স্বপ্ন দেখো ফুটবল নিয়ে

বরাবরের মতোই ওরা চারজন বুড়িগঙ্গার তীরে বসেছে। দূষিত পানির দুর্গন্ধ নাকে আসছে।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 April 2022, 12:04 PM
Updated : 26 April 2022, 12:04 PM

যথারীতি পাড়টাও নানা আবর্জনায় ভরা। কিন্তু রনি, অনিক, মমিন ও ভ্যাবলা এই চার বন্ধু এপাড়ে প্রতিদিন আড্ডা দেয়। কারণ, নদীর বিশালতা ওদের মুগ্ধ করে।

শৈশব পেরিয়ে ওদের গায়ে কৈশোরের রোদ লেগেছে, কিন্তু ওরা বিচ্ছিন্ন হয়নি। যেন হরিহর আত্মা। ভালো ছাত্র নয় বলে নামকরা হাইস্কুলে পড়ার টিকেট মেলেনি, তাই ওরা একই স্কুলে পড়ে। পড়ে না বলে বলা ভালো, স্কুলে আসা-যাওয়া করে আরকি। মহল্লায় উচ্ছন্নে যাওয়া ‘ফাজিল ফোর’ বলে তাদের বিশেষ সুনাম আছে।

রুটিন মেনে ক্লাস করার অভ্যাস চারজনের কারও নেই, কিন্তু নদীর পাড়ে প্রতিদিন বিকেলে বসার (বদ)-অভ্যাসটা ওদের অটুট, সেই ‘ন্যাংটাকালের’ মতোই। তাই বাড়িতে সকাল-বিকেল বাবা-মায়ের ঝাড়ি, স্কুলে শিক্ষকদের কাছে পড়া না পারার বেতের বাড়ি সয়ে ওরা এখানে আসে। নানাপদের গল্প করে। মহল্লার কে আম-কাঁঠাল চুরি করতে গিয়ে প্যাদানি খেয়েছে, পিকনিকের জন্য মুরগি চুরি করতে গিয়ে কে ধরা খেয়ে কানধরে উঠবস করেছে- এসবই মূলত তাদের গল্পের মূল রসদ।

ওদেরও এই প্যাদানি খাওয়া, কান ধরে শতবার উঠ-বস করার অভিজ্ঞতা যে নেই, তা নয়। ওরাও একই দলের। রাতে পড়া মুখস্থ না করে কান ধরে উঠ-বস করার প্র্যাকটিস করে। তবে ফুটবল ওদের প্রাণের খেলা। এই চর্মগোলক পেলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে দিন পার করে দিতে পারে অনায়াসে। এই চার দুষ্টুর শিরোমণির মধ্যে ভ্যাবলা বাদে তিনজনই স্বপ্নবাজ। স্বপ্ন দেখে ওদের মতো করে দুনিয়া জয়ের।

প্রতিদিনই ওরা এই নির্ধারিত স্থানটায় আসে। বসে। কেউ কারও গায়ে মাথা গলিয়ে শোয়, আড্ডা দেয়। ঘরে-বাইরের নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা নিয়ে গপ্পো-হাসাহাসি করে। কিন্তু আজ ওদের মিটিংয়ে বিষয় অন্যকিছু। স্কুলে বা বাবা-মায়ের কাছ থেকে নিত্য চড়-থাপ্পড় খাওয়া, কিংবা প্রাইভেট পড়তে গিয়ে নিল-ডাউন হয়ে থাকার ইস্যু নিয়ে নয়, আজ তাদের আড্ডা অদ্ভুত এক বিষয় নিয়ে। ভ্যাবলা ছাড়া বাকি তিনজনই আগের রাতে স্বপ্ন দেখেছে, সে গল্প নিয়ে।

শুরুটা করল রনি। সে স্বপ্ন দেখেছে বুড়িগঙ্গার পাড়ে নয়, বসে আছে ব্রাজিলের রিও নদীর ধারে। রিওর স্রোত তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, ‘আয় রনি আয়। আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়। তাহলে একদিন তুই মাইকেল ফেলপস হবি। দুনিয়া জয় করবি।’

ওদিকে রিও দে জেনেইরোর লাগোয়া ফাভেলা (বস্তির) বন্ধুরা ডাকছে ফুটবল খেলতে। ফুটবল তো নয়, কোত্থেকে একটা বাতাবি লেবু জোগাড় করেছে। ওটাই নিয়েই খেলা হবে। ফাভেলার দুষ্টু বন্ধুরাও ডাকছে, সেখানে নিষিদ্ধ ড্র্যাগ (কোকেন-মদ থেকে শুরু করে সবকিছু) তো আছেই, পিস্তল-বন্দুকও সেখানে মামুলি ব্যাপার, চাইলেই পাবি, মাস্তান হতে পারবি, সিটি অব গডসের মতো ফাভেলার রাজা হবি- চলে আয় আমাদের দলে।

কিন্তু ফেলপস হওয়ার বাসনা নিয়ে রনি রিও নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল না, মাস্তান হওয়ার নেশায় ওদের দলেও যোগ দিল না। ও ছুটল বাতাবি লেবু দিয়ে খেলা ফুটবলের দিকে। এরপর ঘড়ির কাঁটা ঘোরে। দিন যায়, রাত আসে। এমনি করে মাস গড়ায়, বছর গড়ায়। মায়ের বকুনি সয়ে ও লেগে থাকে ফুটবল (বাতাবি লেবু) নিয়ে। কখনও রিওর বালুর পাড়ে, কখনও ফাভেলার অলি-গলিতে, কখনও রিও দে জেনইরোর রাস্তায়।

এভাবেই একদিন সুযোগ পেয়ে যায় একটি ক্লাবে। ডাক আসে ব্রাজিল দলেও। বাকিটা ইতিহাস। ব্রাজিলকে দুটি বিশ্বকাপ এনে দেয়। ফ্রান্সের ১৯৯৮ বিশ্বকাপ ফাইনালে সে রহস্যময় অসুস্থতার কারণে খেলতে পারেনি বলে ওর দল রানার্সআপ হয়। এই বলে কিছুটা বিষণ্ন মনে রনি বলল- স্বপ্নের শেষটা দেখা হয়নি। বাবার হেড়ে গলার ডাকে ঘুম ভাঙল। স্বপ্নেরও জলাঞ্জলি সেখানে। বন্ধুর স্বপ্নের দুরবস্থা দেখে বাকিরা হো হো করে হাসে। হাসতে হাসতে কেউ কাশেও!

বন্ধুদের হাসি-কাশি দেখে ভীষণ রাগ হয় রনির। কষে একটা থাবা দিয়ে অনিককে বলে তুই কী স্বপ্ন দেখেছিস, সেটা বল দেখি। থতমত খেয়ে এবার বলা শুরু করে অনিক। রোসারিও রাস্তায় সে হাঁটছে। সমবয়সীদের অনেকেই ‘বাট্টু-বাট্টু’ বলে ডাকছে, হাসাহাসি করছে। বাবা-মার চিন্তার শেষ নেই ছেলে কেন লম্বা-চওড়া হচ্ছে না। ওর তো এমন বামন হওয়ার কথা নয়! কিন্তু দেখা গেল হরমোনের সমস্যা। কিন্তু সে ফুটবল ভালো খেলে, গোলাকৃতির এই বস্তুটা তার পায়ের কথা শোনে। বাবার চোখেও পড়ল সেটা। বাবার হাত ধরে সে গেল স্পেনের বার্সেলোনায়। সেখানেই তার পায়ের কারিকুরি দেখে চুক্তিটা সেরে নিল স্পেনের নামকরা ক্লাবটি। রোসারিও বদ ছেলেপেলেদের সঙ্গে তার আর মেশার কোনো সুযোগই রইল না।

বার্সেলোনার লা মেসাইয়া একাডেমি হলো তার দ্বিতীয় ঘর। মায়ের জন্য কান্না পায়। রোসারিও ন্যাংটাকালের বন্ধুদের জন্য আরও বেশি কান্না পায়। ফেলে আসা বন্ধুদের জন্য মন ভার হয়ে থাকে। কিন্তু নতুন বন্ধুদের সঙ্গে সে মানিয়ে নিল। একদিন সুযোগ পেল বার্সেলোনার মূল দলে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে শুরু করে ক্লাব ফুটবলের শিরোপায় চুমো আঁকল। তারপর আর্জেন্টিনার হয়েও কোপা আমেরিকা শিরোপা জিতে ‘বাট্টু পারে না’ এই কথার জবাব দিল। তারপর কাতার বিশ্বকাপ মিশনে যাবে, এমন সময় মশার কামড়ে ভাঙল ঘুম। স্বপ্নও ভাঙল। মমিন বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, ঢাকার মতো রোসারিওতেও মশা আছে! মজা নিস নাকি? মশার কামড়ে স্বপ্ন ভাঙা নিয়ে ইয়ার্কি করা শুরু করল রনিও।

সেই ছোটবেলা থেকেই ভ্যাবলা একটু ভাবুক প্রকৃতির। গল্প শুনে, কাণ্ডকারখানা দেখে সে শুধু হাসছে। বলল, এই সবাই থাম- মমিন এবার তুই বল।

মমিন বলা শুরু করে, তোরা আর কী স্বপ্ন দেখেছিস, ওখানে তো কোনো রোমাঞ্চই নেই! ফালতু সব। গালগপ্পো। আমি যে স্বপ্ন দেখেছি, সেটা শুনলে হয় বুড়িগঙ্গায় ঝাঁপ দিবি, না হয় এখানে হা করে সরারাত বসে থাকবি। শোন, গতরাতে স্বপ্নে দেখলাম ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের রাস্তায় হাঁটছি। দুষ্টু পোলাপানের অভাব নেই সেখানেও। বদমায়েশগুলো শুরু করল গোলাগুলি। বেশ কয়েকটা গুলি লাগল আমার গায়ে। কোমায় থাকলাম মাসের পর মাস। কোমায় থাকলেও ফুটবল খেলতাম! মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে থাকলাম এবং জয়ী হয়েই ফুটবলের সবুজে ফিরলাম। পিতৃপুরুষের ভিটে বাংলাদেশে হওয়ায় একদিন খেলা শুরু করলাম বাংলাদেশের হয়ে। অধিনায়কের আর্মব্যান্ডও পরলাম বাহুতে। এগুলো বলতে বলতে মমিন কেমন যেন আনমনা হয়ে যায়, তার চোখে ভিজে ওঠে, কণ্ঠ ভারি হয়।

ইয়ার্কি-ফাইজলামিতে প্রতিদিন জমজমাট আড্ডা হয়। হো-হো করে প্রাণখুলে সবাই হাসে। হাসতে হাসতে একে অন্যকে কিল-ঘুষি দেয়, পাছায় লাথি মেরে বুড়িগঙ্গার পাড় থেকে নিচে ফেলে দেওয়ার জোগাড়ও করে, কিন্তু আজ সবাই চুপ। স্বপ্নের গল্পগুলো শুনে কারও মুখে কোনো কথা নেই। মৌনতা ভাঙে ভ্যাবলা, এই বন্ধুটি খুব ভাবুক বলে সবাই তাকে ভ্যাবলা বলেই ডাকে। তো ভ্যাবলা বলতে শুরু করে- রনি তুই দেখেছিস ব্রাজিলের রোনালদোর স্বপ্ন, অনিক তুই দেখেছিস লিওনেল মেসিকে, মমিন তুই দেখেছিস আমাদের জামাল ভূইয়াকে। এখনও ভেবে দ্যাখ, স্বপ্ন সত্যি করার পথে ছুটবি কিনা! যদি ছুটিস, আমিও আছি তোদের সঙ্গে।

বুড়িগঙ্গার স্রোতে তখন সবে সূর্যমামা গা এলিয়ে দিয়েছে। ফিকে হয়ে আসছে চারদিক, কিন্তু ওদের মনে জ্বলজ্বল করছে আলো। বুড়িগঙ্গাকে রিও নদী মনে হয় রনির কাছে। ‘বাট্টু’ নামে নাজেহাল হওয়া মেসিকে নিজের মধ্যে দেখে অনিক। মমিনের মনে হয় কোপেনহেগেন নয়, পল্টনের পথেই গোলাগুলির শিকার হয়ে প্রাণে বেঁচে গেছে সে।

চারবন্ধুই একসঙ্গে হাতে হাত রেখে উঠে দাঁড়ায়। পৃথিবী গোল (ডিম্বাকৃতির), ফুটবলও গোল। গোল (লক্ষ্য) তাদের একটাই- ফুটবল পায়েই একদিন বিশ্বজয় করতে হবে! তুলে ধরতে হবে লাল-সবুজের পতাকা।

লেখক পরিচিতি: সিনিয়র ফুটবল করেসপন্ডেন্ট, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

কিডজ পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!