জোরে কথা বলা নিষেধ, পাখি উড়ে যাবে

সেবার শীতে কলেজে অনেক অতিথি পাখি এলো। ভৌগলিক কারণে আমাদের কলেজে খুব একটা অতিথি পাখি আসতো না। বড়জোড় দু’একটা সাদা বক ছাড়া তেমন কোন পাখির দেখা পাওয়া ভার ছিল।

রাব্বী আহমেদরাব্বী আহমেদ
Published : 18 March 2022, 06:04 AM
Updated : 18 March 2022, 06:04 AM

আমাদের কলেজ অধ্যক্ষ ছিলেন ভয়াবহ প্রকৃতিপ্রেমী। আর হবেনই না কেন তিনি ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। সে হিসেবে তার মাঝে প্রকৃতি ও পাখিপ্রেম থাকা অস্বাভাবিক নয়। কলেজ প্রাঙ্গনে এত অতিথি পাখি দেখে তিনি যারপরনাই মুগ্ধ হলেন।

স্যার সকাল সন্ধ্যা অতিথি পাখি দেখে কাটান। আমরা দূর থেকে দেখি স্যার পাখিগুলোর জন্য মাঠে খাবার ছড়িয়ে দিচ্ছেন। স্যারের পাখিপ্রেম দেখে আমরা মুখ টিপে হাসি। তিনি রীতিমত ঘোষণা দিয়ে দিলেন- কেউ অতিথি পাখির দিকে ঢিল ছুড়তে পারবে না। আর অতিথি পাখি শিকার করাতো আরও ভয়ংকর অপরাধ।

এদিকে আমরা পড়লাম আর এক বিপদে। পাখিগুলো একদম আমাদের ফুটবল খেলার মাঠে বসায় বিকেলে খেলাধুলোও ঠিকভাবে করা যাচ্ছিল না। স্যারের আশঙ্কা ছিল পাখিগুলো চলে যেতে পারে। তাই তিনি যে মাঠে অতিথি পাখি বসে সে মাঠে খেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। অতিথি আপ্যায়নের কারণে আমরাই মোটামুটি অতিষ্ঠ।

একদিন বিকেলে খেলার সময়ে আমরা বেশ কয়েকজন এ বিষয় নিয়ে আলাপ করছিলাম। কয়েকজনতো বেশ উঁচু কণ্ঠে কথা বলছিল। কথার আওয়াজ স্যারের কানে যাওয়াতে তিনি আমাদের ডেকে বললেন, ‘এই আস্তে কথা বল, পাখি উড়ে যাবে’।

আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম স্যারের মুখের দিকে। পরদিন দেখি কলেজের বিভিন্ন জায়গায় সাইনবোর্ড টানানো, যেখানে বড় করে লেখা, ‘জোড়ে কথা বলা নিষেধ, পাখি উড়ে যাবে’।

প্রতিদিন সকালের প্যারেডে শু পলিশ করা আমাদের বাধ্যতামূলক ছিল। তবে এই পলিশ সাধারণ পলিশ নয়। শু এর টুই-এ দাঁত দেখা যায় এমন পলিশ। আমরা যাকে ‘ওয়াটার পলিশ’ বলতাম।

একবার শীতের সকাল। আলসেমির কারণে আমার বন্ধু রনন শু পলিশ করেনি। এদিকে প্যারেডে নামার সময়ও হয়ে গেছে। আর শু পলিশ না করার শাস্তি ভয়াবহ। কারণ স্বয়ং সেনাবাহিনীর মেজর সাহেব আমরা যাকে ‘অ্যাডজুটেন্ট’ ডাকি তিনি শু পলিশ চেক করবেন।

রনন তাই তাড়াহুড়ো করে শু এর ওপর নারকেল তেল মাখালো। তাই অল্প সময়ের মাঝেই ওর শু ‘ওয়াটার পলিশের’ মতো হয়ে গেল। বেচারাও নির্বিঘ্নে প্যারেডে নামলো। এদিকে অ্যাডজুটেন্ট আসতে আসতে প্রচণ্ড শীতে নারকেল তেল জমে গিয়ে কালো শু পুরো সাদা হয়ে গেলো। এর মাঝে অ্যাডজুটেন্ট এসে ইংরেজিতে বললেন, ‘তোমার শু সাদা কেন?’

রনন কিছুক্ষণ ভেবে ওর উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, স্যার প্রচণ্ড শীততো, তাই শু এর ওপর কুয়াশার স্তর পড়েছে।

ওর উত্তর শুনে অ্যাডজুটেন্ট বেশ চিন্তায় পড়লেন। চারদিকে এত কুয়াশা, স্তরতো পরতেই পারে, তিনি ভাবলেন। আর কোন প্রশ্ন না করে তিনি চলে গেলে সে যাত্রায় রনন বেঁচে যায়। পরে আমরা ওকে বললাম, তুই নারকেল তেল না দিয়ে সরিষার তেল দিলেই তো পারতি। রনন হেসে বলল, আইডিয়াটা আগামী শীতের জন্য তোলা থাক।

দুর্ভাগ্যবশত আমাদের কলেজে কোন খেজুরগাছ ছিল না। অনেকেই গ্রাম থেকে আসায় শীতকালে খেজুরের রস চুরি করার অভ্যাস ছিল পুরনো। একবার শীতের রাতে সিদ্ধান্ত নিলাম খেজুরের রস চুরি করতে হবে।

কিন্তু খেজুর গাছ ছিল কলেজ সীমানার বাইরে। আর কলেজের বাইরে যাওয়া বেশ বিপদজনক, কারণ ধরা খেলে কলেজ থেকে বহিস্কার করে দেওয়া হবে।

তবুও কৈশোরের দুরন্তপনার কাছে সব হার মানলো। আমরা বাইরে গেলাম ক্যাডেটদের নির্ধারিত ড্রেসের বাইরে অর্থ্যাৎ সিভিল ড্রেস পরে। যাওয়ার সময় গেটের দারোয়ান ধরতে পারলো না। বেশ মজা করে রস টস খেয়ে যখন আবার কলেজে ঢুকলাম তখন আমাদের দুই বন্ধু ধরা পড়লো। গার্ড ওদের নাম এবং ক্যাডেট নাম্বার টুকে রাখলো।

পরদিন সকালে আমাদের সবাইকে ডাকা হলো। দায়িত্বরত সেনাবাহিনীর একজন নন-কমিশন্ড অফিসার (স্টাফ) বললেন, ‘গতকাল ক্যাডেট মুস্তাকিম, ক্যাডেট নাম্বার ১২৪১ এবং ক্যাডেট ইরফান, ক্যাডেট নাম্বার ১৪২৬ কলেজের বাইরে গিয়ে গার্ডের কাছে ধরা পড়েছ। তোমরা অ্যাডজুটেন্ট অফিসে আসো।’

স্টাফের কথা শুনে আমাদের অধিনায়ক বলল, স্টাফ মুস্তাকিম ভাই আর ইরফানতো এমনিতেই কলেজের বাইরে। স্টাফ অবাক হয়ে বলল, মানে?

ও বলল, মুস্তাকিম ভাই আমাদের তিন বছরের সিনিয়র। কলেজ থেকে বের হয়েছে ২ বছর আগে। আর ইরফানতো ক্লাস এইটে থাকতেই কলেজ থেকে চলে যায়। স্টাফ বলল, তাহলে কাল রাতে কারা বাইরে গিয়েছিল?

ও বলল, মনে হয় ভূত স্টাফ। সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লে তিনি বিব্রত হয়ে জায়গা ত্যাগ করলেন।

ঘটনাটা আমাদের কয়েক ব্যাচ সিনিয়রদের সঙ্গে ঘটে। শীত প্রায় শেষ, কিন্তু তখনও রাতের নির্ধারিত পোশাকের সঙ্গে সোয়েটার না পরার অনুমতি দেওয়া হয়নি। ক্যাডেট কলেজের সব যাবতীয় আদেশ আর্মি হেড কোয়াটার থেকে আসে। তাই আদেশ না আসায় শীত না থাকলেও সোয়েটার পরতে হতো। রাতে সোয়েটারের নিচে সাদা ফুল হাতা শার্ট পরার নিয়ম। অনেকেই গরমের কারণে সাদা হাফ হাতা শার্ট পরত, কীভাবে যেন অ্যাডজুটেন্ট বিষয়টা জানতে পারলেন।

একদিন রাতের বেলা হঠাৎ তিনি  লাইনে দাঁড় করিয়ে সবাইকে সোয়েটার খুলে ফেলার নির্দেশ দিলেন। দেখা গেল অনেকেই সোয়েটারের নিচে সাদা হাফ শার্ট পরেছে। তিনি তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য আলাদা করলেন।

এদিকে একজন সোয়েটার খুলছেই না। সবাই বেশ অবাক। এরপর অনেক চেষ্টার পর যখন তার সোয়েটার খোলানো হলো তখন দেখা গেল সে নিচে কিছুই পরেনি। শুধু তার সোয়েটারের সঙ্গে একটা কলার এবং হাতা সেলাই করে লাগানো!

লেখক পরিচিতি: সাবেক ক্যাডেট, কবি ও গবেষক

আগের পর্ব

কিডজ পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!