তাই বাড়ির বসার ঘরে তার বাঁধানো ছবির পাশে এসে দাঁড়াই। অনেককিছু মনে পড়ে। তিনি তার পড়াশোনা আর লেখালেখির মাঝেই সময় করে আমাদের তিন ভাই-বোনকে স্কুল থেকে আনতেন। বাসার কাছেই ছিল নিউমার্কেট আর পলাশীবাজার। এই দুই বাজার থেকে চাল, ডাল, তেল, নুন কিনে রিকশায় বাসায় ফিরতেন।
মায়ের অর্থে কেনা গাড়িটা বাবা বলতে গেলে তেমন ব্যবহার করতেন না। গাড়ি চড়ে আমরা কলেজে যেতাম, শিক্ষকের কাছে পড়তে যেতাম। যদি কখনও তাকে বলতাম, ‘তোমার গাড়ি লাগবে?’ বাবা বলতেন, ‘আমার তো বাসার পাশেই বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে গাড়িতে যাব কেন? তোমরা বাসা থেকে বেশ দূরে পড়তে যাও, তোমরা ব্যবহার কর বরং।’
বাবার সবসময় আমাদের পড়াশোনার দিকে ছিল প্রবল খেয়াল। ঠিকমত পড়ছি কিনা, পরীক্ষা দিচ্ছি কিনা, ফলাফল কেমন হচ্ছে, এসবের পই পই করে খেয়াল রাখতেন। একবার পরীক্ষার সময়, বাবা আমার রুমে এসে আমার পড়ার রুটিন দেখলেন। দেখলেন, ভোর চারটার সময় ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসবো। বাবা বললেন, ‘কে তোকে জাগিয়ে দিবে?’ বললাম- ‘মা’। বাবা কিছু বলেননি। পরের দিন দেখলাম, এলার্ম ক্লক কিনে নিয়ে এসেছেন।
মনে পড়ে বাবার সঙ্গে বইমেলায় গিয়েছিলাম । হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। এতো ভিড়ে যদি অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটে, বাবা ‘মৌলি’ বলে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
আমি জানি আমাদের চারপাশে যে সব পরিবার আছে সেসব পরিবারের সব বাবারাই এমন। বাবারা মায়ের মতো আমাদের আনন্দের সময় জড়িয়ে ধরতে পারেন না, আমাদের দুঃখে হাউমাউ করে কাঁদতে পারেন না। আমাদের সমাজ এমন যে, বাবা এখন বেশির ভাগ পরিবারেই গম্ভীর একটা ইমেজ নিয়ে থাকেন। যার কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মেয়েরা বাবার কাছে কিছুটা সহজ হলেও, ছেলেরা তা পারে না। আমাদের বেশির ভাগ সন্তানেরা তাদের কাউকে ভাল লাগলে বা তাদের শারীরিক সমস্যা হলে বাবার কাছে চট করে বলতে পারে না। ছেলেমেয়েদের মধ্যে বাবার সঙ্গে কেমন যেন একটা দেয়াল। আর এই দেয়াল- সমাজ ধীরে ধীরে তৈরি করেছে । বাবা আমাদের কাছে এখনও সংসারের অর্থ যোগানের ব্যক্তিই যেন। দেশে কত পরিবার যে আছে শুধু বাবা না থাকার কারণে নানা-নানি, দাদা-দাদি, মামা-খালাদের হয়েছে চক্ষুশূল। বাবার মৃত্যুর পরের দিন থেকে অনেক আত্মীয়স্বজন মুহূর্তে তাদের রূপ পাল্টাতে দেরি করে না যেন!
প্রশ্ন হল, সব বাবারাই কী এমন দায়িত্বশীল? সব বাবারাই কী সন্তানের কাছে নির্ভরতার-আশ্রয়ের জায়গা? তবে যে দেখি, অনেক বাবা বড় বড় সন্তান রেখে অবলীলায় তাদের মাকে ছেড়ে অন্য নারীকে জীবনসঙ্গী করে নেয়? এতে যে সন্তানের মনে প্রবল কষ্ট হয়,তা কি সেইসব বাবারা বোঝেন না? বাবাদের কী নতুন সংসার করার পর আগের ঘরের সন্তানদের জন্য মায়া হয় না? অনেক বাবাকে দেখেছি সন্তানের সামনে তাদের মাকে চরমভাবে অপমান করেন, যখন তখন করেন শারীরিক নির্যাতন, সেসব বাবাদের কাছ থেকে সন্তানেরা কী শেখে?
আমার পরিচিত এক পরিবারের কর্তা প্রায়শই তার সন্তানদের সামনে স্ত্রীকে মারধোর করতেন। একদিন তার স্ত্রী আমাকে জানালেন, তার দুই বছরের ছেলে সন্তান কিছু হলেই তার (মায়ের) চুল ধরে টানছে। আমার শুনেই বুক কেঁপে উঠেছে। বোঝার বাকি নেই যে, এতটুকুন ছেলে সে তার বাবাকে দেখেই এটা শিখেছে। অনেক বাবারা নিজের অজান্তে সন্তানদের নারীর প্রতি জঘন্য ব্যবহার করতে শেখাচ্ছেন। আমার ধারণা নারীর প্রতি খারাপ মনোভাব যেসব পুরুষ ধারণ করেন- তাদের সঙ্গে মনোবিজ্ঞানীরা যদি কথা বলেন, দেখবেন তারা তাদের বাবাকে মায়ের সঙ্গে সারাজীবন খারাপ ব্যবহার করতেই দেখেছেন, যা থেকে তারাও বের হয়ে আসতে পারেননি। অনেক বাবাকে দেখেছি প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর প্রথম ঘরের সন্তানদের ভরণপোষণ দেন না। অনেকেই যোগাযোগই রাখেন না। কিন্তু কেন? সন্তানদের কী দোষ? সব মা কী একাই সন্তানদের বড় করার জন্য আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হন?
এইসব শিশুরা কী ধরনের ফ্রাসট্রেটেড থাকেন -তা কি বাবারা বোঝেন? মাঝে মাঝে পত্রিকার পাতায় কিছু সংবাদ পড়ে আঁতকে উঠি- সৎবাবা (অনেক সময় নিজের বাবাও) মেয়েকে যৌন নিপীড়ন করতে চান। তখন মাথাটা কাজ করতে চায় না। তাহলে একজন মেয়ের যে পরিবার থেকেই পুরুষের ওপর বিশ্বাস চলে যায়, সে মেয়েটি কী পরবর্তীতে কখনও কাউকে বিশ্বাস করতে পারে? এভাবেই আমাদের দেশের অনেক মেয়ের বিশ্বাস পরিবারই ভেঙ্গে দেয়।
অনেক বাবা দেখেছি, মেয়ে বড় হতেই তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যান। আবার বিয়ের পর ভাবেন, এখন আর মেয়ে নিয়ে তাদের কোন চিন্তা নেই, সব দায়িত্ব এখন মেয়ের স্বামীর। তাই স্বামীর ঘরে মেয়ের ওপর নির্যাতনের কথা শুনলেও বলেন- মানিয়ে চলতে। কোনভাবেই সংসার ভাঙ্গা যাবে না। এতে তাদের সম্মান ধুলায় লুটিয়ে যাবে।
একবিংশ শতাব্দীতে এরকম বাবা দেখলে আমি বিস্মিত হই। আমি তো জানতাম বাবার দায়িত্ব মেয়েকে শেখানো, ঝড়ের মধ্যেও গাছ যেভাবে লড়াই করে দাঁড়িয়ে থাকে সেভাবে ভেঙ্গে না পড়ে পথ চলতে শেখানো। অন্যদিকে আমাদের দেশে খুব সাধারণ দৃশ্য হলো- বেশিরভাগ বাবাই বৃদ্ধাবস্থায় আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল থাকেন । তারা ছেলেমেয়ের কাছে হয়ে যান বোঝা। কিন্তু কেন? বাবাদের আমাদের পেছনে এত অবদান আমরা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কীভাবে ভুলে যাই! বাবা-মায়ের দায়িত্ব এখনও ছেলেরাই কেন নেবেন? মেয়েদেরও কি দায়িত্ব নেই? বাবা কি তবে মেয়েকে কম আদরে বড় করেছেন? এসব নিয়ে আমরা খুব বেশি কথা বলি না।
আমরা ছোটবেলা থেকে পরিবার নিয়ে অনেক বড় বড় কথা বলি, কিন্তু পরিবার থেকে মূল জিনিসগুলোই শিখি না। পরিবারে কার কী দায়িত্ব, কার কেমন আচরণ হবে, কয়টা পরিবার আমরা এ নিয়ে আলোচনা করি? আমরা শুধু মা-বাবার কাছ থেকে পেতে চাই- তাদের পাশেও যে একমসয় আমাদের থাকতে হবে- সেটা মাথায় রাখি না বললেই চলে।
মা-বাবারাও মানুষ। তারাও কিন্তু অনেকসময় অনেকের সঙ্গে ন্যায্য ব্যবহার করেন না। অনেক মা-বাবা ক্ষমতার দাপটে মানুষের ওপর জুলুম করেন, তখন কী আমরা সন্তান হিসেবে সেসবের প্রতিবাদ করি? সাধারণত বাবার ক্ষমতার দাপট বা অর্থ উপভোগ করতেই আমরা অনেকে পছন্দ করি। পরিবারের মতো মূল ও গুরুত্বপুর্ণ প্রতিষ্ঠানটি দিন দিন কেমন যে ভেঙ্গে পড়েছে। পুরোপুরি ভেঙ্গে যাওয়ার আগেই আমাদের তা মেরামত করা দরকার। শুধু ‘ফাদার্স ডে’ উপলক্ষে বাবাকে একটা পাঞ্জাবি কিনে দিয়ে বা পাঁচতারকা হোটেলে বাবার সঙ্গে খেতে খেতে ছবি তুললেই বাবার প্রতি যে দায়িত্ববোধ-ভালবাসা থাকা দরকার তা সম্পূর্ণ হয় না।
আমি চাই, বিভিন্ন সর্ম্পকের মধ্যে ঘুণ ধরলেও বাবা শব্দটার ওপর যেন কোন দাগ না পড়ে। বাবাদের সমুদ্রের মতো বিশাল করেই দেখতে ইচ্ছে হয়। এ সর্ম্পক যে রক্তেরও চিরন্তন। সব বাবাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানাই।
মৌলি আজাদ: লেখক, কবি হুমায়ুন আজাদের বড় মেয়ে
কিডজ পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |