আপা আমাকে আদর-যত্নে রেখেছিল। আমি আপার প্রতি বেশ সন্তুষ্ট ছিলাম। আপাও আমাকে পেয়ে বেশ খুশি হতো। আপার কোন সন্তান ছিল না। তাই আমাকে একটু বেশি আদর করত। আমি সেটা ঠিক বুঝে নিতাম।
এভাবে বছর পাঁচ-ছয়েক কাটে। তবে, গ্রামের কথা মনে হলে বেশ খারাপ লাগে। একদিন জোসনাদের কথা মনে হলো। জোসনা আমাদের গ্রামের ছগির চাচার মেয়ে। অন্যরা জোসনার সঙ্গে মিশতে না চাইলেও জোসনা আমার খুব প্রিয় ছিল। একসাথেই খেলতাম। দুজন দুজনের মনের কথা ভাগাভাগি করতাম। বৈশাখ মাসে আমাদের গ্রামে মেলা বসে। মেলা নিয়ে আমার আর জোসনার অনেক স্মৃতি।
শুনলাম, পয়লা বৈশাখে নাকি গ্রামে এবারও মেলা বসবে। ভাবতেই জানি কেমন লাগছে। কত বছর ধরে গ্রামে যাই না! আমাকে যে করে হোক এবছর বাড়ি যেতেই হবে। কিন্তু শিউলি আপাকে বাড়ি যাওয়ার কথা বললেই আপার মুখে কালো ছাপ দেখতে হয়। কিন্তু তারপরও তো আমাকে বাড়ি যেতে হবে।
তখন আপার কাছে রোজ রোজ বাড়ি যাওয়ার বায়না ধরি। আপা চাকরি করতো। কখনও ঘোরাঘুরির সময় পেতো না। একদিন হঠাৎ আপা আমাকে বলে-
কিরে হাসনা! তোর মন খারাপ কেন?
না আপা! কই আর মন খারাপ।
তোর মন খারাপ কেন বল? বাড়ি যেতে ইচ্ছা করে...
না।
তবে যে...
এমনিতেই।
এমন করে দু-তিন দিন কেটে গেলো। অন্যদিকে জোসনা, হারুন, দুর্জয় এদের কথা মনে উঠলে আমার এখানে থাকতে আর ইচ্ছে করে না। বিশেষ করে মেলার কথা ভাবলেই নিজের মাঝে কেমন যেন একটা উচ্ছ্বাস বেরিয়ে আসে। কিন্তু কী করে বলবো আপাকে! আমাকে তো বাড়ি যেতেই হবে।
আমাদের পাশের বাসার রীতি আমার খুব পছন্দের বান্ধবী। বিকেলে একসঙ্গে ছাদে উঠে গল্প করি। রীতি পড়াশোনা সম্বন্ধে আমাকে বেশ উৎসাহ দেয়। আমি রোজ রোজ কোন কথায় মনোযোগী হই। সিদ্ধান্ত নিলাম তাকে নিয়েই গ্রামের বাড়িতে যাব। চার দেয়ালের মাঝে আমার থাকতে একদম ইচ্ছে করছে না। কথামতো রীতিও রাজি হয়ে গেল।
পরে শুনলাম রীতির গ্রামের বাড়ি আমাদের ঠিক পরের গ্রামে। সেও এখানে কাজ করে। কিন্তু কাজ করা সত্ত্বেও সে ভীষণ মেধাবী। কিন্তু মালিক আঙ্কেলের বউ নাকি তাকে বেশ অত্যাচার করে। রীতির মুখে সেসব কথা শুনলে লোম শিউরে ওঠে। রীতি বড় হতে চায়। কিন্তু আমি খুব ফাঁকিবাজ ছিলাম। কাল থেকে পড়াশোনা শুরু করব, সে কাল আর কখনও আসত না।
রীতির মাঝে খুব সম্ভাবনা ছিল, সেটা ওর কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারতাম। কিন্তু দারিদ্রের কারণে আর্থিক অস্বচ্ছলতার জন্য তার সম্ভাবনাগুলো সম্ভাবনাই থেকে যেতো, বাস্তবে রূপ নিত না। রীতি আমার খুব কাছের একজন ছিল। আমাকে বিশ্বাস করে সব কিছুই বলতো। সে আমার প্রতি বিশ্বস্ত ছিল সেটা আমি ঠিক বুঝতে পেলাম।
শিউলি আপাকে বেশ বুঝিয়ে-টুঝিয়ে একটু মানানো গেল। কিন্তু তারপর একদম নারাজ। শুনলাম রীতি নাকি তার মালিকের বাসায় থাকবে না। সে নাকি পালিয়ে যাবে। বাড়ি যাওয়ার কথা বললে নাকি একদমই যেতে দেবে না বরং বেশি বেশি নির্যাতন চালাবে। সে নিজেই ঠিক করলো, সামনে শনিবার দু-জন সকালে রওনা দেবো। কিন্তু তখনও আমার সন্দেহ যে যাবো কিনা। শিউলি আপা যতটা ভালো আবার ততটা রাগি ছিলেন। কিন্তু আমি না গেলেও রীতি যাবেই। শেষমেষ, শিউলি আপা আমাকে যেতেই দিলো না। কিন্তু রীতি কে কী জবাব দেবো! বড় চিন্তায় পড়লাম।
পরদিন দেখা করতে গেলাম রীতির সঙ্গে। শুনলাম রীতি বাসায় নেই। হারিয়ে গেছে। খোঁজাখুঁজির পরও শহরে পাওয়া গেল না। কিন্তু আমিতো জানি রীতি কোথায়। কথা ভেতরে রেখেই বেরিয়ে এলাম। এদিকে শিউলি আপাকে রাজি করাতে পারলাম। মেলার দিন শিউলি আপা আমাকে সঙ্গে নিয়েই গ্রামে যাবে।
শহর থেকে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন। পরদিন পৌঁছে গেলাম। বাড়িতে পৌঁছে রীতির বাড়িতে গেলাম। শুনলাম, সে নাকি বেশ অসুস্থ। একটা ‘না’ উচ্চারণে তার মুখে এসিড দেওয়া হয়েছে। গ্রামের মান্যবররা কলঙ্ক বলে রীতির পরিবারকে গ্রামছাড়া হতে নির্দেশ দিল। মেলার দিন মেলা করতে না গিয়ে শিউলি আপাসহ রীতিকে দেখতে গেলাম হাসপাতালে।
রীতি হাসপাতলের বিছানায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে একটা ‘না’ উচ্চারণের জন্য। এসিডে তার মুখ ঝলসে গেছে। সে কোনরকম অস্পষ্ট কথা বলতে পারে। আমাকে দেখামাত্রই চোখের পানি জ্বলজ্বল করে ফেলতে লাগল। কাছে গিয়ে বসলাম। আমাকে মায়ার চোখে জোর গলায় বলল, ‘আমার মুখ ঝলসে গেছে, স্পষ্ট কথা বলতে পারি না তাতে কি! তুই বরং আমার হয়ে স্রষ্টার কাছে বিচার দিস!’
তানভীর ইসলাম: দশম শ্রেণি, কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়
কিডজ পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |