১
উলান বাটর। মঙ্গোলিয়ার রাজধানী। বিশ্বের শীতলতম রাজধানী শহর। শুনেছি এ শহরে সারা বছরের গড় তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ত্রিশ ডিগ্রি। আমরা গরম এলাকার মানুষ, বরফ আর শীতকে ভয় পাই। বরফ বলতে ফ্রিজের বরফই চিনি। আর পুরো দেশে বরফ আর বরফ-- এ দৃশ্য আমাদের একেবারেই অচেনা।
মঙ্গোলিয়ান এয়ারলাইনসের একটি বিমান চীনের বেইজিং থেকে উড়াল দিয়ে, সারা রাস্তা মৃগী রোগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে, রাত ১১টায় উলান বাটরে ধপাস করে চাকা ঠেকিয়ে দিল।
বিমানবন্দরে নেমে বিমানটির এত কাঁপাকাঁপির কারণ জানা গেল। আমাদের আসার রাস্তা ছিল খুবই বিপদসংকুল। ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্থানে টাইফুন শুরু হয়েছে। এদিকের অনেক রুটের বিমান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের বিমানটিই শেষ বিমান।
ইমিগ্রেশন পর্ব সেরে বিমানবন্দর থেকে বাইরে পা বাড়ালাম। আমরা একটি আন্তর্জাতিক সভায় যোগ দিতে এসেছি। আয়োজকগণ এসেছেন আমাদের নিতে। হঠাৎ কী মনে করে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা ভাই, বাইরে তাপমাত্রা কত?”
“ভালো। কোনো অসুবিধা হবে না। আজ মাইনাস ফাইভ চলছে।”
মাইনাস ফাইভ! ভালো! মানে কী? মাইনাস ফাইভ ভালো হল কীভাবে? ওদের গায়ে অবশ্য পাতলা জ্যাকেট আছে, তবে সেগুলোর সামনের দিকের চেইন খোলা। অনেকটা হেমন্তের শেষে সাবধানী মায়েদের সুবোধ বালকদের মতো।
তাপমাত্রা মাইনাসের কোঠায় শুনে আমরা তো অস্থির। আমি বললাম, “একটু দাঁড়াও, ওভারকোট গায়ে চাপিয়ে নেই।”
আমাকে দেখে সহযাত্রী সবাই বাক্স খুলে শীতের পোশাক বের করল। সে সব পোশাক গায়ে দিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম মঙ্গোলিয়ার রাস্তায়। আহা! শীতের কী দাপট! মুখে যেন কেবল ছোবল মারছে। বাংলাদেশের প্রচণ্ড শীতে চাদর জড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে পথচলার সময়, কোনো দুষ্টু ছেলে হঠাৎ করে পুকুরের ঠাণ্ডা পানি মুখে ছিটিয়ে দিলে যে রকম লাগে, অনেকটা সে রকম অনুভূতি। আমাদের জড়সড় ভাব দেখে মঙ্গোলিয়ান ভাইয়েরা কেবল হাসে। ওদের ভাব দেখে মনে হয়, ওরা যেন মনে মনে বলছে, “ব্যাটারা, এইটুকু ঠাণ্ডাতেই ওভারকোট লাগিয়ে কাঁপছ, আর মাইনাস পঞ্চাশ ডিগ্রির সময় এলে তো জ্বলন্ত কয়লা খাইয়ে দিলেও তোমরা কাঁপতে থাকবে।”
বাসে ওঠার পর একটু স্বস্তি পেলাম। বাসের ভেতরটা বেশ গরম। বাসের ভেতরে গরম হাওয়ার ব্যবস্থা আছে তো, তাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস চলতে শুরু করল। বিমানবন্দর থেকে শহরে যাওয়ার রাস্তার অবস্থা দেখে আমরা তো হতাশ। এ তো দেখি আমাদের মফস্বল শহরগুলোর চেয়েও খারাপ অবস্থা! মাটির ধুলিময় আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে বাস চলছে। মাঝে মাঝে ক্ষীণ আলোর টোপর নিয়ে দু-একটি লাইটপোস্ট রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
বিমানবন্দর থেকে ১৮ কিলোমিটার রাস্তা পেরুতে সময় লাগল প্রায় ৪০ মিনিট। রাত একটার দিকে ব্যায়াংগল হোটেলের ৭০৫ নম্বর রুমে ঢুকে, একটু ঢিলেঢালা মুডে হিটার চালাতে গিয়ে দেখি, রুমের হিটার খারাপ। তাপমাত্রা যতই দিই না কেন, কেবল ঠাণ্ডা বাতাসই বের হয়। অর্থাৎ আমাকে সারারাত ঠাণ্ডায় কষ্ট করতে হবে।
আমি রিসেপশনে কল করে বিষয়টা জানালাম। মিনিটখানেকের মধ্যেই দশাসই চেহারার একজন ভদ্রমহিলা হাসিমুখে আমার রুমে এসে ঢুকলেন। তারপর রিমোট কন্ট্রোল টিপে হাসিমুখে বললেন, “এইতো চালু হয়ে গেছে। তোমাকে দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে, তখন গরম বাতাস বের হবে।”
আমি তখন রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা আটকে হাসিমুখেই বললাম, “তাহলে তো তোমাকে দশ মিনিট এখানে লক্ষী মেয়ের মতো বসে থাকতে হবে। গরম বাতাস বের না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে এখান থেকে আমি যেতে দেব না।”
সে কি বুঝল জানি না। চট করে সে কাকে যেন টেলিফোন করল। আমি প্রথমে একটু ভড়কে গেলাম, বিদেশ-বিভুঁইয়ে মাস্তানির অভিযোগ উঠে কি না, কে জানে!
মিনিটখানেকের মধ্যেই সুপারভাইজার টাইপ আর একজন ভদ্রমহিলা হাইহিলে টকটক শব্দ করতে করতে রুমে এসে ঢুকলেন। তার মুখে বিষ্ময়, “কী হয়েছে? ওকে যেতে দিচ্ছ না কেন?”
আমি বললাম, “ম্যাডাম, তোমাদের হিটার দিয়ে কেবল ঠাণ্ডা বাতাস বের হয়। আমি অনেক ট্রাই করেছি। কাজেই গরম বাতাস না বের হওয়া পর্যন্ত আমি তোমাকেও যেতে দেব না।”
সুপারভাইজার টাইপ ভদ্রমহিলা স্মার্টভঙ্গিতে রিমোট কট্রোল নিয়ে একটু টিপাটিপি করলেন। তার ভাব দেখে মনে হল, তার রিমোটের টিপুনিতে গরম বাতাস তো অতি সাধারণ বিষয়, গরম চা-কফিও বের হতে শুরু করবে। বেশ কয়েক মিনিট অপেক্ষা করার পরও গরম বাতাস বের হল না।
ভদ্রমহিলা রিমোটটি হাতে নিয়ে আরও কয়েক বার স্মার্টভাবে টিপাটিপি করলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সম্ভবত বুঝতে পারলেন, এটা তার কাজ নয়। এদিকে আমি ফিরে যাওয়ার রাস্তায় গ্যাট মেরে দাঁড়িয়ে আছি। অগত্যা সে টেলিফোন করে কাকে যেন কী বলল। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই একজন মেকানিক টাইপ লোক এসে ঘরে ঢুকল। সে বেশ মনোযোগ দিয়ে রিমোটে টিপাটিপি এবং চড়থাপ্পড় মারতে লাগল। এই ফাঁকে ভদ্রমহিলা দুজন আমাকে পাশ কাটিয়ে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার বেলায় অনেকটা মাস্তানি-টাইপের-হাসিও উপহার দিল। মেকানিক ভদ্রলোক অল্পক্ষণ পরে কোনো একটা যন্ত্রপাতি আনতে যাচ্ছেন এমন ভঙ্গি করে বেরিয়ে গেলেন, আর ফিরে এলেন না। আর আমি ঠাণ্ডা-বাতাস-দেওয়া হিটারটি বন্ধ করে, কতক্ষণ মন খারাপ করে বসে রইলাম।
কী করা যায়? হঠাৎ মনে হল, এখন ইচ্ছা করলে একটা বিশ্ব রেকর্ড করা যায়। বারান্দার দিকের দরজাটা খুলে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেই হয়ে যাবে বিশ্ব রেকর্ড। আমি উঠে গিয়ে বারান্দার দরজাটা খোলা মাত্রই এক ঝটকায় দুর্ধর্ষ রকম ঠাণ্ডা বাতাসের এক ঝটকা ঘরে ঢুকে পড়ল। রীতিমতো কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি আবার দরজা বন্ধ করে কোনো রকমে শুয়ে পড়লাম।
২
পরদিন থেকে আমাদের সম্মেলন শুরু। ঘুম থেকে উঠে দেখি, আকাশে ঝকঝকে সূর্য। শীতের পরিমাণ অনেক কম। আমাদের দেশের শীতকালের মতো অনেকটা।
রেডি হয়ে বাইরে এলাম। হোটেল থেকে দশ মিনিটের হাঁটা পথ। মঙ্গোলিয়ার সবচেয়ে উঁচু দালান ব্লু স্কাই হোটেল। সেখানেই আমাদের সম্মেলন। রাতে এয়ারপোর্ট রোড দেখে অনেকটা হতাশ হলেও, এখন বেশ ভালোই লাগছে। রাস্তাঘাট বেশ প্রশস্ত, ঝকঝকে। শীতের উৎকণ্ঠা নিয়ে মানুষ দ্রুত গন্তব্যের দিকে যাচ্ছে। তবে আমাদের পোশাক-আশাক আর চেহারা দেখে সবাই কেমন আড়চোখে তাকাচ্ছে।
বিদেশে সাধারণত সমস্যা হয় দুটো। একটি ভাষার সমস্যা, আর অন্যটি খাবারের সমস্যা। মঙ্গোলিয়ায় খাবারের কী অবস্থা, এটা নিয়ে আমরা সবাই উদ্বিগ্ন ছিলাম। সম্মেলনে গিয়ে দেখলাম, ওরা আমাদের জন্যে খাঁটি ভারতীয় খাবারের ব্যবস্থা করেছে। কিশোর নামে এক ভারতীয় খাবারের পাশে দাঁড়িয়ে; তার পাশে মঙ্গোলিয় একটি মেয়ে শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেই দুহাত মিলিয়ে কুর্ণিশ করতে করতে বলল, “নমস্তে।”
ভারতীয় খাবারের পাশে লেখা-- ‘হালাল খাবার’। কিশোর আমাদের আইডি কার্ড পরীক্ষা করে কেবল মুসলমানদেরকেই এখান থেকে খাবার নিতে দিচ্ছেন। খাবারের মধ্যে রয়েছে ভাত, পোলাও, রুটি, মুরগি, মাছ, সবজি, ডাল ইত্যাদি। বাঙ্গালিয়ানা খাবার পাওয়া গেছে, এই খুশিতেই আমরা তাধিন তাধিন করছি।
৩
সোম থেকে শুক্র পর্যন্ত টানা পাঁচদিন সম্মেলন হল। প্রতিদিন বিকেলে বা সন্ধ্যের পর আমরা মাফলার আর ওভারকোট গায়ে চাপিয়ে একটু ঘুরে বেড়াবার চেষ্টা করলেও, শীতের প্রকোপ আমাদের আবার ঠেলে হোটেলে পাঠিয়ে দিয়েছে। প্রথমদিন আমার রুমে হিটার চালু না হলেও, পরদিন ঘরে ফিরে দেখি রুমটি বেশ গরম। হিটার থেকে হু হু করে গরম বাতাস বের হচ্ছে।
হোটেলে ফ্রি ওয়াইফাই। আমি ঘরে ফিরেই বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বসলাম।
সম্মেলনের তৃতীয় দিনে বাংলাদেশ থেকে আরও তিনজন আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। ঢাকা ব্যাংকের প্রধান খোন্দকার ফজলে রশিদ, ব্যাংক এশিয়ার প্রধান মেহমুদ হোসেন ও দি সিটি ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক মঈনুদ্দিন। তাদের পেয়ে আমরা বেশ খুশিই হলাম। এ রকম ঠাণ্ডা দেশে গিয়ে মনটা যখন ঠাণ্ডা হয়ে যায়, তখন কাছে দেশের মানুষ পেলে বুকে বেশ বল পাওয়া যায়।
বুধবার রাতে মঙ্গোলিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগত অতিথিদের সম্মানে এক নৈশভোজের আয়োজন করল। সে অনুষ্ঠানে মঙ্গোলিয়ার এক সাংস্কৃতিক দল এত সুন্দর পারফর্ম করল, আমরা রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। অনুষ্ঠান শেষে সবাই সাংস্কৃতিক দলের প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ হয়ে গেলাম।
অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেল। আমাদের এখন হেঁটে-হেঁটে হোটেলে যেতে হবে। এখান থেকে দশ-পনের মিনিটের হাঁটা রাস্তা। ওভারকোট গায়ে চাপিয়ে আমরা যখন রাস্তায় নামলাম, তখন কেন জানি মনে হল, আজ শীতের চাপ একটু কম। ফারুক মঈনুদ্দীন প্রস্তাব দিলেন, “চেঙ্গিস খান স্কয়ারটা একটু ঘুরে আসা যাক।”
প্রতিদিন আমাদের সম্মেলন যেখানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তার উল্টো দিকেই চেঙ্গিস খান স্কয়ার। এটি মঙ্গোলিয়ার জাতীয় সংসদ ভবনও বটে। একটি বিরাট পাকা মাঠের শেষ প্রান্তে বিশাল একটি চেয়ারে বসে আছেন বীর চেঙ্গিস খান। আমরা অনেকক্ষণ খোলা প্রাঙ্গণে ঘোরাফেরা করলাম। আমরা যখন শীতে নিতান্তই কাবু হয়ে গেলাম, তখন হোটেলে ফেরার জন্যে পা বাড়ালাম।
আমাদের দলে মোটে আটজন, থাকি তিন হোটেলে। চেঙ্গিস খান স্কয়ার থেকে উল্টোদিকে চলে গেলেন এ আর খান। আর তিন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা চলে গেলেন আরেক দিকের হোটেলে। আর আমরা চারজন চললাম দশ মিনিটের হাঁটা রাস্তা পেরিয়ে, আমাদের হোটেলে। আমাদের হাত-পা তখন কাঁপছে। দ্রুত পা ফেলার চেষ্টা করছি। সারা শরীর জড়িয়ে আসছে। মুখমণ্ডল ঠাণ্ডায় কেমন যেন হয়ে গেছে। এমন সময় হঠাৎ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন মঙ্গোলীয় ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন, “তোমরা কী ভারত থেকে এসেছ?”
“না, আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ।”
“ও, আচ্ছা! তোমরা এখন কেন এসেছ? এখন তো শীত শুরু হয়ে গেছে।”
“সমস্যা কোথায়? আমাদের গায়ে তো শীত লাগছে না।”
“ওভারকোটটা খোল, তাহলেই লাগবে।”
“সেটা জানি। শার্ট-গেঞ্জি খুলে ফেললে আরও শীত লাগবে, সেটাও জানি।”
৪
শুক্রবার দুপুরে আমাদের প্রোগ্রাম শেষ হবার পর আয়োজকরা ভ্রমণের ব্যবস্থা করলেন। বিকেল তিনটার আগেই আমরা হোটেল ব্লু স্কাই এর পেছনের পার্কিং স্পেসে লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা বাসে উঠে পড়লাম। সোয়া তিনটার দিকে সারিবদ্ধভাবে বাসগুলো চলতে শুরু করল। গন্তব্য-- উলানবাটর থেকে ৫৪ কিলোমিটার পূর্বদিকে, টোউল নদীর পাশে ছনজিন বোলডগ নামের এক জায়গা। বলা হয়, চেঙ্গিস খান এখানে একটি সোনার চাবুক পেয়েছিলেন। সম্প্রতি সেখানে ঘোড়ায়-চড়া চেঙ্গিস খানের একটি ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে। আমরা মূলত সেটিই দেখতে যাচ্ছি।
বাসগুলো ধীরে ধীরে উলানবাটরের শহরতলীর রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। আশেপাশের বাড়িগুলোর মধ্যে একটা আভিজাত্যহীনতার ছাপ স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য মানুষগুলো ভারি কাপড়চোপড় পড়ে হাঁটছে। কেউ কেউ উৎসাহ নিয়ে ছোট ছোট চোখে তাকাচ্ছে আমাদের বাসের সারির দিকে।
বাস আরও এগিয়ে যাওয়ার পর আমরা রাস্তার দুপাশে বিশাল স্তেপভূমি দেখতে পেলাম। মাইলের পর মাইল ফসলহীন বিরানভূমির মতো পড়ে আছে এসব জমি। এখানে কিছু জন্মায় না। তবে লম্বা লম্বা হরিৎ রংয়ের ঘাস জন্মায়। দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন শুকনো গমক্ষেত। আসলে এগুলো উঁচু ঘাস।
রাস্তাটি নতুন, কোথাও কোথাও এখনও বানানো হচ্ছে। যে সব জায়গায় রাস্তার কাজ চলছে, সেখানে বাস ডান বা বাম দিকে খানিকটা নিচে নেমে কিছুটা ঘুরে যাচ্ছে। রাস্তার দুপাশে কোথাও কোথাও ঘের আছে। ঘের হচ্ছে ওদের আদি বাসস্থান। কিংবা বলা যেতে পারে ঐতিহ্যবাহী বাসস্থান। পাঁচ থেকে সাত হাত উঁচু গোলাকার এক রকমের ঘর। ঘের সাধারণত মোটা কম্বল জাতীয় কাপড় বা চামড়া দিয়ে চারদিকে ঘেরা থাকে। ঘরে আলো আসার জন্য ছাদের ঠিক মাঝখানে কাঁচ দেওয়া থাকে। ঘেরের একপাশে একটা দরজা থাকে। দরজাটাও কম্বল বা চামড়া দিয়েই তৈরি করা হয়। এই দরজা সব সময় বন্ধই রাখা হয়। ঘরে ঢোকার সময় বা বাইরে যাওয়ার সময় দরজাটি ঠেলে উপরে উঠানো হয়। শীতের সময় ঘেরের ভেতরটা গরম রাখার জন্যে কাঠ দিয়ে হালকা আগুনও জ্বালিয়ে রাখা হয়।
হাইওয়ে দিয়ে আমাদের বাস চলছে। চোখের সামনে কেবল শূন্য মাঠ। মাঠের পরে দূরে দূরে উঁচু-নিচু পাহাড়। মাঠে গরু, ঘোড়া আর ভেড়ার পাল ঘুরে বেড়াচ্ছে, ঘাস খাচ্ছে। তবে কোনো রাখাল নেই। মনে হচ্ছে পশুগুলো একেবারেই স্বাধীন। হঠাৎ আশ্চর্য চোখে লক্ষ্য করলাম, একজন ভদ্রমহিলা উটের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দুই কুঁজওয়ালা উট। আর দুই কুঁজের মাঝখানে বিশাল বপুর ভদ্রমহিলা বসে আছেন। আমি ক্যামেরা রেডি করতে করতেই তিনি দৃষ্টির অগোচরে চলে গেলেন।
আরও কিছুক্ষণ চলার পর আমরা চেঙ্গিস খানের ভাস্কর্যের এলাকায় এসে পৌঁছলাম। অনেক দূর থেকেই ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা চেঙ্গিস খানকে দেখা যাচ্ছিল। তিনি মঙ্গোলিয়ার জাতীয় বীর। এক সময় অর্ধেক পৃথিবী দখল করেছিলেন একাই। আর মঙ্গোলিয়ায় এসে আমার মনে হয়েছে, পৃথিবী দখল করা ছাড়া তাদের আর কোনো বিকল্পও ছিল না। এ দেশে খাবার তো জন্মেই না, শীতকালে উল্টো একেবারে কাবু হয়ে ঘেরের ভেতর বসে থাকতে হয়। সুতরাং, বাঁচতে হলে সাম্রাজ্য লুঠ করা ছাড়া আর উপায় কী!
চেঙ্গিস খানের ভাস্কর্যটি ৪০ মিটার উঁচু। ওদের দাবি, এটাই পৃথিবীর সর্বোচ্চ ভাস্কর্য। ভাস্কর্যের ভেতর ১০ মিটার উঁচুতে একটি পর্যটন কেন্দ্র আছে। ভাস্কর্যটিতে মোট ৩৬টি কলাম আছে। এই ৩৬টি কলাম চেঙ্গিস খান থেকে শুরু করে লিগদান খান পর্যন্ত মোট ৩৬ জন খানের স্মৃতি বহন করে।