কাচ্চুম

শেষমেশ ঠিক হলো, খুব ভোরে রাফসান ওঠার আগেই লুম্বাকে মসজিদের মাঠে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে আরও অনেক পশু কোরবানি করা হবে।

ঝর্না রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 March 2022, 09:13 AM
Updated : 11 March 2022, 09:13 AM

পরের দিন ঈদ। সবাই অনেক সকাল সকাল উঠে গেছে। তাড়াতাড়ি গোসল করে নতুন জামাকাপড় পরে ঈদগাহে গিয়ে নামাজ পড়বে। তারপর গরু ছাগল কোরবানি হবে। মাংস কাটা হবে।

রায়হান বেশ সকালেই উঠে গিয়েছিলো। রাফসান তখনও ঘুমাচ্ছে। ওর আম্মু বললো থাক, একটু দেরিতেই উঠুক। গরু-ছাগল জবাইয়ের পাটটা চুকে যাক।

কিন্তু রাফসান কিছুক্ষণের মধ্যেই উঠে যায়। চারপাশের বাড়ি থেকে তখন গরু ছাগলের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। রাফসান বিছানা থেকে নেমেই এক দৌড়ে সিঁড়ির তলায় চলে এলো। কিন্তু লুম্বা তো সেখানে নেই! থাকবে কীভাবে? তার আগেই লুম্বা কোরবানি হয়ে গিয়েছে।

রাফসান দৌড়ে আম্মুর কাছে এলো। আম্মু, আমার লুম্বা তো নেই! ওকে কি কেটে ফেলা হয়েছে, হ্যাঁ?

ডলি কিছু বলতে যায়। কিন্তু কথা শেষ করতে পারে না। তার আগেই রাফসান দুহাতে চোখ চেপে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে রাফসানের মুখে যেন সব রক্ত জমাট বেঁধে যায়। নানি তাড়াতাড়ি বলেন, কেঁদো না রাফসান, কেঁদো না। লুম্বাকে কাটা হয়নি। ও হঠাৎ বাঁধন খুলে বের হয়ে গেছে। মনে হয় বাসা চিনতে পারছে না। তোমার টুকুন মামা খুঁজে এনে দেবে।

রাফসানের কান্না তাতে কমে না। লুম্বাকে এনে দাও বলে সে চেঁচাতে থাকে। ও আমার ছাগল। ওকে নিয়ে আসো।

কাশি উঠতে থাকে রাফসানের। সিঁড়ির তলায় গিয়ে পাগলের মতো চিৎকার করে ডাকতে লাগলো, লুম্বা লুম্বা, চলে এসো। এই যে তোমার দড়ি! এই যে তোমার কাঁঠাল পাতা। বালতিতে তোমার জন্য পানি আছে!

ছাগলের জিনিসগুলো এক একটা হাতে নিয়ে রাফসান হেঁচকি তুলতে তুলতে কাঁদতে থাকে।

ওর কান্না দেখে ডলিও কাঁদতে থাকে।

ব্যাপার দেখে ঘাবড়ে যান নানাভাই। তাড়াতাড়ি টুকুনকে এক পাশে ডেকে নিয়ে চুপিচুপি বলেন, শিগগির যা, আজও হাটে ছাগল পাওয়া যাবে। ওই রকম একটা কিনে নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি।

ওই রকম? যদি না পাই? ওটার গায়ের লোমগুলো বেশ বড় বড় ছিলো। টুকুন ফিসফিস করে বলে।

নানাভাইও গলা নিচু করে বলেন, আরে যা তো। যেমন পাস, ছাগল হলেই হলো। তারপর ওকে বোঝানো যাবে। আর কিছুক্ষণ এভাবে কাঁদলে ও তো সেন্সলেস হয়ে যাবে!

টুকুন দৌড়ে বের হয়ে যায়।

নানাভাই বলেন, চলো ভাইয়া, আমরা তোমার লুম্বাকে খুঁজে আনি। ওটা বোধ হয় রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে। তোমাকে দেখলেই দৌড়ে আসবে।

এ কথায় সত্যিই কান্না থামায় রাফসান। নানি চট করে রাফসানকে নিয়ে মুখটুখ ধুইয়ে নতুন জামাও পরিয়ে দেন। নানাভাইয়ের সঙ্গে বের হয়ে রাফসান এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। কিন্তু মাঝে মাঝেই ওর ঠোঁট ফুলে ওঠে। লুম্বা কোথায়?

নানাভাইয়া বলেন, নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। তোমার টুকুন মামাও তো তোমার ছাগল খুঁজতে গেছে। খুঁজে পেলেই আমাকে ফোন করবে।

এমন সময় নানাভাইয়ের ফোন বেজে ওঠে। ওই যে টুকুন ফোন করেছে! নানা কথা বলেন। রাফসান আগ্রহ নিয়ে চেয়ে থাকে।

পাওয়া গেছে নানাভাই?

হ্যাঁ হ্যাঁ। পাওয়া গেছে!

সত্যি? লাফিয়ে ওঠে রাফসান। চলো নানাভাই। তাড়াতাড়ি!

বাসায় ফিরে রাফসান এক দৌড়ে আমগাছ তলা চলে যায়। সেখানে একটা ছাগল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে টুকুন মামা। কিন্তু, কই? এ তো লুম্বা নয়! এটা তো কালো একটা ছাগল! দেখতেও আগেরটার চাইতে ছোট!

রাফসান সন্দেহভরা গলায় বলে, টুকুন মামা, তুমি কাদের ছাগল নিয়ে এসেছো? এটা তো লুম্বা না! ও তো কালো ভূত ছাগল! একেবারে কাল্লু! এ ছাগল আমার না! রাফসানের আবার হেঁচকি ওঠা শুরু হয়। চেষ্টা করেও কান্না আটকাতে পারছে না রাফসান।

নানাভাই টুকুন মামাকে ইশারা দিয়ে বলেন, কিছু একটা বলে ওকে থামা। পরে সব বুঝিয়ে বলা যাবে।

টুকুন মামা তাড়াতাড়ি রাফসানকে ধরে ছাগলের কাছে নিয়ে যায়। তারপর বলে, কী বলো মামা, ও-ই লুম্বা! তবে ওর কালাজ্বর হয়েছে, তাই কালো হয়ে গেছে। লুম্বা এখন কাল্লু হয়ে গেছে। দেখো, গা কী গরম!

রাফসান আস্তে করে ছাগলের গায়ে হাত দেয়। হ্যাঁ গরম বটে। রোদের তাপে ছাগলের গা সত্যিই অনেক গরম হয়ে আছে।

রাফসান বলে সত্যি জ্বর?

হ্যাঁ, জ্বর তো! দাঁড়াও নাপা ট্যাবলেট গুলিয়ে খাইয়ে দিতে হবে। তা হলে জ্বর কমে যাবে।

রাফসানের সন্দেহ তবুও যায় না। ওর যে কালাজ্বর হয়েছে তা কেমন করে বুঝলে?

ও মা! কালাজ্বর না হলে ওর লোম কালো হয়ে গেলো কীভাবে? তোমার নানাও তো ছোটবেলায় খুব ফর্সা ছিলো। একেবারে লাক্স সাবানের মতো। পরে কালাজ্বর হয়ে কালো হয়ে গিয়েছে, তাই না আব্বা! টুকুন মামা নানাভাইয়ের দিকে চেয়ে চোখ টিপে একটু ইশারা করে।

হ্যাঁ, এ কথা নানাভাই অবশ্য কয়েকবার বলেছেন। রায়হান রাফসান দুজনেই খুব ফর্সা। ওদের সঙ্গে ঠাট্টা করে নানাভাই প্রায়ই বলেন, আমিও তোমাদের মতো ফর্সা ছিলাম। ছোটবেলায় কালাজ্বর হয়েছিলো। তাই কালো হয়ে গিয়েছি।

রাফসান ছাগলের মাথায় হাত বুলায়। কিন্তু ও তো এমন শুকনা ছিল না!

আরে জ্বরে শুকিয়ে গিয়েছে। ওকে ভালো করে খাবার দাও, দেখবে আবার মোটকা হয়ে গেছে!

তাই?

হ্যাঁ!

কিন্তু ওর গায়ের রঙ কি ঠিক হবে? নাকি কাল্লুই থাকবে?

নানাজান বলেন, তা হয়তো হবে না। দেখ না, আমি কালোই রয়ে গেছি! তাই বলে কি আমি তোমাদের নানাভাইয়া নই?

অকাট্য যুক্তি! রাফসান ধীরে ধীরে কাঁঠাল পাতার ডাল নিয়ে ছাগলের মুখের সামনে ধরে। ছাগলটা কুট কুট করে পাতা ছিঁড়ে দাঁতের নিচে ফেলে মজা করে চিবোয়। চোয়ালের দুপাশ দিয়ে একটুখানি পাতা বের হয়ে থাকে। চিবাতে চিবাতে আবার সেটা ভেতরে ঢুকে ফিনিশ হয়ে যায়! একবার খেয়ে ছাগলটা আবার রাফসানের হাতের দিকে মুখ বাড়িয়ে আনে।

রাফসানের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। চেঁচিয়ে ওঠে। ও খাচ্ছে! এবার জ্বর কমে যাবে তাই না মামা?

টুকুন ছাগলের দড়িটা আমগাছের ডালে বেঁধে দিতে দিতে বলে, হ্যাঁ। দেখো, দুদিনেই তোমার কাল্লুম্বা, না থুক্কু, তোমার লুম্বা মোটা হয়ে যাবে!

রাফসান আচমকা গম্ভীর গলায় বলে না, ওর নাম লুম্বা না, লুম্বা নেই। আমি জানি ও অন্য ছাগল। লুম্বাকে কোরবানি দিয়ে ফেলেছ। রাফসানের ঠোঁট দুটো একটু কেঁপে ওঠে। বড় বড় চোখ দুটি ছলছল করে ওঠে।

ছেলের কথা শুনে ডলির চোখেও পানি এসে যায়।

টুকুন মামা তখন ছাগলের গলার কাছের চামড়াটা চুলকে দিতে শুরু করেছে। ছাগলটা আবার রাফসানের হাত থেকে আর একটা পাতা ছিঁড়ে নেয় মুখে।

টুকুন মামা খুশিভরা গলায় চেঁচিয়ে বলে, দেখো, তোমরা দেখো, এ ছাগলও রাফসানের পোষ মেনে গেছে। মামা, ওর কী নাম দেবে তাহলে, ও কি আজ ঈদের দিনেও নাম ছাড়া থাকবে?

এবার রাফসানের ঠোঁট জোড়া ফাঁক হয়ে দাঁতগুলো ঝিলিক দিয়ে ওঠে। হেসে ওঠে রাফসান। বলে, ওর নাম কাচ্চুম। দেখো মামা, কেমন কাচ্চুম কাচ্চুম করে কাঁঠাল পাতা খাচ্ছে!

ছেলের মুখে হাসি দেখে ডলি আল্লাহকে ধন্যবাদ দেয়। দৌড়ে গিয়ে ঘরে থেকে একটা ক্যামেরা এনে পটাপট ছবি তুলতে থাকে।

টুকুন মামা ক্যামেরার পর্দায় চোখ রেখে ছবিগুলো দেখতে দেখতে বলে দারুণ হয়েছে। দাঁড়াও এই ছাগলের ছবি ফেইসবুকে দিয়ে দেবো। লিখে দেবো, দিস ইজ অ্যা ব্লাক গোট। ইহা একটি কাল্লু ছাগল। ইটস নেইম ইজ কাচ্চুম। ইহার নাম কাচ্চুম। ইহার মালিক রাফসান। কাচ্চুম তাহার মালিকের নানাবাড়িতে থাকে। সেখানে সে মজা করে কাঁঠালপাতা খায়।

রাফসান কাঁঠালপাতা খাওয়ানো থামিয়ে গম্ভীর গলায় টুকুন মামাকে বলে, না কাচ্চুম নানাবাড়িতে থাকবে না। আমার সঙ্গেই থাকবে। মা, টুকুনমামাকে টাকা দিয়ে দাও, কাচ্চুমের জন্য ট্রেনের টিকিট কাটতে হবে। নইলে ও আমাদের সঙ্গে ঢাকায় যাবে কীভাবে!

আগের পর্ব

কিডজ পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!