পহেলা বৈশাখের স্মৃতি

কবির এখন যে সিটে বসে আছে তা জানালার পাশে। সেখান থেকে রাস্তাঘাট অনেক ভালো করেই দেখা যাচ্ছে।

রহমাতুল্লাহ আল আরাবীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 March 2022, 05:17 AM
Updated : 23 March 2022, 05:17 AM

উড়ে যাওয়া ধুলো যেন কাচের জানালা ভেদ করে ভেতরে ঢুকে পড়তে চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। কবির একনাগাড়ে জানালার ধারে তাকিয়ে ছিল। বাসে চড়া তার কখনোই পছন্দের তালিকায় ছিল না। আব্বু যে কেন বাসে চড়িয়ে আনতে গেল তা সে কোনভাবেই বুঝে উঠতে পারছে না!

এখান থেকে কল্যাণপুর যেতে হলে তো লঞ্চ, ট্রেন অনেক কিছুই ছিল। তাছাড়া আব্বু তো জানে যে, বাসে আমার অনেক সমস্যা। বমি বমি আসে। এতসব কথা ভাবতে ভাবতে সে তার বাবার দিকে তাকালো। বাবার দৃষ্টিও গেল তার দিকে।

কিরে? কেমন লাগছে এখন?

ভালো না আব্বু। তুমি বলেছিলে যে ট্রেনে যাবো দাদির বাসায়। কিন্তু তুমি যে কথার বরখেলাপ করলা! এটা কিন্তু ঠিক না।

আব্বু আমিও তো ট্রেনেই আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু টিকিটের তো টিকিটাও পেলাম না। কী করবো বল্?

আব্বুর প্রশ্নের কোন উত্তর তার জানা নেই। তারা এখন যাবে কল্যাণপুরে। দাদির বাসায়। আম্মু কয়েকদিন আগে চলে গিয়েছিল তার বান্ধবীর বাসায়। তার বান্ধবীর বাবা নাকি মারা গেছেন গত পরশুদিন। আম্মু কবিরকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু কবিরই রাজি হয়নি। রাজি হবই বা কেন? সেদিন আর নেই। আমি এখন বড় হয়ে গেছি। আর আব্বুটাও যেন কেমন? জোর করছিল খুব। আব্বু কি জানতো না যে, সে যদি এখন যায় মায়ের সঙ্গে সবাই ভাববে সে এখনও ছোট। তার কত খারাপ লাগবে তখন!

যাক অবশেষে কবির বুঝাতে সক্ষম হলো। আম্মুও চলে গেল তার বান্ধবীর বাসায়। বাসায় ছিল সে ও তার বাবা। এরই মধ্যে এসে গেল পহেলা বৈশাখ। আব্বু বলে উঠলো, কবির! চলো তোমার দাদির বাসা থেকে বেড়িয়ে আসি। সেখানে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে কত যে আয়োজন হয় তা তুমি জানলে চমকে যাবে।

নতুন কিছু জানার ব্যাপারে কবির ছিল সবসময়ই এক পায়ে খাঁড়া। বলতে দেরি হলেও তার সায় দিতে হয় না মোটেও দেরি। দাদির বাড়ি গিয়ে কবির কী কী করবে তার একটা প্ল্যান মনে মনে বানাতে শুরু করে দিলো।

এই কল্যাণপুর নামার আছে? কল্যাণপুর? বাসের হেল্পারের হাকডাঁকে অবশেষে সে দিকে মুখ তুলে তাকালো কবির। বাসে উঠার পর থেকে তো শুধু জানালার দিকেই তার দৃষ্টি ছিলো। সম্ভবত সামনে তাকালো এই প্রথম। বাসের হেল্পার সবাইকে নামার তাড়া দিতেই মনে হয় এগিয়ে আসছিলেন। তবে হেল্পার হয়তো জানে না বাবাকে যতোই তাড়া দেওয়া হোক না কেন, ভিড় না কমা পর্যন্ত বাবা কখনই নামার ঝুঁকি নেবে না।

একবার কবির খুব চালাকি করে আগে নামতে গিয়েছিল। সে সময় তার বয়স ছিল ৫। তো যেই নামতে যাবে অমনি ধাক্কা খেয়ে গেল পড়ে। তারপর থেকে সেও আর নামার জন্য তার বাবাকে তাড়া দেয় না। ভিড় শেষ হতেই বাবা পত্রিকাটা চোখের সামনে থেকে সরিয়ে তার দিকে তাকালো। বুদ্ধিদ্বীপ্ত চাহনি। বাবার চাহনিতেই কবির বুঝতে পারলো যে তাকে এখন নামতে হবে। সে সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল। বাবাও গেল দাঁড়িয়ে। এরপর নামতে শুরু করলো তারা।

কবির এখন অনেক ক্লান্ত। কিন্তু তার বাবার মধ্যে ক্লান্তির কোনো ছাপ নেই। বাবা তাকে দাঁড় করিয়ে মিষ্টির দোকানে চলে গেল। ৫ মিনিট পর বের হলো। এরপর একটা রিকশা ডেকে দিলো। সুভাদাস লেনে যাবে তারা। ১০ মিনিট ভ্রমণের পর অবশেষে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছলো তারা। দাদা বাড়ি পৌঁছে দেখলো উৎসব-উৎসব পরিবেশ। ঘর-দোর সম্ভবত গোছানো ছিলো আমরা আসবো বলে। বছরে মাত্র একবার এই দিনেই আসা হয় তাদের দাদিবাড়ি। স্কুল-কলেজ, কোচিংয়ের চাপে আসা হয় না কখনও।

দাদিমা বিছানা থেকে উঠেছিলেন অনেক আগেই। বসেছিলেন চেয়ারে। কদিন থেকে খুব অসুস্থ তিনি। কবির বাড়ি ঢুকে বসবার আগে দাদিমাকে সালাম দিল। এরপর সবাইকে। ব্যাগ রেখে তারপর বসার ঘরে গিয়ে বসল সবাই। চাচ্চু মিষ্টি নিয়ে এলেন কবিরদের জন্য ট্রে-তে করে। এসে তার পাশে বসে তার ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো? কবির বলল, না চাচ্চু। কোন সমস্যা হয়নি। চাচা বললেন, তোরা আসবি শুনে তো সখিনা সেই দুপুর থেকে রান্না বসিয়ে রেখেছে। আব্বু বললেন, আরেহ! এতকিছুর কী দরকার ছিল। তুমি নিষেধ করতে পারলে না! চাচু বলেন, ওকে তুমি আর অন্য কোন কিছুর ব্যাপারে নিষেধ করতে পরামর্শ দাও না কেন ভাই, কিন্তু রান্না-বান্নার ব্যাপারে আর অতিথি আপ্যায়নের ব্যাপারে ও এই অধম স্বামীজির কথাও শুনে না।

একথা শুনে বাবা হাসতে লাগলো। এরপর শুরু হলো বাবা ও চাচার ব্যাবসায়িক আলাপ। কবিরের চাচাত ভাই-বোন তিন জন। মোহন, হাসান আর কুসুম। মোহন একটু বড়। হাসান ছোট। তার বয়স ৪। আর কুসুম আমার ক্লাসেই। মোহন এসে বলল, কাল তোকে মেলায় নিয়ে যাবে। কাল পহেলা বৈশাখ। সেদিন সবার সঙ্গেই আলাপ হলো। অবশেষে রাতে খাবার-দাবার শেষে ঘুমিয়ে পড়লাম সবাই।

দুই.

পরদিন সকালে কবিরের ঘুম ভাঙল তার আব্বুর ডাকে। আব্বুর পাশেই ঘুমিয়েছিলাম। এরপর কবিরদের জন্য চলে এলো চা-নাশতা। সবার মুখ থেকে শুনল চাচ্চু নাকি অনেক সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছিলাম মুড়ি, মুড়কি, খই ইত্যাদি আনতে। নাশতা শেষ করে অবশেষে চাচ্চুকে আসতে দেখা গেল। তখন তার খুশি আর দেখে কে! তার চাচাত ভাই ব্যাগ খুলতে লাগলো। কবিরের তখন আর আনন্দের সীমা রইলো না। উড়কি ধানের মুড়কি, বিন্নি ধানের খই, নানা বাহারি খেলনা, খেজুরের গুড়, মোয়া ইত্যাদিসহ আরো কত কি! এসব তো আগে কোনদিন চোখে দেখিনি।

বাবা মজা করে বলতে লাগলেন, কবির! মনে হচ্ছে তোর চাচ্চু তোকে বাঙালি সংস্কৃতি কি জিনিস তা টের পাইয়েই ছাড়বে। কিচ্ছু ভাবিস না। মুড়ি-মুড়কি খেয়ে বাইরে বের হয়ে এলো। দোকানে দোকানে হালখাতার চল এখনও আছে। এগুলো আগে শুধু বই-পুস্তকেই পড়ত কবির। এখন স্বচক্ষে দেখা হয়ে গেল, ভালই লাগলো। সেদিন সকালে অনেক জায়গায় ঘোরাঘুরি হলো। বাসায় এসে বিকেলের খাওয়া-দাওয়া সারল সবাই। মঈন চাচ্চু বললেন, আজ বিকেলে তোদের নিয়ে বেরবো। তাদের আনন্দ আর দেখে কে? সবচেয়ে ছোট যে, যার বয়স ৪, সেও যাবে আমাদের সঙ্গে। চাচ্চু ওকে অনেক ভয় দেখিয়েছিলেন। মেলায় হারিয়ে যাওয়ার ভয়। আছে কালো কালো ভূত। আমার মনেও তখন ভূতের ভয় কাজ করেছিল। কারণ আমি আগে কখনও মেলা দেখিনি যে!

মেলার স্থান আমাদের বাসা থেকে ৩ মিনিটের রাস্তা। মানুষের সে কি ভিড়! পা রাখাটাই যেন দায় হয়ে পড়েছে। কবিররা তিনজন। আর চাচ্চুর দুটো হাত। সবচেয়ে যে ছোট তাকে চাচ্চু ঘাড়ে চড়ালেন। তারা মামার হাত ধরে আছে। সমস্ত মেলা ঘুরে দেখল। জীবনে এত আনন্দ আগে কখনও পায়নি তারা। ছেলে-মেয়ে, নারী-পুরুষ সব ধর্মের মানুষেরই যেন মিলনমেলা পহেলা বৈশাখ। বানর খেলা, নাগরদোলা, আর এক পাশে বাউল গানের আসর মেলাকে পূর্ণতা দান করেছিল।

মাটির তৈরি জিনিসপত্রে ভরা ছিল চারদিক। কুমাররা যেন পরম মমতায় তৈরি করেছেন এসব জিনিসপত্র, নারীদের ভিড় দেখা যাচ্ছে সেদিকে। মঈন চাচ্চু তাদের নিয়ে গেল এক বাঁশির দোকানে। কিনে দিল তিনটা বাঁশি। ওরা সবাই বাঁশি বাজাতে অস্থির হয়ে উঠেছিল ওখানেই। সবচেয়ে ছোটটাও বাজাতে চেষ্টা করেছিল, যদিও পারছিল না। তার কাণ্ড দেখে আমরা সবাই তো হেসেই গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম।

তিন.

মেলায় ঘোরাঘুরির পর চাচ্চু এখন কবিরদের যে জায়গায় নিয়ে আসলেন তাকে একটা টং দোকান বলা যেতে পারে। এসেই চা চাইলেন সবার জন্য। ছোটটাকে দিলেন বিস্কুট। এরপর দোকানির সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলেন, কি গো শরিফুল? তোমার দোকানে বেচা-কেনা কেমন চলছে?

এই ভাই। আপনাদের দোয়ায় চলতাছে কোন রকম।

এই দেখ। আমার ভাইয়ের ছেলে। চিনে রাখো অনেক কাজে লাগতে পারে। তোমাকে হালখাতা, মেলা সম্পর্কে অনেক কিছুই শিখিয়ে দেবে।

হ ভাই। তা আর কইতে হয়? কিন্তু আগেকার মেলাগুলোর যেমন জৌলুস ছিল এহন কি আর হেই রহম আছে? আস্তে আস্তে সব কমতে আছে। সব। ভাই আমগো সময় আমরা যে সুন্দর স্মৃতি এহন মনে করার চেষ্টা করি হে তো আর এহন খালি কল্পনা। আমনেগো শহরে তো এগুলো দেহাই যায় না!

ঠিক বলেছেন চাচা। মুখ খুললো কবির। গ্রামে এসে আমি এরকম খুশি আর কোনদিন হইনি। আসলেই এসব আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ। এই উড়কি ধানের মুড়কি, নাগরদোলার ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দ এগুলো আমাদের অহংকার।

দেখলা শরিফুল। আমি কইনি এ আমার ভাইজত্যা দেখতে হবে! কইলাম না তোমারে অনেক কিছুই শিখাইয়া দিবো। চাচ্চু যেন আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

হ ভাই। সত্যিই তোমার ভাগ্য অনেক ভালো। বলল শরিফুল চাচা।

আচ্ছা। শরিফুল এসব ঐতিহ্য আমরা কীভাবে ফিরিয়ে আনবো?

শরিফুল চুপ মেরে গেল। তার হাতের আঙ্গুলগুলো নড়ছে। শাহাদত অঙ্গুলি বের হয়ে গেল যেন। চলে এলো সোজা বটগাছের দিকে। ও মা একি! এ যে কবিরের দিকেই আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিল শরিফুল চাচা। কবির কি ভুল দেখছে! এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে আমনের ভাইজত্যা।

কথাটা শুনে থ হয়ে গেল সবাই। কবির যেন তলিয়ে যেতে লাগল।

চার.

মায়ের স্পর্শে হকচকিত হয়ে উঠল কবির। কিরে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস যে! তোর না কাল অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে! লিখবি কবে? সময় তো নেই, মা বললেন।

আরে আম্মু তুমি আসলা কবে? তুমি তো তোমার বান্ধবীর বাসায় গেছিলা না? অবাক হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলো কবির।

কি যা তা বলছিস। আমি তো এখানেই ছিলাম। মা পুনরায় বললেন। কবির আর কথা বাড়াল না। সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে তার। স্বপ্নই বোধহয় দেখছিল সে। অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ারও বেশি সময় বাকি নেই।

আজ পহেলা বৈশাখ। স্কুলে এ সংক্রান্ত অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছে। গত দুইদিন বাড়ি ছিল না বলে যে কি কঠিন শাস্তিটাই না পেতে হচ্ছে। কাল সারা রাত ঘুমোতে পারেনি। অ্যাসাইনমেন্ট সবগুলো মোটামুটি হয়ে গেছিল। একটা অ্যাসাইনমেন্টই শুধু বাকি। বিষয় ছিল ‘পহেলা বৈশাখের স্মৃতি’। কলম হাতে নিতে যাবে অমনি ঘটে গেল এক অদ্ভুত কাণ্ড। একি! অ্যাসাইনমেন্ট তো লেখা শেষ! আমি এ অ্যাসাইনমেন্ট কবে শেষ করলাম আবার!

তবে ঘুরে এসেছি স্বপ্নের দেশ থেকে! ইশ্ স্বপ্নটা যদি সত্য হতো! পরক্ষণেই মনে পড়লো শরিফুল চাচার কথা। না আমাদের মতো ছেলেরাই পারে গ্রামীণ ঐতিহ্যকে আবার ফিরিয়ে আনতে। আমাদের পারতেই হবে। আমাদের সংস্কৃতি আমাদের ছড়িয়ে দিতে চতুর্দিকে। দৃঢ় আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠলো কবিরের চোখে-মুখে।

লেখক: শিক্ষার্থী, দশম শ্রেণি, সিরোইল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, রাজশাহী

কিডজ পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!