিন্তু রাজা আর থামেন না। নাচতে নাচতে পোশাক খুলে ফেললেন। চাকররা তাঁর শরীর ডলতে লাগল। পিঁপড়ের কামড়ে সমস্ত শরীর লাল হয়ে গেছে।

রাজা হঠাৎ হঠাৎ লাফিয়ে ওঠেন আর বলেন, “সহ্য হচ্ছে না। আর সহ্য হচ্ছে না আমার। এত জ্বালা, এত যন্ত্রণা! ওরে, আমাকে বাঁচা। আমাকে খেয়ে ফেলল।”

পরেরদিন রাজদরবারে বসলেন রাজা। বৈঠকে কথা বলছেন। হঠাৎ করে তিনি লাফিয়ে উঠলেন।

“ব্যাপার কী?”

রাজা মুখ বাঁকিয়ে, পিঠ বাঁকিয়ে, এঁকেবেঁকে চুলকাতে লাগলেন। কোনো আলাপই করতে পারছেন না। পিঁপড়েরা রাজার পকেটে, হাতের চিপায়, পায়ের চিপায়, বগলতলায়, কানের চিপায়, জুতোর ভেতরে ছোটাছুটি করে এমনভাবে কামড়াতে লাগল যে, আর বসে থাকার উপায় নেই। চুলকাতে চুলকাতে রাজা দৌড়ে গিয়ে পড়লেন সামনের এক দিঘির জলে।

এমনি ঘটনা ঘটতে লাগল বারবার। পিঁপড়েরা খালি রাজাকেই কামড়ায়। আর কাউকে কামড়ায় না। রাজার এ বিপদ দেখে ডাকা হল কবিরাজ আর বৈদ্যকে। তারা বলল, “রাজার পোশাক পুড়িয়ে ফেলতে হবে।”

পুড়িয়ে ফেলা হল পোশাক। নতুন পোশাক এল। কিন্তু এ পোশাক পরেও শান্তি নেই। অসংখ্য পিঁপড়ে বসে আছে সমস্ত পোশাকের পরতে পরতে। পোশাক পরলেই কামড়ায় কুটুরকুটুর কুট।

কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। অবশেষে মন্ত্রীদের পরামর্শে রাজপ্রাসাদে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল।

হাফ ছেড়ে বাঁচলেন রাজা। আর ঠোঁট বাঁকিয়ে বললেন, “পিঁপড়ে মশাইরা এবার কামড়াবে কীভাবে? সব তো পুড়িয়ে ছাই করে দিলাম। রাজার সঙ্গে মশকরা!”

পিঁপড়েরা আলোচনায় বসল, “আমাদের কয়েক হাজার সৈন্য মারা গেছে। তাই বলে বসে থাকলে চলবে? আমাদের সংগ্রাম চলবেই। রাজা নতুন বাড়ি বানিয়েছে। যেভাবেই হোক, সে বাড়িতে ঢুকে উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে রাজাকে।”

রাজা নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে আছেন নতুন রাজপ্রাসাদে। এমন সময় শুরু হল পিঁপড়েদের হামলা।

রাজা পিঁপড়ের কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে কাপড়-জুতো খুলে পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে লাগলেন। রাজ্যে প্রচার হয়ে গেল, “রাজা পাগল হয়ে গেছেন। উদোম হয়ে পথেঘাটে ছোটাছুটি করছেন। এ পাগলরাজা দিয়ে রাজ্য চলবে না।”

রাজা বললেন, “সামান্য পিঁপড়ের জন্য আমার এত বড় বদনাম? রাজাগিরি চলে যাবে আমার? আমি পাগল?”

তখন তিনি আদেশ দিলেন, “বনে আগুন ধরিয়ে দাও। পিঁপড়ের বংশ-- করে দেব ধ্বংস।”

রাজকর্মচারীরা বনে আগুন ধরিয়ে দিল। বন পুড়ে ছাই। কিছু পশুপাখি, পিঁপড়ে মারা গেল। আর সকলে বন থেকে পালিয়ে চলে এল লোকালয়ে। হিংস্র পশুপাখিদের দেখে রাজ্যের মানুষ ভয়ে ছোটাছুটি করতে লাগল। রাজার পাগলামি দেখে সবাই বলল, “এবার নিশ্চিত, রাজা পাগল হয়ে গেছেন। রাজ্য বাঁচাতে হলে পাগলা-রাজাকে নির্বাসনে পাঠানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”

রাজাকে এক বনে নির্বাসন দেওয়া হল।

রাজ্য আর ক্ষমতা হারিয়ে রাজা মনের দুঃখে বনে বনে ঘোরেন আর কাঁদেন।

পেটে খাবার নেই। মন বেজায় খারাপ। একটা গাছের শিকড়ে বসে আছেন তিনি। এমন সময় দেখতে পেলেন, তার সামনে দিয়ে পিঁপড়েরা লাইন ধরে হেঁটে যাচ্ছে। ওদের মুখে খাবার। রাজা পিঁপড়ে দেখে ভয়ে পা তুলে বসলেন। বললেন, “হে ভয়ংকর পিঁপড়ে, তোরা আমাকে রাজা থেকে পথের ভিখারি করেছিস। আর কী চাস তোরা এখানে?”

পিঁপড়েরা মুখ তুলে বলল, “আমরা তো বনেই থাকি। আপনি কি সেই রাজা, যে পিঁপড়েকে ছোট বলে অবহেলা করত, আর বিনা কারণে পিঁপড়েদের পায়ে পিষে মেরে আনন্দ করত? তারপর বনে আগুন ধরিয়ে সবাইকে মারতে চেয়েছিল?”

রাজা চুপ করে রইলেন।

পিঁপড়েরা বলল, “আমরা তো আপনার অনেক বড় ক্ষতি করেছি, রাজামশাই। এবার করব উপকার।”

অবাক হয়ে রাজা বললেন, “তোমরা আমার কী উপকার করবে, পিঁপড়েভাই?”

পিঁপড়েরা গাছ থেকে টাটকা ফল এনে দিল রাজার হাতে। ক্ষুধার্ত রাজা ফল খেলেন। আর লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বললেন, “দুনিয়াতে কেউই অপ্রয়োজনে আসেনি। ছোট বলেই কেউ খাটো নয়।”

রাজা তার ভুল বুঝতে পেরে আফসোস করতে লাগলেন।