চির বসন্তের শহর

চিনের কুনমিং শহর পরিচিত ‘চির বসন্তের শহর’ নামে। শহরটিকে বলা যায় প্রাকৃতিক স্থাপত্যশিল্পের এক অনুপম নিদর্শন।

>> মাহফুজুর রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Jan 2014, 12:51 PM
Updated : 5 Oct 2016, 11:54 PM

‘বহু দিন ধরে বহু পথ ঘুরে

বহু ব্যয় করে বহু দেশ ঘুরে,

দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা

দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু,

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া

ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া

একটি ধানের শীষের উপরে

একটি শিশিরবিন্দু।’

কুনমিং বাংলাদেশ থেকে বেশ কাছের একটি জায়গা। তবে পরিচয়ের হিসেবে তা বেশ দূরেরই বটে। গণচীন এক সময় বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রায় অপরিচিত একটি দেশ ছিল। অনেকদিন পর্যন্ত দেশটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিল কেবল কিছু চীনপন্থী নেতার মাধ্যমে। তারা মাও সে তুং-এর লাল বই পকেটে নিয়ে ঘুরতেন আর পিকিং থেকে ঘুরে এসে নানা কথা বলতেন। আর চীন থেকে সুন্দর সুন্দর পত্রিকা আসত বাংলাদেশের অনেকের কাছে।

ইদানিং অবশ্য পরিচয় বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকে সরাসরি চীনের বিভিন্ন শহরে ফ্লাইট যাচ্ছে। সে রকমই একটা ফ্লাইটে চড়ে আমরা কজন চীনের কুনমিং যাচ্ছি। চিনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী এই কুনমিং শহর। শহরটি পরিচিত ‘চির বসন্তের শহর’ নামে।

কুনমিং এর তিন দিকে পাহাড়, একদিকে ডায়ানচি হ্রদ। শহরটি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৬,১৮৯ ফুট (১,৮৮৬.৫ মিটার) উচ্চতায় অবস্থিত। প্রায় ২,৪০০ বছরের পুরনো এ শহরটিকে বলা যায় প্রাকৃতিক স্থাপত্যশিল্পের এক অনুপম নিদর্শন।

চায়না ইস্টার্ন-এর এই বৈকালিক ফ্লাইটটি চীন সীমান্ত পেরুতে না পেরুতেই দিনের আলো নিভে এল, সুয্যি ডুবে ডুবে। সন্ধের পরপর আমরা কুনমিং এয়ারপোর্টে নামলাম। সেখানে খাইরুল আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমরা খাইরুলের নিয়ে আসা গাড়িতে চড়ে চীনে প্রবেশ করলাম।

চীনে আমি এই প্রথম এসেছি। এর আগে বিশ্বের যে দেশেই গিয়েছি, সেখানেই চীনের পর্যটক দেখেছি। চীনের নানা জিনিস দেখেছি এবং কিনেছিও। অস্ট্রেলিয়ার পার্থে, রাশিয়ার ক্রেমলিন ভবনের সামনে, কানাডার নায়াগ্রা জলপ্রপাতের কাছে বিক্রি হয় চীনের তৈরি নানা পণ্য। ওরা সুই থেকে উড়োজাহাজ পর্যন্ত সবই বানায়। শুনেছিলাম ওদের অর্থনীতি সাঁই সাঁই করে উপরের দিকে ছুটছে। এর কিছুটা লক্ষণ দেখতে পেলাম বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার পরই। রাস্তাগুলো ঝকঝকে, প্রশস্থ, দোতলা-তিনতলা। লাইনের পর লাইনে গাড়িগুলো বিরামহীন ছুটছে। কারও যেন ব্যস্ততার শেষ নেই।

সন্ধে উতরে যাওয়ার পর আমরা পৌঁছুলাম একটি ছোট্ট শহরে। এটাকে বরং উপশহর বলাই ভালো। এখানে বাংলাদেশের কিছু যুবক বিভিন্ন ভবন ভাড়া করে হোটেল বানিয়েছেন। খুবই কম পয়সায় এরা বাংলাদেশিদের এ সব হোটেলে থাকতে ও খেতে দেন। থাকা এবং দুবেলা বাংলাদেশি ঘরানার খাবারসহ খরচ হয় ১০০ আরএমবি (রেনমিনবি) বা ইউয়ান। (আরএমবি বা ইউয়ান হচ্ছে চীনা মুদ্রার নাম। ১০০ আরএমবি  এর সমান হচ্ছে ১ হাজার ৩৩৩ বাংলাদেশি টাকা।) বাংলাদেশিদের এসব হোটেলে থাকা-খাওয়ার সঙ্গে বোনাস-- এয়ারপোর্ট থেকে আনা-নেওয়া ফ্রি। আবার কেউ যদি এসব হোটেলে থাকতে না চান, কাছাকাছি অন্য কোনো হোটেলেও থাকতে পারবেন। আর চৈনিক খাবারে অরুচি হলে, তারা এ সব বাংলাদেশিদের রেস্টুরেন্টে মাত্র ৩০ আরএমবি দিয়ে সকালের নাস্তা ও রাতের খাবার খেতে পারবেন।

আমরা সানন্দে খাইরুলের এই সরাইখানায় উঠে গেলাম। বাড়িটি বেশ সুন্দর। মূল রাস্তা থেকে একটুখানি ভেতরে, দু-তিনটা মোড় ঘুরলেই পাওয়া যায়। তবে রাস্তাগুলো একবারেই চিনে রাখতে হয়। কারণ মহল্লার সবগুলো বাড়িই প্রায় এক রকম। বাইরের লেখাজোখা সবই চীনা ভাষায়, ইংরেজি বা বাংলার কোনো চিহ্নও নেই। আবার কোনো লোককে কোনো কথা জিজ্ঞেস করারও কোনো উপায় নেই। ইংরেজিও কেউ বোঝে না, বাংলা তো দূর অস্ত।

আমরা চটপট রাতের খাবার খেয়ে ঘুরতে বের হলাম। খাইরুলও আমাদের সঙ্গে গেলেন। উদ্দেশ্য-- শহর দেখা। একটা নাইট মার্কেট আছে বলে শুনেছি। সেখান থেকে যদি কিছু কেনাকাটা করা যায়, তাও হবে। এখানে বেশ কজন ড্রাইভার বাংলা বলতে পারেন। যাত্রীদের প্রয়োজন অনুসারে খাইরুল এদের ডাকেন। আমাদের সঙ্গে যেহেতু খাইরুল আছেন, সুতরাং দোভাষী ড্রাইভারের দরকার হল না।

প্রায় আধা ঘণ্টা চলার পর আমরা একটা চমৎকার মার্কেটে এসে নামলাম। এটা কুনমিং শহরের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত এক বিরাট এলাকাজুড়ে খোলা বাজার। পুরো এলাকায় কেবল হৈচৈ হচ্ছে। সবাই কেনাকাটায় ব্যস্ত। ছোট ছোট খোলা দোকানে দোকানিরা নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে। পণ্যগুলোর মধ্যে বই, কাপড়, জুতা, খেলনা, মোবাইল ফোন, সিডি ইত্যাদি আছে। আর আছে অনেক অনেক খাবারের দোকান। সব দোকানেই গরম গরম খাবার তৈরি হচ্ছে। এসব খাবারের মধ্যে আছে মাছ, মাংস, পিঠা, নুডুলস। সঙ্গে আরও এমন সব খাবার আছে, যেগুলো আমাদের দেশের মানুষের পাতে উঠিয়ে দিলে তারা কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে পালাবে।

আমরা ঘণ্টা দুয়েক মার্কেটে ঘুরলাম। টুকটাক অনেক জিনিসও কিনলাম। পরে রাত সাড়ে বারটার দিকে আমরা আবার হোটেলে ফিরে এলাম।

পরদিন একটু সকাল সকাল আমাদের বেরোতে হল। আজ আমরা জিওক্সিয়াং গুহা ও পাথুরে জঙ্গল বা স্টোন ফরেস্ট দেখতে যাব। এ দুটো ইউয়ান প্রদেশে পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ।

কুনমিং হতে জিওক্সিয়াং গুহার দূরত্ব প্রায় ৯০ কিমি। আমরা একটি মাইক্রোবাসে চড়ে রওনা হলাম। ড্রাইভারের নাম ও ছ লুং। খাইরুলসহ বাংলাদেশের অন্যান্যরা মিলে তাকে বাংলা ভাষা শিখিয়ে দিয়েছে। তার একটা বাংলা নামও দিয়েছে-- ‘বিল্লু’। নাম জিজ্ঞেস করলে সে হাসিমুখে বলে, “আমার নাম বিল।”

বিল্লু নামটিই সে সংক্ষেপ করে বলে ‘বিল’।

বিল্লু এই এলাকারই ছেলে। বয়স ত্রিশের বেশি হবে না। বেশ ভালো বাংলা বলতে পারে। চলার পথে আমি রাস্তায় ছবি তুলব বলে বিল্লুর পাশের সিটে বসলাম। ঘোরাঘুরির ক্ষেত্রে এ সিটটাই আমার বেশি পছন্দ; কারণ এখানে বসলে সব কিছু ভালোভাবে দেখা যায়।

গাড়িতে আমার সহযাত্রী আবদুর রহমান খান, রফিক, জাফর, মামুন ও রব। সবাই মিলে হৈচৈ করতে করতে যাচ্ছি। চমৎকার মসৃণ হাইওয়ে, গাড়ি ছুটে চলেছে ১২০ কিমি কখনও কখনও তারও বেশি বেগে। পথে এক জায়গায় গাড়ি থামানো হল পেট্রোল কেনার জন্য। এ সময় সবাই পাশের ছোট্ট দোকানে গিয়ে ভিড় জমালো। রব সবার জন্য পানি কিনে আনল, আবদুর রহমান খান নিয়ে এলেন চকলেট আর বিস্কুট। দ্রুত কেনাকাটা সেরে সবাই গাড়িতে এসে বসেছেন, কিন্তু রফিককে পাওয়া যাচ্ছে না।

অনেকক্ষণ পর তিনি হাতে করে কী একটা প্যাকেট নিয়ে এলেন। আমরা সবাই অস্থির হয়ে ছিলাম তাড়াতাড়ি যাব বলে। তাই সবাই এক যোগে রফিককে ধরে বসলাম, “কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? এটা কী এনেছেন?”

রফিক একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। তিনি একটা ঢোক গিলে বললেন, “ক্ষিধে পেলে খাবেন কী? আপনাদের কথা ভেবে অনেক খুঁজে মজার একটা খাবার এনেছি।”

“কী এনেছেন?”

“কেক। মনে হয় খুব মজার হবে। একদম তাজা, হয়তো আজই বানিয়েছে।”

রফিকের কথা শুনে বিল্লু হিহি করে হাসতে শুরু করল।

আমি বললাম, “কী হয়েছে? তুমি হাসছ কেন?”

গাড়ি চালাতে চালাতে বিল্লু বলল, “এটা খেতে পারবেন না। এটা হল কুকুরের খাবার। সঙ্গে করে নিয়ে চলেন, দেশে গিয়ে কুকুরকে খাওয়াবেন।”

ড্রাইভারের কথা শুনে সবাই হোহো করে হেসে দিল। রফিক এবার খুবই বিব্রত। মানুষের খাবার ভেবে সে নিয়ে এসেছে কুকুরের খাবার। প্যাকেটের গায়ে চীনা ভাষার লেখা দেখে সে কিছুই বুঝতে পারেনি। প্যাকেটের বাইরেটা দেখে, একটু টিপেটুপে জিনিসটা তার পছন্দ হয়েছে। তাই খুশি মনে এটা সে কিনে এনেছে। সবাই রফিককে ক্ষ্যাপাতে শুরু করলে, সে শেষ পর্যন্ত প্যাকেটটা বাইরে ছুড়ে ফেলে দিল।

বেলা এগারটার মধ্যে আমরা জিওক্সিয়াং গুহায় পৌঁছে গেলাম। এটি একটি বিশাল পর্যটন কেন্দ্র। নির্ধারিত আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং প্লেসে গাড়ি রেখে আমরা উঠে এলাম উপরে। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম। এতটা ঐশ্বর্যমণ্ডিত, চমকপ্রদ, বৃহদাকৃতিসম্পন্ন এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ কোনো গুহা পৃথিবীতে থাকতে পারে, এমন ধারণাও আমাদের আগে ছিল না।

কর্তৃপক্ষ পুরো গুহাটি ঘুরে ঘুরে দেখার জন্যে প্রয়োজনীয় সিঁড়ি, পাটাতন, রেলিং ইত্যাদি অত্যন্ত মনোমুগ্ধকরভাবে বানিয়েছেন। সেখানকার দুই পাহাড়ের মাঝে একটি মনোরম সরোবরও রয়েছে। নৌকায় চড়ে এই সরোবরে ঘুরে বেড়ানো যায়।

আমরা প্রথমেই নৌকায় চড়ার জন্যে টিকিট কেটে নিলাম। সবাইকে লাইফ জ্যাকেট পরে নৌকায় লাইন দিয়ে উঠতে হল। সরোবরের বিভিন্ন স্থানে রং-বেরংয়ের নৌকা আর সেগুলোতে রং-বেরংয়ের যাত্রী। সবাই বিভিন্ন রংয়ের লাইফ জ্যাকেট পরে নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রত্যেকের মুখে হাসি, মনে আনন্দ আর চোখে পর্যটকের চিরন্তন ঔৎসুক্য। আমরা ক্যামেরা নিয়ে বিভিন্ন নৌকার যাত্রীদের ছবি তুলছি। আর আমাদের ছবি তুলতে দেখে সবাই হৈহৈ করে হাত নাড়ছে।

নৌকা সরোবরের পুবসীমা পর্যন্ত গিয়ে আবার ঘুরে আসে। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা সরোবরে ঘুরে ঘুরে আমাদের ভ্রমণক্লান্তি কমে গেল। আমরা এবার তীরে এসে নামলাম। এখানে কজন মেয়েকে একটু জমকালো সাজে বসে থাকতে দেখলাম। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সেজেগুজে বসে থাকাই ওদের পেশা। মাঝেমধ্যে দু-একজন পর্যটক ওদের সঙ্গে ছবি তোলে, তার বিনিময়ে ওরা দুপয়সা পায়।

সরোবর থেকে বের হয়ে আমরা একটা লিফট-এ চড়ে চলে গেলাম পাহাড়ের চূড়ায়। সেখান থেকেই গুহাপথে যাত্রা শুরু। গুহাভ্রমণকে রঙিন করার জন্য বিভিন্ন রংয়ের বাতি লাগানো হয়েছে। তবে বাতিগুলো দেখা যায় না। অর্থাৎ বাতিগুলো চোখের আড়ালে থেকে, শুধু রঙ্গিন আলোকচ্ছটা বিচ্ছুরিত করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। গুহার প্রতিটি পরতে যেন রংয়ের উৎসব। সবাই চোখ বিস্ফারিত করে দেখছে। আমরা ভেতরের দিকে যতই এগিয়ে যাচ্ছি, ততই মোহিত হয়ে যাচ্ছি। কোনো কোনো স্থানে গুহার সুউচ্চ ছাদের একটুখানি ফুটো দিয়ে সূর্যের আলো ভেতরে এসে পড়ছে। গাছের ডালপালার ফোকর গলিয়ে গুহার ভেতর ছড়িয়ে পড়া আলো আর ছায়া পৃথকভাবে চিলতে হয়ে নিচে ছড়িয়ে পড়ছে।

গুহার ভেতর প্রাকৃতিক নানা ডিজাইন দেখে মন নেচে ওঠে। আকাশের মেঘ দেখে আমরা যেমন মনে মনে ভাবি, এটা ঘোড়া, এটা বুড়ো মানুষ, এটা মুরগি, ঠিক তেমনি নানা আকার আর ডিজাইনের চিত্র যেন কোনো শিল্পী অতি যত্নে গুহার ভেতর এঁকে রেখেছেন। যুগ যুগ ধরে এসব প্রাকৃতিক চিত্রকর্ম ঝুলে আছে গুহার ভেতরে। আমরা সিঁড়ি বেয়ে কখনও নিচে নেমে যাচ্ছি, কখনও-বা উপরে উঠছি।

ঘুরতে ঘুরতে আমরা এক জায়গায় এসে দেখি, উপরের দিকে অনেকটা খাড়াভাবে সিঁড়ি উঠে গেছে। সেখানে কিছু লোক আরাম কেদারার মতো এক ধরনের বাহন নিয়ে অপেক্ষা করছে। এতে চড়ে উপরে ওঠা যেতে পারে। এর জন্য খরচ হবে ৬০ আরএমবি। আমাদের সহযাত্রীদের মাঝে রব একটু অলস প্রকৃতির। সে এই ইজিচেয়ারে ওঠার জন্য এগিয়ে গেলে সবাই হৈচৈ শুরু করে দিল। সবার ভেতর একটা জেদ, ইজিচেয়ারে চড়ে উপরে ওঠা মানে হচ্ছে সারেন্ডার করা। সুতরাং অভিযাত্রী দলকে হেঁটেই উপরে উঠতে হবে। অগত্যা রবকে তার ইচ্ছে ত্যাগ করতে হল।

উপরে এসে আমরা একটা সমতল অংশ পেলাম। এখানে অনেকটা মার্কেটের মতো করা হয়েছে। চারপাশে হালকা খাবার, আইসক্রিম, স্যুভেনির ইত্যাদির দোকান। একপাশে ছোট্ট একটি মঞ্চ বানানো হয়েছে। সেখানে একটি সংগীতদল মনের সুখে গান গাইছে। আমরা কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে গান শুনলাম, কিছু ছবিও তুললাম। গুহার ভেতরে উঁচুনিচু পথে চলতে চলতে আমরা সবাই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। সেই ক্লান্তিও দূর হল। আমরা সবাই আইসক্রিম কিনে একটা জায়গায় বসে খেলাম। শেষে বেরিয়ে এলাম বাইরে।

এখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে একটা বাগান করা হয়েছে। ফুলের গাছের ফাঁকে ফাঁকে বসে বিশ্রাম নেওয়ার ব্যবস্থা। আমরা এখানে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। এতক্ষণে শরীরে বেশ গরম অনুভূত হচ্ছে। আমি জ্যাকেটটা খুলে হাতে নিলাম। আমার হাতে আইপ্যাড আর ক্যামেরা। একটা দিয়ে ছবি তুলতে গেলে অন্যটাকে সামলানো বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। এর মধ্যে যোগ হয়েছে জ্যাকেট। ছবি তুলতে গেলেই জ্যাকেটটা মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। একটা চরম বিরক্তিকর অবস্থা। আমার এই হযবরল অবস্থা দেখে মামুন সম্ভবত মনে মনে অস্বস্তি বোধ করছিল। এবার সে আমার সাহায্যার্থে এগিয়ে এল। মামুন আমার কাছ থেকে রীতিমতো জোর করে জ্যাকেটটা নিয়ে গেল। আমিও জ্যাকেটটা হস্তান্তর করতে পেরে বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করলাম।

আমরা এই জায়গাটায় আরও কিছু সময় ঘোরাঘুরি করে অন্যদিকে যেতে উদ্যোগী হলাম। এখান থেকে ক্যাবলকারে প্রায় এক কিলোমিটার পথ যেতে হবে। ক্যাবলকারের গমনপথের নিচে গভীর খাদ আর গহীন জঙ্গল। বিশাল আকারের গাছগুলোর উপর দিয়ে পুরো বনভূমির শীর্ষদেশ দেখতে দেখতে যাওয়া যায় ক্যাবলকারে। এখানকার ক্যাবলকারে কোনো বক্স নেই। খোলামেলা পাশাপাশি দুটো সিট; দুই সিটে যাত্রী বসে সামনের দিকের পাইপটা টেনে দিতে হয়। এতেই যাত্রীদের চারদিকে মোটামুটি একটা নিরাপত্তা বলয় তৈরি হয়। কিন্তু এ ধরনের ব্যবস্থায় ক্যামেরা বা অন্য কোন মূল্যবান জিনিস টুপ করে গহীন অরণ্যে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়। যা হোক, আমি সবাইকে রেখে বিল্লুকে নিয়ে ক্যাবলকারে উঠে গেলাম। যাওয়ার সময় বলে গেলাম, তারা যেন দশ মিনিট পরে ক্যাবলকারে চড়ে। কারণ আমি ওপাড়ে গিয়ে ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়াব, সবার ছবি তুলতে।

ক্যাবলকারে উঠে আমি প্রথমে ক্যামেরা দিয়ে বনভূমির বেশ কটি ছবি তুললাম। এক পর্যায়ে হাত লম্বা করে বাড়িয়ে আইপ্যাড দিয়ে আমার আর বিল্লুর ছবি তুলতে শুরু করলাম। বিল্লু আমাকে সাবধান করে বলল, “দেখ, এটা হাত থেকে পড়ে গেলে আর পাওয়া যাবে না।”

বিল্লুর সঙ্গে গল্প করতে করতে আমি বনভূমির চমৎকার এই পথটুকু পার হয়ে এলাম। আমরা যখন যাত্রাপথের শেষ প্রান্তে এলাম, তখন বুঝতে পারলাম যে এখানে দাঁড়ানও যাবে না, কারও ছবিও তোলা যাবে না। এখানকার আয়োজনটাই এমনভাবে করা হয়েছে। কিন্তু নেমে যাবার পূর্ব মুহূর্তে বামদিকের কোণায় একটা ক্যামেরা বসানো আছে, ওটা সমানে ক্লিক ক্লিক করে যাচ্ছে। আমি নেমে গিয়ে পেছনের শপে ছবি অর্ডার দিলাম। একেকটা ছবির দাম ২৫ আরএমবি।

আমি আর বিল্লু হাসি হাসি মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছি, এমন একটা ছবি আমার হাতে এসে পৌঁছার আগেই ওপারে রেখে আসা আমার সহযাত্রীরা চলে এলেন। মামুনের মুখ একেবারেই শুকনো। সবার মাঝেই কেমন একটা উৎকণ্ঠা। আমার কাছ থেকে এক রকম জোর করে কেড়ে নেওয়া সেই জ্যাকেটটা গহীন জঙ্গলে পড়ে গেছে। ক্যাবলকারে উঠে মামুন অতি যত্নের সঙ্গে সেটি তার কোলে রেখেছিল। কিন্তু জ্যাকেটটি ছিল অতিরিক্ত পিচ্ছিল, হঠাৎ করেই নিচে পড়ে গেছে। সবাই এক যোগে উৎকণ্ঠিত হওয়ার কারণ, এই জ্যাকেটের পকেটেই আমার পাসপোর্ট আছে কি না, বা ওতে আমি ডলার রেখেছিলাম কি না। আমি এ রকম কোনো বস্তু ওই জ্যাকেটে রাখিনি, এটা নিশ্চিত করার পর সবাই কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেলেন বটে, কিন্তু তাও অতি সামান্য। এবার সবার প্রশ্ন, “জ্যাকেটটা তো ছিল ব্র্যান্ডের। কোত্থেকে কিনেছিলেন? কত ডলার দিয়ে?”

প্রশ্নকর্তারা ধরেই নিয়েছেন, জ্যাকেটটি বিদেশ থেকে ডলারে কেনা। আমি মামুনকে আশ্বস্ত করলাম যে, ওতে কোনো পাসপোর্ট ছিল না। বৈদেশিক মুদ্রা বলতে ছিল কেবল দুটো ইউরোর কয়েন। সুতরাং, জ্যাকেটের এই অধঃপতন মেনে নিতে তেমন কষ্ট পাওয়ার কিচ্ছু নেই। বিষয়টা অন্যরাও বুঝলেন। কিন্তু মামুনের মুখে কী আর সহজে হাসি ফোটে!

কিন্তু পুলিশের গোয়েন্দা কর্মকর্তা এ আর খান সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। তিনি শেষ অবধি আরও প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। আমি তার প্রশ্নের জবাব দেওয়ায় সবাই জানতে পারল যে, জ্যাকেটটি লন্ডন থেকে কেনা হয়েছিল। একটা স্যুটের দোকানে শতকরা ৬০ ভাগ মূল্যহ্রাস লেখা দেখেই কিনেছিলাম। ব্র্যান্ড আইটেম বটে।

জ্যাকেটের শোকে আমি ছাড়া সবাই যখন কাতর, তখন বিল্লু এগিয়ে এসে বলল, “তোমরা ভেব না। আমি দেখি কী করা যায়।”

বিল্লু এগিয়ে গেল ক্যাবলকারের কাউন্টারের দিকে। ফিরে এসে বলল, “তোমার জ্যাকেট পাওয়া যাবে। তবে সে জন্য আরও কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হবে।”

আমরা রীতিমতো আশ্চর্য হলাম, যখন দেখতে পেলাম পরের পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটা খোলা বাক্সে করে আমার পড়ে যাওয়া জ্যাকেটটি চলে এল। কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ দিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। ইতোমধ্যে দুপুর গড়িয়ে গেছে। সবাই খিদেয় অস্থির। কিন্তু আমরা এখানে কী খাব? বিল্লু আমাদের গাইড হয়ে নিয়ে চলল ফুড কোর্টের দিকে। এখানে সারিবদ্ধভাবে অনেক অনেক খাবারের দোকান আছে। এ সব দোকানে নানা ধরনের খাবার পাওয়া যায়।

আমরা এই প্রথম খাবার নিয়ে ঝুঁকির মধ্যে আছি। শুনেছি, চীনের মানুষ সবই খায়। আমরা কেবল বাছাই করা হালাল খাবার খেতেই অভ্যস্ত। তাই এই দোকান সেই দোকান করতে শুরু করলাম। একটা দোকানে বিশাল সাইজের কটি হাঁস হালকা ভাজি করে ঝুলিয়ে রাখতে দেখলাম। আস্ত পশুও ঝুলে আছে কোনো কোনো দোকানে। তবে কোথাও সাপ-ব্যাঙ দেখলাম না। প্রতিটি রেস্টুরেন্টে বসেই লোকজন তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। অধিকাংশ লোকেরা নুডুলস খাচ্ছে। কেউ কেউ খাবার মুখে নেওয়ার জন্য কাঠি ব্যবহার করছে। আমাদের জন্য কাঠি দিয়ে খাওয়া মানে, খাবার নিয়ে যুদ্ধ করা। আমাদের দোদুল্যমানতা দেখে বিল্লু বলল, “ওকে, চিন্তা করো না। আমার সঙ্গে চল।”

আমরা বিল্লুকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলাম। কিছুদূর গিয়ে আমরা একটা মুসলিম ফুডের দোকান দেখতে পেলাম। দোকানের দেয়ালে ইংরেজিতে লেখা আছে-- এখানকার সকল খাবারই হালাল। দেয়ালে আরবিতে কুরআন শরিফের আয়াতও লেখা আছে। আমরা ভাত, আলু ভর্তা, শাক, ডিমভাজি, সবজি-মুরগি, গরুর মাংসের ঝোল ইত্যাদি অর্ডার দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের খাবার এসে গেল।

এ দোকানের সব মেয়েরাই হিজাব পরে। আমরা খেতে শুরু করলাম। খাবার বেশ ভালো লাগল। মামুন বেশ কিছুক্ষণ কাঠি দিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করে মোটামুটি ব্যর্থ হয়ে ফিরে এল চামুচ পদ্ধতিতে। সবাই বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেলাম। খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে এলাম। এবার আমাদের বেরোতে হবে।

বেরনোর পথে বামদিকে আছে মিউজিয়াম অব জিওলজিক্যাল পার্ক। আমরা সবাই ঢুকে গেলাম পার্কটিতে। এখানে হাজার বছরের জিওলজিক্যাল পরিবর্তন প্রদর্শিত হচ্ছে। আমরা কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে এগুলো দেখলাম। তারপর বেরিয়ে এলাম জিওক্সিয়াং গুহা ছেড়ে, স্টোন ফরেস্টে যাব বলে।

ঠিক সেই মুহূর্তে দেখা হয়ে গেল পুলিশের ডিআইজি মোহাম্মদ মঞ্জুর কাদের খানের সঙ্গে। ইনি সম্পর্কে আমার বিয়াই। বছর খানেক আগে আমাদের সঙ্গে মঞ্জুর সাহেবদের পরিবার আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। তিনি আমাদের সঙ্গে একই প্লেনে কুনমিং এসেছেন, একটা অফিসিয়াল কাজে। বাংলাদেশিদের একটি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। আজ ছুটির দিন বলে, আমাদের মতোই এ এলাকায় বেড়াতে এসেছেন। এখন এখানে খাবারের সমস্যা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমরা তাকে সেই মুসলিম দোকানে যাওয়ার পরামর্শ দিলাম। আমাদের ধন্যবাদ জানিয়ে তারা এগিয়ে গেলেন খাবারের দোকানের দিকে।

পার্কিং এলাকা থেকে বের হয়ে আমাদের গাড়ি দ্রুতবেগে ছুটে চলল স্টোন ফরেস্টের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময় ‘স্টোন ফরেস্টে’।

স্টোন ফরেস্ট কুনমিং শহর থেকে ১২০ কিমি দক্ষিণে অবস্থিত। মিং রাজবংশের (১৩৬৮-১৬৪৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ) শাসনামল থেকেই এটি পৃথিবীর প্রথম বিস্ময় হিসেবে পরিচিত। প্রকৃতির আপন হাতে তৈরি পাথরের এক অভূতপূর্ব কারুকার্য এই স্টোন ফরেস্ট। এর বিস্তার প্রায় ৪০০ বর্গ কিলোমিটার (৯৬,০০০ একর)। এখানে বিভিন্ন উচ্চতার ও বিভিন্ন আকারের অসংখ্য পাথরের স্তম্ভ বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এসব পাথরের কোনোটি জীবজন্তুর, কোনোটি বৃক্ষের, কোনোটি মানুষের আকৃতির। এদের কোনোটি খাড়াভাবে, কোনোটি হেলানোভাবে দাঁড়িয়ে আছে।

‘স্টোন ফরেস্ট’ সাতটি অঞ্চলে বিভক্ত--

লিজিজিং স্টোন ফরেস্ট (Lizijing Stone Forest)

নাইগু স্টোন ফরেস্ট (Naigu Stone Forest)

ঝিয়ুন গুহা (Zhiyun Cave)

চ্যাং হ্রদ (Lake Chang)

ইউ হ্রদ (Lake Yue)

ডাডি জলপ্রপাত (Dadie Waterfall)

কিফেং গুহা (Qifeng Cave)

২০০৭ সাল থেকে এই ফরেস্টের দুইটি অংশকে-- ‘নাইগু স্টোন ফরেস্ট’ (Naigu Stone Forest) এবং ‘সুজেগি ভিলেজ’ (Suogeyi Village) ইউনেস্কো ঘোষণা করেছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে।

ভূতত্ত্ববিদদের মতে ২৭০ মিলিয়ন বছর আগে সমুদ্রের তলদেশে থাকা চুনাপাথরের স্তর ক্রমাগত বিবর্তিত হয়ে এই স্টোন ফরেস্টের রূপ নেয়। এখন স্থানটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ভ্রমণপিপাসুদের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।

স্টোন ফরেস্টে এসে আমাদের গাড়ি যথাস্থানে পার্ক করল। আমরা এগুলাম টিকিট কাউন্টারের দিকে। এ ব্যাপারে বিল্লু আমাদের সাহায্য করল। এখানে অনেকগুলো খোলাগাড়ি লাইন করে দাঁড়িয়েছিল। এগুলোর প্রায় সবগুলোর ড্রাইভারই মহিলা, চমৎকার রঙ্গিন পোশাকে সজ্জিত।

টিকিট কাটা হয়ে গেলে আমরা লাইনের প্রথম গাড়িতে চড়ে বসলাম। গাড়ি চলতে শুরু করল। আমরা অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে দুধারে পাথরের বন দেখছি। আমাদের চারদিকেই ছোটবড় পাহাড়, বিভিন্ন আকৃতির। আমরা চারদিক থেকে ছবি তুলছি। স্টোন ফরেস্টের মাঝে মাঝে সুন্দর সুন্দর জলাধার আছে, আবার খোলা মাঠের মতো জায়গাও আছে। মাঝে মাঝে আছে ফুলের বাগান। সে সব বাগান চমৎকার রং-বেরংয়ের ফুল দিয়ে সাজানো। আমরা যখন হেঁটে হেঁটে একেবারে ক্লান্ত হয়ে গেছি, ঠিক তখনই চোখে পড়ল একটি খোলা ফলের দোকান। ফলগুলো আমরা চিনতে পারলাম না, তবে স্থানীয় পর্যটকদের ভিড় এবং তাদের খাওয়ার নমুনা দেখে বুঝতে পারলাম যে, খেতে সুমিষ্টই হবে। আমরাও প্যাকেট ভর্তি ফল কিনলাম। বরফের সঙ্গে রাখা ছিল বলে বেশ ঠাণ্ডা। আমরা ফলগুলো মুখে দিয়েই বুঝতে পারলাম, আরও এক ব্যাগ কিনতে হবে। ফলের তৃপ্তি নিয়ে আমরা আবার এগোলাম বনের দিকে।

কথিত আছে, এ বনটি ‘আশিমা’র জন্মস্থান। কিংবদন্তী অনুযায়ী, আশিমা ছিল ‘ইই’ (ণর) বা ‘লোলো’ (খড়ষড়) সম্প্রদায়ের সুন্দরী কন্যা। সেই আশিমা এক যুবকের প্রেমে পড়ে। সে ঐ ছেলেটিকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, কিন্তু তার অভিভাবকরা বাধা হয়ে দাঁড়ান। আশিমা অভিভাবকদের এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। সে কেবল কাঁদত। রাগে অভিভবাবকরা মন্ত্র দিয়ে আশিমাকে পাথরে রূপান্তরিত করেন।

বনে এখনও আশিমার নামে একটি পাথরস্তম্ভ আছে। একপাশ থেকে ঐ পাথর স্তম্ভ দেখে মনে হয় যে, একজন তরুণী মাথায় রুমাল আর পিঠে বাঁশের ঝুড়ি নিয়ে খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেক বছর ষষ্ঠ চান্দ্র মাসের ২৪ তারিখে ‘ইই’ সম্প্রদায়ের মানুষরা আশিমার স্মৃতির উদ্দেশ্যে টর্চ উৎসব পালন করে। লোক নৃত্য, কুস্তি প্রতিযোগিতা, ষাড়ের যুদ্ধ ও সিংহের নাচ এ উৎসবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

আমরা গাড়িতে চড়ে আরও অনেকগুলো পাহাড় দেখলাম। এক সময় দিনের আলো নিভে এলে আমরা বিল্লুর সঙ্গে ছুটলাম কুনমিংয়ের উদ্দেশে। তবে বিমোহিত নয়নে স্টোন ফরেস্টের যে রূপ আমরা দেখলাম, তা সত্যিই অপূর্ব।

পরদিন আমরা দিনের বেলা শহরের বিভিন্ন মার্কেটে ঘুরে বেড়ালাম। এ সব মার্কেটে আছে হাজারও জিনিস, বিভিন্ন মানের। এগুলোর দামও খুব কম। আমাদের মাঝে কেউ কেউ কিছু কেনাকাটা করে নিল।

বিকেলে আমরা একটা নদীর পাড়ে ঘুরতে গেলাম। নদীর পাড় কয়েক মাইল অবধি বাঁধানো। এখানে বিকেলে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ জড়ো হয়ে সুনির্মল পরিবেশ উপভোগ করেন। কেউ কেউ হাঁটেন, কেউ শিশুদের নিয়ে নানা খেলায় মেতে ওঠেন। কেউ-বা ঘুড়ি ওড়ান। আকাশে বিভিন্ন ডিজাইনের আর বিভিন্ন সাইজের ঘুড়ি উড়ছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন আকাশে ঘুড়ির মেলা বসেছে। যেন বা এখানে আজ ঘুড়ি উৎসব। আমরাও এখানকার দোকান থেকে কিছু ঘুড়ি আর সুতাসহ নাটাই কিনে কিছুক্ষণ ঘুড়ি উড়ালাম। পরে প্রত্যেকে দশটা করে বিভিন্ন ডিজাইনের ছোট ছোট ঘুড়ি কিনে নিলাম, বাংলাদেশে নিয়ে আসব বলে। মনে পড়ে গেল, আমরাও এক সময় কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় ঘুড়ি উৎসবের আয়োজন করতাম। তখন দূরদূরান্ত থেকে নানা বয়েসি মানুষ বিভিন্ন ডিজাইনের ঘুড়ি নিয়ে আসতেন। মনের সুখে তারা ঘুড়ি উড়াতেন। আমরাও আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতাম এ সব ঘুড়ি দেখে।

আমরা হঠাৎ করেই দেখলাম, নিচের রাস্তা থেকে সিঁড়ি বেয়ে তিনজন মানুষ উপরে উঠে আসছে। এদের মাঝে একজন পুরুষ, দুজন মহিলা। ভদ্রমহিলাদের একজন সাদা পোশাকে খুব সেজেগুঁজে এসেছেন। শ্রীলঙ্কা, মঙ্গোলিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশে বিয়ের পরদিন এ রকম সেজেগুজে নবদম্পতিদের আমি ঘুরতে দেখেছি। তারা শহরের বিভিন্ন পার্কে বা সুন্দর সুন্দর স্থানে ঘুরে বেড়ান। আর ছবি তোলেন। এখানেও মনে হয় তাই হচ্ছে। কিন্তু ভদ্রমহিলার বয়স কিছুটা বেশি। মনে হয় একটু বেশি বয়সে বিয়ে হয়েছে। সাজুগুজু করা ভদ্রমহিলা হাইহিলের চাপে সহজভাবে হাঁটতে পারছেন না। সম্ভবত সে জন্যই তার পাশে থেকে পুরুষ ভদ্রলোকটি অতি সাবধানে ভদ্রমহিলার হাত ধরে হাঁটছেন। আর ভদ্রলোকের হাত ধরে সাজুগুজু করা ভদ্রমহিলা অনেকটা এঁকেবেঁকে হাঁটছেন। প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছে, এই বুঝি তিনি পড়ে যাচ্ছেন।

এ আর খান সাহেব পুলিশ। একটু বেশি সাহস থাকারই কথা। তিনি এগিয়ে গিয়ে ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বললেন। জানা গেল, আজ তাদের বিবাহবার্ষিকী। পাশে হাত ধরে আছেন ভদ্রমহিলার স্বামী। অন্যদিকে তার কন্যা। বার্ষিকী উদযাপন করার জন্যই তারা এখানে এসেছেন। অনুমতি নিয়ে আমরা প্রথমে তাদের ছবি তুললাম। পরে ছবি তোলার জন্য আমরাও তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেলাম।

ক্রমে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। পশ্চিমাকাশ রাঙ্গিয়ে দূর পাহাড়ের আড়ালে ডুব দিচ্ছে সূর্য। এর প্রতিফলন এসে পড়েছে নদীতে। আকাশ এবং নদীর জলে লাল-নীলের মাখামাখিতে অপূর্ব সুন্দর এক দৃশ্যের অবতারণা করেছে। ডুবন্ত সূর্যের সঙ্গে মিলেমিশে, কেউ-বা বল আকারের লাল সূর্যকে হাতের তালুতে নিয়ে ছবি তুলছে। একটু একটু শীত অনুভ‚ত হচ্ছে। আমরা নদীর পাড় ধরে আবারও কিছুক্ষণ হাঁটলাম। সন্ধ্যা উৎড়ে যাওয়ার পর আমরা গাড়িতে উঠলাম। উদ্দেশ্য-- হোটেল।

পরদিন আমরা উড়ে গেলাম অন্য শহরে, অন্য কিছুর আশায়। পেছনে পড়ে রইল মনমাতানো পর্যটন শহর কুনমিং।

বিদায় জিওক্সিয়াং গুহা, বিদায় স্টোন ফরেস্ট, বিদায় বিল্লু নামের চৈনিক ছেলে।