অ্যাই বড় অইয়েরে পুলিশ অইত চাই

তখনও পশ্চিম আকাশে রক্তিম সূর্য অস্তমিত হয়নি। প্রকৃতির স্নিগ্ধ বাতাস, পাখির কিচিরমিচির কুঞ্জন, শিশুদের হইহই চিৎকার সব যেন মিলেমিশে একাকার।

হিমু চন্দ্র শীলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 June 2022, 12:14 PM
Updated : 3 June 2022, 12:14 PM

পাখির মতো শিশুদের কিচিরমিচির শুনে কৌতূহল জাগল মনে। এক কদম দুই কদম করে এগিয়ে গেলাম সেই শব্দের উৎসের কাছে। গিয়ে দেখি স্কুল ছুটি হয়েছে। তবে আমাদের দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কিংবা ইংলিশ মিডিয়াম কোনো স্কুল নয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একটি লার্নিং সেন্টার যে যেখানে শিক্ষার্থী রোহিঙ্গা শিশুরা।

এইমাত্র স্কুলের ছুটির ঘণ্টা পড়লো। ঘণ্টা শুনে স্কুলে থাকা জনা পঞ্চাশেক শিক্ষার্থী খুশিতে আত্মহারা হলো। সবার হাতে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির পুষ্টিমান সমৃদ্ধ একটি করে বিস্কুটের প্যাকেট। সেই বিস্কুটের প্যাকেট হাতে নিয়ে সবাই খুশিতে হৈ-হুল্লোড়ে ব্যস্ত। তাদের দেখে মনে পড়ে গেল কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি। আহা, হাহা, হা। আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি’ কবিতাখানি।

মনে পড়ল ফেলে আসা শৈশবের স্নিগ্ধ সেই স্মৃতি। পেছনে ফিরে গিয়ে আবারও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবু একটু কাছে গিয়ে পাঁচ থেকে ছয় বছরের এক শিশুর কাছ থেকে জানতে চাইলাম তার নাম কী? হঠাৎ এক আগন্তুকের মুখ থেকে এমন কথা শুনে একটু হকচকিয়ে রোহিঙ্গা ভাষায় শিশুটি বললো, ‘আর নাম মোয়াম্মদ ইয়ায়া’ (আমার নাম মোহাম্মদ ইয়াহিয়া)। কোন শ্রেণিতে পড়? জানতে চাইলাম। ইয়াহিয়া বলল, ওয়ান গ্রেডে।

মিনিট দুয়েক কথা বলার পর মিশে গেলাম তার সাথে। প্রথমে কথা বলতে সংকোচ বোধ করলেও ইয়াহিয়া এবার নিঃসংকোচে বলতে শুরু করলো তার মনে জমানো কথাগুলো। কথায় কথায় জানতে পারলাম ইয়াহিয়ার চার ভাই, কোনো বোন নেই। সে সবার ছোট। চার ভাইয়ের মধ্যে তিন ভাই লার্নিং সেন্টারে পড়াশোনা করে নিয়মিত। তবে আরেক ভাই লার্নিং সেন্টার বা কোথাও পড়ে না। মা-বাবাকে সাথে নিয়ে ইয়াহিয়া বাস করে বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরের ক্যাম্প কুতুবপালং-এ।

মোহাম্মদ ইয়াহিয়া (৫)

পাহাড়ের ওপর দশ কি বারো হাতের ছোট্ট একটা ঝুপড়ি ঘরে তাদের বসবাস। কক্সবাজারের ভাষার সাথে রোহিঙ্গা ভাষার মিল আছে।তাছাড়া জাতিসংঘের একটি সংস্থার হয়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার সুবাদে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আমার প্রতিনিয়ত যাওয়া হয়। তাই রোহিঙ্গা ভাষাটাও ভালো করে জানি। রোহিঙ্গা ভাষায় ইয়াহিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বয়স কত? ইয়াহিয়া আঙ্গুল গুণে হিসেব করে উত্তর দিল, পাঁচ।

ইয়াহিয়া যখন বাংলাদেশে এসেছে তখন সে কতটুকু ছিল তা তার মনে নেই। কিংবা বাংলাদেশে আসার সময় আদৌ তার জন্ম হয়েছে কিনা তাও মনে নেই। কারণ তারা নিজের জন্মভূমি ছেড়ে এদেশে এসেছে পাঁচ বছর হতে চললো। সেই পাঁচ বছরে ইয়াহিয়া একটু একটু করে বেড়ে উঠেছে। ইংরেজি বর্ণমালা চেনে। বার্মিজ বর্ণমালা পড়তে পারে।পাশাপাশি ইংরেজি রাইমসও জানে। একটা ইংরেজি ছড়া শুনাতে বললাম। একটু ইতস্তত করে ইয়াহিয়া ‘টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার’ ছড়াটি এক নিমিষে বলে গেল।

কাঁধে ঝোলানো ইউনিসেফের ব্যাগটা দেখিয়ে বললাম, এটা কোথায় পেলে? হাসি মুখে জানাল, লার্নিং সেন্টার থেকে দিয়েছে। লার্নিং সেন্টার থেকে আর কী কী দেয় জানতে চাইলাম। ইয়াহিয়া ব্যাগের চেইন খুলে কিছু সুন্দর সুন্দর ছবিসহ বই, খাতা, পেন্সিল দেখাল। ইয়াহিয়াকে বললাম কোথাও বেড়াতে যাও কিনা। সে জানাল বেশ কয়েকবার টেকনাফের ক্যাম্পে এক আত্মীয়ের ঘরে বেড়াতে গিয়েছে। কক্সবাজারে কোনোদিন গিয়েছে কিনা জানতে চাইলাম। না সূচক উত্তর দিয়ে মাথা ঝাঁকাল ইয়াহিয়া। উল্টো আমার কাছ থেকে জানতে চাইল, কক্সবাজারে কী আছে? বললাম, অনেক বড় সমুদ্র আছে ওখানে।

একটু ফিকে হাসি দিয়ে ইয়াহিয়া বলল, এমন সমুদ্র সে টেকনাফে অনেক দেখেছে। জিজ্ঞেস করলাম, বড় হয়ে কী হতে চাও? শুরুতে কথাটি ইয়াহিয়া বুঝে উঠতে পারেনি। একটু বুঝিয়ে বলার পর বললো, ‘অ্যাই বড় অইয়েরে পুলিশ অইত চাই’ (আমি বড় হয়ে পুলিশ হতে চাই)।

লার্নিং সেন্টারের ব্যাগ কাঁধে ইয়াহিয়া

কথাটি একটু অদ্ভুত মনে হলো। জিজ্ঞেস করলাম পুলিশ কেন? ইয়াহিয়া উত্তরে জানাল ক্যাম্পে নিয়মিত পুলিশ দেখে সে। তাছাড়া পুলিশ খারাপ লোকদের শাস্তি দেয়। তাই ইয়াহিয়ারও স্বপ্ন পড়াশোনা শেষ করে বড় হয়ে পুলিশ হওয়ার আর খারাপ লোকদের শাস্তি দেওয়ার।

বাস্তবতা খুবই কঠিন। ইয়াহিয়ার অবুঝ মন হয়তো এখনও বুঝে উঠতে পারেনি এদেশে সে আশ্রয় নিয়েছে। এটা তার নিজের দেশ নয়। হয়তো কোনো একদিন এদেশ ছেড়ে পাড়ি জমাতে হবে তার নিজের দেশ মিয়ানমারে। একজন শরণার্থী শিশু হিসেবে ইয়াহিয়ার সেই স্বপ্ন এদেশে পূরণ না-ও হতে পারে। ইয়াহিয়া যদি সেটা বুঝতে পারত হয়তো এমন স্বপ্ন সে দেখত না।

দেখতে দেখতে সময় ঘনিয়ে আসল। ইয়াহিয়াও ঘরে যাওয়ার তাড়া অনুভব করল। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ইয়াহিয়াকে বললাম তোমার কয়েকটি ছবি উঠাব। কথাটি শুনে ইয়াহিয়া খুবই খুশি হলো। ছবি তোলার জন্য নিজের মতো করে কায়দা করে দাঁড়াল সে। বেশ কয়েকটা ছবি তোলার পর ইয়াহিয়া নিজের ছবিগুলো দেখার আবদার করল। এক এক করে সব ছবি দেখালাম তাকে।

এবার ফেরার পালা। এখনও পশ্চিম আকাশে সূর্য রক্তিম আভা ছড়িয়ে যাচ্ছে। বাতাস আরও স্নিগ্ধতা ছড়াতে শুরু করল। ইয়াহিয়াকে বিদায় জানিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম আমি। শরণার্থী শিশু বলে ছোট্ট শিশুদের মনে বুনতে থাকা এমন সব স্বপ্নের সলিল সমাধি হয়ে যাবে নাতো! এই ভেবে একটু হতাশই লাগল। ইয়াহিয়া মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে যাতে তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে মনে মনে সেই শুভ কামনা করে পা বাড়ালাম নিজ গন্তব্যে।

কিডজ পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!