নিত্যদিনের এই রুটিন থেকে বের হয়ে একটু বিনোদন পেতে তাই এর সঙ্গে যুক্ত হয় উদযাপনের নানান কিছু। কেউ রিকশা, কেউ-বা গাড়ি, কেউ পার্কে বসে-- আবার কেউ কেউ ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে ঘুরতে পছন্দ করেন। বিশেষত ঐতিহ্যবাহী উৎসবের দিনগুলোতে তাই ঢাকা শহরের বাড়তি সৌন্দর্যের সঙ্গে যুক্ত হয় বাড়তি আনন্দ-- ঘোড়ার গাড়িতে ভ্রমণ।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, অতীতে রাজা-বাদশা, আমির-ওমরাহ, জমিদাররা ঘোড়ার গাড়িকেই বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতেন। ঘোড়ার গাড়ি ছিল রণাঙ্গনের রসদ সরবরাহের প্রধান বাহন। মোটরচালিত বাহন থাকায় এখন অবশ্য রাস্তায় আর সেভাবে ঘোড়ার গাড়ি দেখা যায় না। প্রয়োজন ফুরিয়েছে, তাই বিলুপ্তির পথে এই ঐতিহ্যবাহী বাহনটি।
সভ্যতার শুরুর থেকে আধুনিক যুগের প্রথম দিক পর্যন্ত ঘোড়ার গাড়ি ছিল ভীষণ জনপ্রিয় বাহন। সম্ভবত ১৮৩০ সালে ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন হয়। তখন চলছে নবাবদের শাসনামল। এখনও পুরান ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘোড়ার গাড়ি চলতে দেখা যায়। ঈদে বা পহেলা বৈশাখে ঢাকার প্রায় সব এলাকায় চলতে দেখা যায় ঘোড়ার গাড়ি।
এখন যাত্রীরা ঘোড়ার গাড়িতে ভ্রমণ করে মূলত উপভোগ করার জন্য। এছাড়াও বিয়ে, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানগুলোতেও ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহৃত হতে দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে পুরান ঢাকার বিয়েতে ঘোড়ার গাড়ি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিয়ে উপলক্ষে ঘোড়ার গাড়িগুলো রঙিন করে সাজানো হয়। ফুলের মালা দিয়ে আর রঙিন কাগজ কেটে নকশা বানিয়ে সাজানো হয় ঘোড়া আর গাড়ি দুটোকেই।
শুধু তাই না, রূপকথা-উপকথাতেও তো আছে এই ঘোড়ার গাড়ির কথা। তারচেয়ে বেশি আছে অবশ্য ঘোড়ার গল্প; পঙ্ক্ষিরাজ ঘোড়া, রাজপুত্রের টগবগিয়ে চলা তেজী ঘোড়া।
এই ঘোড়ার গাড়ি পরবর্তীতে আমাদের সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারায়-উপাদানে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে এই ঘোড়ার গাড়িকে দেখা হয় আভিজাত্যেও প্রতীক হিসেবে। বিশেষ করে বাংলা চলচ্চিত্রে। গল্প-উপন্যাসেও যখন জমিদার বাড়ি বা চৌধুরি বাড়ির কথা আসে, চলে আসে ঘোড়ার গাড়িও।
ঘোড়ার গাড়ি অনেক জায়গায় ‘টমটম’ নামেও পরিচিত। ঘোড়ার গাড়ির যখন প্রচলন হয়, ভারতবর্ষে তখন চলছে ইংরেজ শাসন। ঢাকায়ও ঘোড়ার গাড়ি আসে তখনই। ঘোড়ার গাড়ির চলাচলের সুবিধার্থেই শহরের রাস্তা-ঘাটের সংস্কার করা হয়। প্রথমে ইট-সুরকি, সিমেন্ট-বালু পরে পিচ মোড়া ইট দিয়ে রাস্তা সংস্কারের কাজ করা হয়।
প্রথমে ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করতে শুরু করে ইংরেজরা। পাশাপাশি স্থানীয় অভিজাত শ্রেণির মানুষরা। এক সময় তা সাধারণ মানুষের মধ্যেও চলে আসে।
১৮৪৪ সালের ‘ক্যালকাটা রিভিউতে’ উল্লেখ আছে নানা ধরনের ঘোড়ার গাড়ির। এই বিভিন্ন ধরনের ঘোড়ার গাড়িগুলো সেই সব দিনে কলকাতা, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি শহরে দেখা যেত। যেমন--
১. Britzkas- ৪ চাকা বিশিষ্ট গাড়ি। তবে বসার আসন কেবল একটি।
২. Barouche- দু-আসন বিশিষ্ট গাড়ি। উপরের ছাদ সামনের দিকে বেশি ঝুঁকে থাকে।
৩. Landau- এ গাড়িটির ছাদ গুটিয়ে পেছনে ফেলে দেয়া যায়।
৪. Chariot- এটা চার চাকার হালকা গাড়ি। এই গাড়িতে একটা বাক্স থাকত এবং গাড়ির পেছনে বসার একটি আসন থাকত।
৫. Phaeton- চার চাকার খোলা গাড়ি। এক বা দুই ঘোড়া দিয়ে চালানো যেত।
৬. Buggy- দুই চাকার এক আসন বিশিষ্ট গাড়ি। এই গাড়িতে ছাদ ছিল।
৭. Brawnbery- দুই আসন বিশিষ্ট গাড়ি।
৮. Krahanchy- চার আসন বিশিষ্ট। পেছনে ফুটম্যানের দাঁড়াবার জায়গা থাকত। শক্ত ছাদ। গাড়িটি অনেকটা বাক্সের মত। দুধারে চারটি জানালা এবং দুই ঘোড়া জুড়ে চালানো হত। পরবর্তীকালে কেবল এই গাড়িটি ঢাকায় টিকে গেছে। এটাই ঢাকার গাড়ি বলে স্বীকৃতি পেয়েছে।
৯. টাঙ্গাগাড়ি
১০. এক্কাগাড়ি
ঢাকার ঘোড়ার গাড়িগুলো ছিল যাকে বলে ‘রাজকীয়’। ঘোড়াগুলোরও ছিল যেমন মসৃণ ত্বক তেমনি সুন্দর রঙ। প্রতিদিনের কাজের সময়ও কানে ফুল, মাথায় পাখির পালকের মুকুট পরিয়ে ঘোড়াকে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাস্তায় বের করা হত। জন্মাষ্টমির মিছিলের সময় তো কথাই নেই। তবে কারাচি গাড়ীর জন্য অবশ্য অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির ঘোড়ার প্রয়োজন।
ঢাকার গাড়োয়ানদের বাঁধা বেশ কিছু গান পাওয়া যায়। প্রচলিত আছে তাদের কিছু বচনও। সেগুলোতে ঘোড়ার গায়ের রং, চোখ, খুড় আর কেশরের অনেক তারিফ পাওয়া যায়।
গাড়োয়ানদের ঠাট্টা-মস্করা তো সর্বজনবিদিত। ১৯৯৪ সালে একবার উপমহাদেশের কিংবদন্তি গায়ক কুন্দনলাল সায়গল তখনকার আরমানিটোলার ‘নিউ পিকচার হাউস’-এ গান গাইতে এসেছিলেন। গলায় ফুলের মালা জড়িয়ে তিনি ট্রেন থেকে ধীরে ধীরে নামলেন। পা একটু টলমলে। তাঁকে দেখার জন্য ফুলবাড়িয়া রেল ষ্টেশনে গুণগ্রাহীদের ভিড়। জনতা যখন প্রায় বেসামাল, তখন উদ্যোক্তারা আর কয়েকজন বলিষ্ঠ যুবক তাঁকে ধরাধরি করে তাড়াতাড়ি স্টেশনের বাইরে রাখা সুসজ্জিত ‘ডেমলার’ গাড়িতে বসাতে নিয়ে এল। কিন্তু সায়গলের চোখে পড়ল একটা হাসিখুশি গাড়োয়ান; মাথায় জরির টুপি, ইসলামপুরের আদম কোচওয়ান উচ্চ¯^রে গান গাইছে আর সায়গলের দিকে তাকাচ্ছে। ইশারা করছে সম্ভ্রমে। সায়গল সবাইকে ঠেলে ফেলে দিয়ে এগিয়ে গেলেন ওই গাড়ির দিকে। কর্মকর্তারা উচ্চকণ্ঠে বলতে লাগলেন, “ওস্তাদজি, আপনার মোটরগাড়ি এই দিকে।”
সায়গল কোনো দিকে না চেয়ে, মন্ত্রমুগ্ধের মত সোজা আদমের ঘোড়ার গাড়িতে গিয়ে বসলেন। তাও আবার ভেতরের যাত্রীর আসনে না, পেছনে ফুটম্যানের আসনে গিয়ে! হুকুম করলেন সিনেমা মালিকদের গাড়ির ভেতর বসতে। সবাই হকচকিয়ে গেল। কিন্তু সায়গলের কথা অমান্য করা যায় না। সময় অপব্যয় না করে তারা গাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লেন। সায়গল পিছন থেকে চিৎকার করে বললেন-- “গাড়ি চালাও।”
ফুলবাড়িয়া স্টেশন ফেলে গাড়ি ছুটল। কোচওয়ান ঘোড়াকে চাপা স্বরে বলছে দুলকি চালে চলতে। কারণ সায়গল প্রাণখুলে গান গাইছে--
“তোমার বীণায় গান ছিল
আর আমার ডালায় ফুল ছিল গো ফুল ছিল।”
হলের মালিক মতি বোস পাশ থেকে বলে দিলেন, “টিকেট লাগবে না। শো-এর আগে পিকচার হাউসে এসে দেখা কর।”
হল লোকে লোকারণ্য। আদম একেবারে সামনের সারিতে সোফায় বসে গান শুনলো। শো শেষ হবার পর আদম স্টেজের পেছনে গেল ওস্তাদজির কাছ থেকে বিদায় নিতে। সায়গল ফিস ফিস করে ওকে কাছে ডেকে দু-চারটা শব্দ বললেন। তারপর দুজনেই বেশ হাসলেন। পা ধরে সালাম করে আদম বড়লোকদের আসর থেকে বের হল।
আদম গাড়োয়ানদের আড্ডায় এসে ওদের বলল, কী কথা হয়েছিল ওদের মাঝে, “সায়গল বোম্বাই লইয়া যাইতে চায়। আমি কইছি মাফ করবেন। এই শহর থিকা বাইর হওন বড় কলিজার কাম। আমি চইলা গেলে আমার জানের ঘোড়া ‘বাদামি’ কলিজা ফাইটা মইরা যাইব।”
শত ঝক্কিঝামেলার মাঝেও এই শহর থেকে আদম বাইরে যেতে রাজি নন। কারণ এই শহর এবং ঘোড়ার একটা অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল ঢাকার গাড়োয়ানদের কাছে। আর এই কারণে এখনও সদরঘাট-গুলিস্তানের রাস্তায় চলতে দেখা যায় ঘোড়ার গাড়ি।