ছোট্ট রাজকন্যা

রাজ্যের নাম হটেনটট। এই রাজ্যের রাজা-রানির কোনো সন্তান নেই। তাই তাদের মনে বেজায় কষ্ট। অনেকদিন পর তাদের একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছে। আনন্দ আর ধরে না। রাজা-রানি বিশাল উৎসবের আয়োজন করলেন। উৎসবের আনন্দের মাঝে রাজা তাঁর কন্যার নাম ঘোষণা করলেন-- সিতারা।

>> বিএম বরকতউল্লাহ্বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 May 2014, 11:41 AM
Updated : 9 May 2014, 11:41 AM

দেখতে দেখতে কেটে গেল পাঁচটি বছর। পরির চেয়েও সুন্দরী সিতারা যেন এক টুকরো চাঁদ। তার হাসি, তার ছোট ছোট কথা-- সবই যেন চাঁদের কণার মতো চকচকে। সে যেদিকে তাকায়, যা দেখে হাসে, যে দিকে হাত বাড়ায়, রাজা-রানি তার সবটুকু এনে দিতে চায় রাজকন্যাকে।

বনের পশুপাখি ধরে এনে খাঁচায় বন্দি করে পোষা রাজার শখ। রাজবাড়ির একটা বিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছে নানা জাতের পশুপাখির খাঁচা। রাজার আদেশে শিকারিরা বন থেকে বিভিন্ন জাতের জন্তু আর পাখি ধরে এনে দেয় রাজার কাছে। রাজা পশুপাখিদের খাঁচায় বন্দি করে পোষে। এতে বেজায় আনন্দ পান রাজা আর রানি।

রাজার পর রাজ্যশাসন করবে রাজকন্যা সিতারা। তাই রাজা-রানি প্রায়ই সিতারাকে নিয়ে যায় লোহার খাঁচায় বন্দি পশুপাখিদের কাছে। তাঁরা রাজকন্যাকে উৎসাহ নিয়ে ঘুরে-ফিরে দেখায় বন্দি পশুপাখিগুলোকে। সিতারা এখানে যতবারই আসে, দেখে, মনমরা পশুপাখিগুলো প্রাণপণ চেষ্টা করছে খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। কিন্তু শক্ত লোহার বেড়া ভাঙার ক্ষমতা নেই ওদের। তাই ওরা দিনরাত ছটফট করে। ওদের মনে কোনো সুখ নেই। রাজকন্যা সিতারা এসব দেখে খুব কষ্ট পেল। সে মনখারাপ করে করুণ চোখে বন্দি পশুপাখিদের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুই বলে না সে।

রাজা-রানি রাজকন্যার বেজার মুখ দেখে তাকে বলেন, দেখো মা, এগুলো হল রাজবাড়ির বহুদিনের পুরনো ঐতিহ্য। এটা কোনো নিষ্ঠুরতা নয় মা। যতদিন রাজ্য থাকবে, রাজা-রানি থাকবে-- ততদিন এসব বন্য পশুপাখিদের ধরে এনে এভাবেই খাঁচায় বন্দি করে পুষতে হবে মা। এটাই আমাদের রাজবাড়ির নিয়ম।

রাজকন্যা যে একদম রাজা-রানির মতো হবেন, এমন কোনো কথা নেই। সিতারা রাজা-রানির মতো হলও না। সে পশুপাখিগুলোর ছটফটানি দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠল না। সে মনখারাপ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে ফিরে গেল।

এখন সিতারা বয়স দশ বছর। বুদ্ধিমতি চটপটে ছোট্ট রাজকন্যা।

একদিন রাজকন্যা রাজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বিনয়ের সঙ্গে বলল, “বাবা লোহার খাঁচায় বন্দি পশুপাখিগুলো ছেড়ে দাও।”

ছোট্ট রাজকন্যার মুখে এই কথা! রাজা অবাক হয়ে কন্যার দিকে তাকালেন। রাজকন্যার চোখেমুখে রীতিমতো আদেশের ছাপ! প্রতিদিন যাকে সোনামণি জাদুমণি বলে আদর করেন, এ যেন সেই ছোট্ট রাজকন্যা নয়; রীতিমতো রাজকন্যা। রাজা উঠে দাঁড়ালেন। তিনি গম্ভীর সুরে বললেন, “আমি তোমার এ আবদার রক্ষা করতে পারব না, মা!”

“কেন পারবে না বাবা? বনের পশুপাখিদের খাঁচায় বন্দি করে কী সুখ পাও তোমরা? কী অপরাধ করেছে ওরা? এদের দেখে আমার খুব কষ্ট হয়। আমি ঘুমুতে পারি না। তোমার দেখাদেখি রাজ্যে অনেক প্রজা পশুপাখিদের ধরে এভাবে খাঁচায় বন্দি করে পুষছে। এর মধ্যে কী বীরত্ব আছে আমি বুঝি না। দয়া করে, তুমি এদের ছেড়ে দাও, বাবা।”

কিছুতেই রাজি হলেন না রাজা। রাজা বললেন, “তুমি রাজকন্যা। তোমার সুখের জন্য হেন কাজ নেই, আমরা করি না। আমরা যা করি, একদিন তোমাকেও তা করার দায়িত্ব নিতে হবে, মা। তোমার একটু আবেগ আর দয়ামায়ার কাছে রাজবাড়ির বহুদিনের পুরনো নিয়ম আর ঐতিহ্যকে তো ভেঙে ফেলা যাবে না। এই কথা ছাড়া তুমি আর যা বলবে, তাই করব। যা চাইবে, তাই দেব। তবু এ কথাটি আর মুখে এনো না, তুমি।”

সিতারা একটু চুপ থেকে বলল, “ঠিক আছে বাবা, এ কথা আর মুখে আনব না। তবে তুমি যে কথা দিলে-- যা বলি তাই করবে, যা চাই তাই দিবে। তুমি কি তোমার কথা রাখবে বাবা?”

রাজা খুশি হয়ে বললেন, “অবশ্যই রাখব। রাজা আদর করে সিতারা নাক টিপে দিয়ে বললেন, জানো না মা, রাজা নড়ে তো রাজার কথা নড়ে না।”

এক সপ্তাহ পরে রাজকন্যা সিতারা রাজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সে শক্তভাবে বলল, “আমাকে এক মাসের জন্য রাজার ক্ষমতা দাও।”

রাজা একটু থতমত খেয়ে গেলেন। আবার খুশি হয়ে মনে মনে বললেন, “এতটুকুন রাজকন্যা, এখনই রাজ্যভার নিতে চায়! বাহ! এই তো চাই। অন্তত, কিছু অভিজ্ঞতা তো হবে। দেখি, রাজ্যটা কেমন চালায় আমার কন্যা।”

রাজা আনন্দের সঙ্গে বলে উঠলেন, “ঠিক আছে, মা। আজ এই মুহূর্তে তোমাকে রাজার ক্ষমতা অর্পণ করলাম।” এ কথা বলেই রাজা রাজপোশাক খুলে রাজকন্যার সামনে রাখলেন। তারপর তিনি প্রজার মতো মাথা নুইয়ে ছোট্ট রাজকন্যাকে কুর্নিশ করলেন। মুহূর্তে রাজ্যময় ঘোষিত হয়ে গেল, “ছোট্ট রাজকন্যা সিতারা এক মাসের জন্য রাজ্যভার গ্রহণ করেছেন।”

রাজকন্যা সিতারা ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথমেই আদেশ করলেন, “বন্দি করা হোক এই রাজা আর রানিকে।”

যেমন আদেশ তেমন কাজ। রাজা-রানিকে বন্দি করে একটি কক্ষে নিয়ে রাখা হল। এক মাসের জন্য একটি কক্ষে বন্দি থাকতে হবে তাঁদের। বেঁচে থাকার জন্য সবকিছু দেওয়া হবে রাজা-রানিকে।

রাজা-রানি অসন্তুষ্ট হলেন। ভয়ও পেয়ে গেলেন। বললেন, “আমাদের কী অপরাধ যে, একমাস একটা কক্ষে এভাবে বন্দি থাকতে হবে? এটা কি আদৌ সম্ভব?”

সিতারা বলল, “কেন নয়? তোমাদের কোনো কিছুরই তো অভাব হবে না। যা যা দরকার, সবই তোমাদের পৌঁছে দেওয়া হবে।”

এভাবে শুরু হল রাজা-রানির বন্দিজীবন।

বাতাসের আগে আগে রাজ্যময় ছড়িয়ে পড়ল, রাজা-রানির বন্দি হওয়ার খবরটি। খবরের ডালপালা গজাল। নানা রংয়ে-ঢংয়ে খবরগুলো রাজ্যের আনাচে-কানাচে পৌঁছতেই, প্রজারা রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল। হটেনটট রাজ্যের প্রজারা বলাবলি করতে লাগল, রাজা-রানিকে বন্দি করেছে দশ বছরের রাজকন্যা সিতারা! এখন উপায়?

তিন-চারদিন যেতে না যেতেই, রাজা-রানি বন্দিদশা থেকে মুক্তি লাভের জন্য রাজকন্যাকে অনুরোধ করতে লাগলেন।

রাজকন্যা বলল, “কেন? তোমাদের যখন যা লাগছে, তখনই তাই দেওয়া হচ্ছে। তবে এখন কিসের জন্য মুক্তি চাও?”

সাতদিন পর রাজকন্যার কাছে খবর এল, রাজা-রানি তেমন খাওয়া-দাওয়া করছেন না। তাঁরা জানালার গ্রিল টেনে, দরজায় ধাক্কা মেরে বারবার মুক্তি কামনা করছেন। তাঁরা আর বন্দি থাকতে পারছেন না। রাজকন্যা এসব কথায় একদমই কান দিলেন না।

কিন্তু যতই সময় যাচ্ছে, ততই ভয়াবহ খবর আসতে লাগল রাজকন্যার কাছে। রাজা-রানি খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। একজন আরেকজনকে ধরে বেশুমার কান্নাকাটি করছেন। যাকে দেখছেন, তাকেই বকা দিচ্ছেন। আবোলতাবোলও বকছেন। তাতেও রাজকন্যা কান দিল না।

কুড়ি দিনের দিন খবর এল, রাজা রানিকে এবং রানি রাজাকে যাচ্ছেতাই বলে বকা দিচ্ছেন। ঘরের ভেতরের সবকিছু ওলটপালট করে ফেলেছেন। তাদের কাপড়-চোপড়, বিছানাপত্র, গ্লাস, প্লেট-- হাতের কাছে যা পাচ্ছেন, তাই ছুড়ে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন। নিজেদের মাথার চুল নিজেরাই টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলছেন। তাঁদের চোখে ঘুম নেই, খাওয়াদাওয়ার বালাই নেই। ঘরজুড়ে এলোমেলো ঘুরছেন আর পাগলের মতো বিলাপ করছেন। একসময় তারা মারামারি করতে শুরু করে দিলেন।

এসব শুনে রাজকন্যা সিতারা ঘরটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তাকে দেখেই রাজা-রানি দৌড়ে এসে জানালার গ্রিল ধরে পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। করজোড়ে বলতে লাগলেন, “মা আমার, সোনামণি মা, এ বন্দিজীবন আর এক মুহূর্তও ভালো লাগছে না। হয় আমাদের মুক্তি দাও, নয় মেরে ফেলো আমাদের। এখন তুমি যা বলবে তা-ই শুনব, যা চাইবে তা-ই দেব। বন্দি থাকার ভয়ংকর কষ্টের থেকে মরণও ঢের ভালো। আমাদের মুক্তি দাও, মা।”

সিতারা জ্ঞানীর মতো ঠোঁট উল্টে বলল, “মুক্তি? এক মাস না হতেই মুক্তি দেব তোমাদের? কী অনুভব করলেন, মহামান্য পশুপাখি প্রেমিক, সৌখিন রাজা এবং রানি?”

“অনেক বড় কিছু অনুভব করতে পেরেছি, মা। আর লজ্জা দিও না। আগে আমাদের মুক্তি দাও। তারপর দেখো কী করি!” বললেন রাজা।

রাজকন্যা সিতারা নিজহাতে তালা খুলে মুক্ত করে দিল রাজা আর রানিকে। তারা একলাফে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

রাজা সিতারাকে করজোড়ে বললেন, “এবার ফিরিয়ে দাও আমার রাজ্যক্ষমতা।”

রাজকন্যা কোনো কথা না বলে রাজপোশাক ফিরিয়ে দিল।

রাজা ক্ষমতা গ্রহণ করেই রাজকর্মচারীদের ডেকে আদেশ দিলেন, “তোমরা এই মুহূর্তে বন্দি পশুপাখিদের মুক্ত করে দাও। আর রাজ্যময় ঘোষণা করে দাও, যারা বন্য পশুপাখিদের ধরে এনে খাঁচায় বন্দি করে পুষছে, আজই তাদের মুক্ত করে দিতে হবে। আমরা কারও স্বাধীনতা নষ্ট করব না। সবাই মুক্ত। কেউ কাউকে জোর করে বন্দি রাখতে পারবে না।”

রাজার পক্ষ থেকে মানবতার এই আদেশ মুহূর্তে পৌঁছে গেল সকল প্রজার কাছে। রাজ্যের সবাই তড়িঘড়ি করে মুক্ত করে দিল সকল বন্দি পশুপাখিকে।

বন্দি পশুপাখিরা মুক্তির আনন্দে দিশেহারা। পশুগুলো আনন্দে হুটোপুটি করতে করতে চলে গেল বনে। আর পাখিগুলো মুক্তির আনন্দে পাখা ঝাপটে উড়তে লাগল আকাশে। মুক্তি দেওয়ার ও মুক্তি পাওয়ার আনন্দে টগবগ করছে গোটা হটেনটট রাজ্য। অসংখ্য হৃদয় থেকে বারবার উচ্চারিত হতে লাগল, “রাজকন্যা সিতারা- দীর্ঘজীবী হোক।”