মিষ্টুর ব্যাকরণ

মিষ্টু একটা ছোট মেয়ে। মোটে তিন বছরে পা দিয়েছে। আধো আধো কথা বলে।

ঝর্না রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 April 2022, 12:16 PM
Updated : 26 April 2022, 12:16 PM

মিষ্টু দেখতেও খুব মিষ্টি। গোল সাদা মুখ। বড় বড় চোখ। চোখ ভরতি কালো কালো দুটো মনি। মাথা ভরতি কোঁকড়া কোঁকড়া কালো চুল, কপালের ওপর থোকা থোকা কালো আঙুরের মতো ঝুলতে থাকে।

তবে মিষ্টুর নাম আর চেহারার চেয়েও মিষ্টি ওর আধো উচ্চারণের কথাগুলো। কপালে চুল ঝুলে পড়লে মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়। তখন মাকে বলে, আম্মু তপাল ব্যথা কলে। তুলে তিলিপ দিয়ে দাও। মিষ্টু ক চ ট ত সব বর্ণকেই বলে ত! র-কে বলে ল। ফলে ওর কথাগুলো শুনতে খুব মিষ্টি লাগে।

মিষ্টুর আর একটা বড় বোন আছে। ওর নাম মিতুল। মিতুলের বয়স ছয়। সে একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে কেজি ওয়ানে পড়ে।

মিতুলও দেখতে খুব সুন্দর। সিল্কের সুতোর মতো ঝলমলে চুল মিতুলের মাথায়। সে চুলে পাঞ্চ ক্লিপ রাবার কিছুই থাকতে চায় না। ঝপাৎ করে খুলে যায়।

তবে মিতুল জানে, মিষ্টু একটু বেশি সুন্দর। মিষ্টুর মুখটা নাকি একটা রসগোল্লার মতো। গোল টুলটুলে আর ধবধবে সাদা। মিতুলের রিনু ফুপু মিষ্টুকে যতবার আদর করে ততবার বলে, ইশ মিষ্টুটাকে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।

আবার ছোট চাচ্চুও বলে, ওলে মিত্তু লে, তোর তুলতুলে গালটাতে আঙুল দিয়ে খোঁচা দিলেই তো রস গড়িয়ে পড়বে লে! একথা বলে আর মিষ্টুর গাল দুটো দু’আঙুলে চেপে ধরে আদর করে। প্রতিবার চাপ দেয় আর বলে, ওলে ওলে মিত্তু সোনা লে। তুই এত মিত্তি কেন লে। তোকে আমি চেটে খাব লে। উম্মাহ। উম্মাহ।

কিন্তু মিষ্টুর গাল টিপে দিলেও কোনো রস বেরোয় না। বরং বিরক্ত হয়ে ও কেঁদে ওঠে। আম্মু আম্মু বলে কাঁদতে কাঁদতে আম্মুর কাছে চলে যায়। মাঝে মাঝে মিতুলের কাছেও চলে যায়। মিতুল তখন বোনকে আদর করে। বলে, তুমি এত বোকা কেন? চাচ্চু তো তোমাকে আদর করেছে!

মিষ্টু বলে, তাত্তু আমাকে থেয়ে ফেলতে তেয়েছে।

মিতুল বলে, চাচ্চু, তুমি সত্যি মিষ্টুকে খেয়ে ফেলবে?

চাচ্চু বলে, খাবই তো, ও তো মিষ্টি! মিষ্টি তো লোকে খায়ই! মজার খাবার!

মিষ্টু আবার কেঁদে ওঠে। না না থাবে না। আমাকে থাবে না। তুতুল আপুকে থাও।

চাচ্চু এবার ছোঁ মেরে মিষ্টুকে কাঁধের ওপর তুলে নেয়। বলে, আচ্ছা খাবো না। মিষ্টিও খাবো না, তেঁতুলও খাবো না।

মিষ্টুর যখন মাত্র দু’একটা করে বুলি ফুটছিল মুখে তখন একদিন মিতুলকে সে বলে ওঠে ‘তুতুল’। আর সেই থেকে ছোট চাচ্চু মিতুলকে রাগাবার জন্য বলে ‘তেঁতুল’। মিতুলের তখন খুব রাগ হয়। মিষ্টু তো ছোট্ট মেয়ে। ভালো করে কথাই শেখেনি। তাই ও যা ডাকে সেটাই সুন্দর লাগে। কিন্তু চাচ্চু তো ইচ্ছে করে মিতুলকে তেঁতুল বলছে! রাগে কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করে।

মিতুল যখন ছোট ছিল তখন মিষ্টুর মতই কিছু-না-কিছু হলেই চেঁচিয়ে কাঁদতো। এখন বড় হয়েছে, তাই কাঁদে না। বরং চাচ্চুকেও একটা পচা নামে ডাকতে চায়। কিন্তু মিতুল কোনো পচা নাম খুঁজে পায় না। তাই, চাচ্চু যখন ওকে তেঁতুল বলে তখন চাচ্চুকে বলে পিকাচ্চু। বলে, তুমি হচ্ছ একটা পিকাচ্চু। যদিও পোকেমন কার্টুন মিতুলের খুব ভালো লাগে। পোকেমনের পিকাচুকেও ভালো লাগে। কিন্তু চাচ্চুর সাথে মিলাতে হবে তো! তাই চাচ্চুর সাথে মিলিয়ে বলে পিকাচ্চু! কিন্তু পিকাচ্চু শুনে চাচ্চু রাগবে কী, উল্টা মিতুলকেও দু’হাতে উঁচু করে তুলে নিয়ে কাঁধে বসিয়ে বোঁ করে কয়েক পাক ঘুরিয়ে ছেড়ে দিয়ে বলে, থ্যাংক ইউ।

মিতুল অবাক। থ্যাংক ইউ কেন? তুমি মিতুলকে তেঁতুল বললে আমিও তোমাকে চাচ্চু বলবো না, পিকাচ্চু বলবো।

চাচ্চু আবার ওকে ঘোরাতে ঘোরাতে বলে, বল, বেশি করে বল। তাহলে তো আমি খুবই খুশি হই। আমি কালই এফিডেভিট করে আমার নাম বদলে ‘পিকাচ্চু’ করে ফেলবো। সিফাত একটা নাম হলো? কদিন ধরে ভাবছিলাম আমার নামটা সিফাত না হয়ে ‘সিসিম ফাঁক’ হলে ভালো হত। এখন পেয়ে গেছি! পিকাচ্চু! পিকাচ্চু হায়দার ইবনে শাহনাওয়াজ। শাহনাওয়াজের পুত্র পিকাচ্চু হায়দার! দারুণ লাগছে রে শুনতে!

মিতুল খুব ভাবনায় পড়ে গেল। আব্বুর কাছে গেল। আব্বু, চাচ্চু আমাকে কেন তেঁতুল বলে। আমি কি টক?

বাবা মেয়েকে আদর করে বলে তুমি টক হবে কেন? তুমি আমার মিষ্টি মামনি।

মিতুল গাল ফুলায়। না আমি মিষ্টি না, তাহলে তো আমার নামই মিষ্টি হতো! মিষ্টু বেশি মিষ্টি, তাই না আব্বু?

আব্বু খুব সমস্যায় পড়ে যান। বলে, ছোট চাচ্চু তোমাকে আদর করেই তেঁতুল বলে। বাচ্চাদের নামগুলো আদর করতে করতেই হয়ে যায়। মিষ্টুর নামটা ওভাবে আদর করতে করতে হয়ে গেছে।

না, চাচ্চু আমাকে তেঁতুল বলবে না। আদর করবে না। মিতুলের চোখে পানি এসে যায়।

আম্মু এসে বলে, তোমার মিতুল নামটাও তো আদর করতে করতেই হয়েছে। খুব তুলতুলে গাল তোমার। তুলতুল থেকে মিতুল! মিতুল কান্না থামায়। নিজের গাল চেপে বলে, সত্যি আমার নাম কি আদর করতে করতে হয়েছে আব্বু?

হুম! আদর করতে করতেই তো? কত কিছু ডাকতাম তোমাকে! তুলতুল তুলতুলি বুলবুলি নুলনুলি কুলকুলি ঝুলঝুলি মিটুস-মিটুস পিটুস-পিটুস উতুলমুতুল..

নামের ছড়া শুনে মিতুল হেসে কুটিপাটি হয়।

কয়েকদিন পরের কথা। সবাই মিলে খেতে বসেছে। মিষ্টুকে একটা প্লেটে কিছু ভাত দেওয়া হয়েছে। ও কখনও হাত দিয়ে কখনও একটা চামচ দিয়ে সেই ভাত খাওয়ার চেষ্টা করছে। তা দেখে সবাই খুব মজা পাচ্ছে।

মিতুলকেও এখনও ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিতে হয়। আম্মু মিতুলের মুখে ভাতের লোকমা তুলে দিচ্ছে। মিতুল খেতে খেতে ছোট বোনের কাণ্ড দেখে হেসে ওঠে। দেখ আম্মু, মিষ্টু চামচ উল্টা করে ধরেছে। কী বোকা! ঠিকমত চামচও ধরতে শেখেনি!

ছোট চাচ্চু একথা শুনে মিতুলের দিকে তাকিয়ে কেমন করে যেন একটু হাসে। মিতুল ঠিক বুঝে যায়, আম্মু খাইয়ে দিচ্ছে বলে ছোট চাচ্চু এভাবে তাকাচ্ছে। মিতুল হঠাৎ বলে, আমি নিজের হাতে খেতে পারি আম্মু।

আচ্ছা, বলে আম্মু থালাটা মিতুলের সামনে দেয়। আর সিফাতের দিকে চেয়ে ইশারায় কী একটা বলে। অবশ্য সেটা ঠিক বুঝতে পারে না মিতুল।

মিষ্টু ততক্ষণে মিতুলের প্লেটের ওপর হামলা চালিয়েছে। নিজের প্লেটটা ঠেলে দিয়ে মিতুলের প্লেট টেনে নিয়ে গেল নিজের কাছে। মিতুল বলে, মিষ্টু, তুমি এটা খেতে পারবে না। এই ভাত ঝাল তরকারি দিয়ে মাখা হয়েছে। তোমার ঝাল লাগবে। অনেক ঝাল! কিন্তু মিষ্টু কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। এক খাবলা ভাত তুলে নিয়ে সামনে ছুড়ে মারে। বলে এই ভাত আমার। আমি এতা থাবো!

বাধ্য হয়ে মিতুল নিজের প্লেট ছেড়ে দেয়। বলে, মিষ্টু এত দুষ্টু কেন আম্মু? আমি এখন কী খাবো! কিন্তু আম্মু আব্বু সিফাত চাচ্চু কেউই মিতুলের এ কথায় পাত্তা দেয় না। সবাই মিলে মিষ্টুর কাণ্ড দেখে আর হাসে। যেন মিতুলের প্লেট টেনে নিয়ে ভাতগুলোকে এদিক ওদিক ছড়িয়ে দেওয়াটা খুব ভালো কাজ!

মিতুল আর পারে না। ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, আমি আর ভাত খাবো না। মিষ্টুই খাক।

মিতুলকে কাঁদতে দেখে মিষ্টু কী যেন ভাবে। তারপর প্লেটটা দুহাতে ধরে মিতুলের সামনে রাখতে রাখতে বলে, তেঁদো না লিতুলাপু! তুমি থাও!

কী বললো মিষ্টু? লিতুল? লিতুলাপু মিতুলকে বললো? লিতুল? চাচ্চু চেঁচিয়ে ওঠে। এই মিষ্টু দুষ্টু, তুই কী বললি? লিতুলাপু? ও তো তেঁতুল। বল, তেঁতুল আপু!

মিতুল চেঁচিয়ে ওঠে। আম্মু, দেখ পিকাচ্চু আমাকে আবার তেঁতুল বলছে। আবার মিষ্টুকেও শিখিয়ে দিচ্ছে। পিকাচ্চু এত খারাপ কেন আম্মু?

মিষ্টু ততক্ষণে সিফাতের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। প্লেট থেকে এক মুঠো ভাত তুলে সিফাতের কোঁকড়া চুল ভরতি মাথাটার ওপর ছেড়ে দিতে দিতে বলে, তাত্তু তুমি পতা। লিতুল আপু তেঁতুল না। লিতুল! লিতুল!

মিতুল হঠাৎ বুঝতে পারে, মিষ্টু ওকে মিতুলই বলছে। তবে আধো আধো উচ্চারণের কারণে ওর ম বর্ণটা ল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কী মিষ্টি শোনাচ্ছে! লিতুল! মিষ্টুর কচি কচি টুকটুকে গোলাপি ঠোঁটের ভেতর থেকে এক ফোঁটা মধুর মতো বের হয়ে আসছে নামটি লিতুল। সে মিষ্টুর হাত ধরে আদর করে বলে, থ্যাংক ইউ মিষ্টু! তুমি আমাকে লিতুলই বল। যখন তুমি আর একটু বড় হবে, তখন মিতুল বলতে শিখে নিও কেমন?

মিষ্টু তার দুই পাটিতে সব মিলিয়ে আটটা দাঁত ঝিকমিকিয়ে অপরূপ হাসি হাসে। বলে, আমি তো বল হয়ে গেছি! আমি লিতুল বলতে পালি।

মিতুল মিষ্টুর দুই কাঁধে হাত রাখে। পারো? তা হলে বল!

তী বলবো?

বল, আমি তো বড় হয়ে গেছি!

বলছি তো, আমি তো বল হয়ে গেছি!

মিতুল হাসে। হ্যাঁ খুব বড় হয়েছো! এবার বল, মিতুল।

লিতুল!

লিতুল না, বল, মি-ই-তু-উ-ল।

লি-ই-তু-উ-ল!

খাওয়ার টেবিলে সবাই আবার হো হো করে হেসে ওঠে। একসাথে সবার হাসি দেখে ভড়কে যায় মিষ্টু। ভাবে ওকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করছে। সে ভ্যা করে কেঁদে ফেলে। মিতুল তাড়াতাড়ি বোনের চোখ মোছায়। কাঁদছো কেন মিষ্টুমনি! তোমাকে তো কেউ বকা দেয়নি! তুমি ঠিক বলেছো! আমার নাম লিতুল! হ্যাঁ, লিতুল!

মিষ্টু কান্না থামিয়ে বোনের দিকে তাকায়। তারপর ঢোঁক গিলে বলে, না, তোমাল নাম লিতুল না, লি-তু-ল!

মিতুল ততক্ষণে মিষ্টুর উচ্চারণের ব্যাকরণ ভালোভাবে বুঝে ফেলেছে। সে ল-কেও ল বলছে, ম-কেও ল বলছে! মিতুল আবার বোনের গালে আদর দেয়। বলে, ঠিক বলেছো, আমার নাম লিতুল না, মিতুল, তাই তো?

গাল ভাসিয়ে হাসে মিষ্টু। প্রবল বেগে ওপরে নিচে মাথা ঝাঁকায় আর বলে, হ্যাঁ তোমাল নাম লিতুল না, লিতুল!

কিডজ পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!