একটা কাঠি দিয়ে ছাগলের গায়ে খোঁচা মেরে বলে উঠলো, অই লুম্বা, লুম্বা! তুমি কী খাও!
টুকুন মামা বললো, আচ্ছা, তোমার লুম্বা এখন ঘাস খাক, চলো, আমরা গরু দেখে আসি।
গরু? কোথায়? রায়হান রাফসান দুজনেই খুশিতে লাফিয়ে ওঠে।
রায়হান বলে, আমরা কি গরু কিনতে গরুর হাটে যাবো মামা? টুকুন মামা বলেন, না গরু কেনা হয়েছে। তবে সেটা রাখা হয়েছে আরেক বাড়িতে। কয়েকজন মিলে সেই গরু কেনার টাকা দিয়েছে। কারণ গরু কিনতে অনেক টাকা লাগে।
রায়হান টুকুন মামাকে জিজ্ঞেস করেছিলো কত টাকা লাগে?
টুকুন মামা বলেছে আশি হাজার টাকা।
রাফসান বুঝতে পারে না আশি হাজার টাকা খুব বেশি কেন। একশও তো না!
টুকুন মামা ওদের দুজনকে নিয়ে গরু দেখতে গেলো।
নাসিরউদ্দীন সাহেবের বাসার সামনে বাঁধা লালচে রঙের গরুটাকে দেখিয়ে টুকুন মামা বললো, এটা হলো আমাদের গরু। কেমন, গরু পছন্দ হয়েছে মামা? রাফসানের মাথায় হাত রেখে টুকুন মামা জিজ্ঞেস করে।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে গরুটা। ওর বড় বড় চোখ দুটোর কোনায় পানি জমে আছে। আরও অনেক বাচ্চাকাচ্চা চারপাশে হইচই করছে। গরুর লেজটা মাঝে মাঝে নড়ে উঠছে। রাফসান একটু ভয় পেয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়।
আচ্ছা গরুর চোখে পানি কেন?
রাফসানের প্রশ্ন শুনে টুকুন মামা বলে, গরুটাকে ঈদের দিন কোরবানি দেবে তো তাই কাঁদছে।
কোরবানি দিলে কাঁদবে কেন? কোরবানি তো ঈদ! ঈদ মানে খুশি! টিভিতে দেখনি, ঈদের গানের সঙ্গে খুশিতে লাফাতে লাফাতে একটা ছবির গরু যাচ্ছে? ওর গলায় মালা! ওই গরুটা তো খুশি! কাঁদছিল না তো! রাফসান বুঝতে পারে না।
রায়হান রাফসানের মাথায় আঙুল দিয়ে খোঁচা মেরে বলে, আরে বুদ্ধু, ঈদের খুশি তো আমাদের! গরুর তো কষ্ট! ঈদের দিন তো ওদের জবাই করা হবে। গলা কেটে ফেলা হবে। সেটাই কোরবানি দেওয়া। তাই এই ঈদের নাম কোরবানির ঈদ।
রাফসান অবিশ্বাসের চোখে গরুটার দিকে তাকায়। তারপর বলে, সত্যি মামা?
টুকুন মামা সে কথার উত্তর না দিয়ে রাফসানকে একটানে কাঁধে তুলে নিয়ে বলে, চলো মামা, আমরা বাজারে মিষ্টির দোকানে বসে গরম গরম জিলিপি খেয়ে আসি।
বাজার থেকে জিলিপি খেয়ে আর হাতে গরম জিলিপির ঠোঙা নিয়ে বাড়ি এসে রাফসান গরুর কথাটা বেমালুম ভুলে যায়। বাড়িতে ঢুকেই শুনতে পায় ছাগলের ম্যা ম্যা ডাক।
রাফসান টুকুন মামার দিকে তাকিয়ে বলে, মামা, আমাদের ছাগলটা ডাকছে?
মামা হেসে বলেন,হ্যাঁ, তোমার লুম্বা!
রাফসান হাত থেকে জিলিপির ঠোঙা ফেলে এক দৌড়ে চলে যায় আমতলা।
বাড়ির দারোয়ান মুবিন মামা তখন ছাগলটাকে কাঁঠাল পাতা খেতে দিয়েছে। রাফসানকে দেখে বলে, ছাগলরে পাতা খাওয়াইবা রাফসান?
রাফসান মহা উৎসাহে ছাগলকে কাঁঠাল পাতা খাওয়াতে লেগে যায়। মুখের সামনে পাতা ভরা ডাল নিয়ে বারবার বলে, খাও লুম্বা খাও। বেশি করে খাও। তোমার তো পেটের দুপাশে গর্ত! পেটে খাবার নেই!
ছাগল দিব্যি রাফসানের হাতে কাঁঠাল পাতা খেতে থাকে।
সারাদিনেও আর রাফসানকে ছাগলের কাছ থেকে নড়ানো যায় না। পাড়ার আরও কয়েকজন ছোট বড় বাচ্চা এসে জুটে যায় রাফসানের সঙ্গে। রাফসান ওদের কাউকে পাতা খাওয়াতে দেয় না। সবাইকে বলে, ও আমার ছাগল লুম্বা। আমিই শুধু লুম্বাকে খাবার দেবো।
নানাভাইও বলেন, অই, কেউ আমার নানুভাইয়ের লুম্বার গায়ে হাত দেবে না। ওটা ওর ছাগল। ও-ই খাওয়াবে।
ঈদের আগের দুটো দিন আর রাফসানকে ছাগলের কাছ থেকে সরানো যায় না। কোনোমতে ওর মা এসে জোর করে ধরে নিয়ে গোসল করিয়ে নিয়ে আসে। রাফসানের খাওয়াও চলে ছাগলের কাছে বসে। ওখানে আমগাছের একটা নোয়ানো ডালে দোলনা বাঁধা আছে। রাফসান সেখানে বসে দোল খেতে খেতে ভাত খায় আর ছাগলের সঙ্গে কথা বলে।
ছাগল মাঝে মাঝে ম্যা ম্যা করে চেঁচায়। তখন রাফসান দৌড়ে গিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে আর বলে, চিৎকার করো না। ভয় পেও না। তোমাকে কাটবে না। তুমি আমার পেট, আমার পোষা প্রাণী। নানাভাই বলেছে তুমি আমার ছাগল। টুকুন মামা বলেছে। আম্মু বলেছে।
তখন ডলি ভাতের লোকমা হাতে নিয়ে আস্তে করে বলে, বাবা, ছাগলের কাছে আর থাকার দরকার নেই। ওর গায়ে অনেক গন্ধ। তোমার গায়ে ছাগলের গন্ধ লেগে যাবে। চলো আমরা এবার যাই।
অমনি গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে রাফসান। না আ আ আ। গন্ধ লাগবে না। আমি থাকবো। লুম্বার কাছে থাকবো।
আচ্ছা আচ্ছা, কাঁদতে হবে না। থাকো। আম্মু রায়হানকে রাফসানের সঙ্গে থাকতে বলে চলে যায়।
রায়হান বলে, শুধু আজকের দিনই ওকে পাতা খাওয়াতে পারবে রাফসান! কাল ঈদ। কাল তো তোমার লুম্বাকে কোরবানি দিয়ে দেওয়া হবে!
রাফসান ছাগলের মুখের কাছে একটা কাঁঠাল পাতার ডাল ধরে খাওয়াচ্ছিল। রায়হানের কথা শুনে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
কী! কোরবানি দিয়ে দেবে লুম্বাকে? গলা কেটে ফেলবে ওর? রাফসান তো এখন জানে কোরবানি মানে গলা কেটে ফেলা। না আ আ আ। না না না। ভীষণ জোরে কাঁদতে থাকে রাফসান।
একটু পরই ওর হেঁচকি উঠে যায়। কাশি উঠে যায়। ছাগলের দড়ি ধরে পাগলের মতো টানতে থাকে। না না ওকে কাটবে না। লুম্বা আমার পোষা ছাগল। ওকে কাটবে না!
বাড়ির সবাই এসে ভিড় করে দাঁড়ায়। নানাভাই বিড় বিড় করে বলেন, মহা মুশকিল হলো দেখছি। এখনই ওকে এটার কাছ থেকে সরাতে না পারলে কাল তো একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে!
অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ছাগলকে আমতলা থেকে বারান্দার সিঁড়ির নিচে বেঁধে রেখে এবং ঈদের দিন লুম্বাকে কাটা হবে না এই কথা দিয়ে রাফসানকে ঘরের ভেতরে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হলো।
রাফসান ঘুমিয়ে গেলে নানাভাই নানিমনির সঙ্গে পরামর্শ করতে বসলেন। কাল রাফসান ওর লুম্বাকে কোরবানি দিতে দেখলে তো কেঁদেকেটে এক কাণ্ড ঘটাবে। আর রাফসানের কান্না খুব বিপজ্জনক। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি ওঠে। তারপর শুরু হয় বমি। বমির সঙ্গে কাশি। কাশির সঙ্গে দম আটকানো। হুলস্থুল কাণ্ড।
চিন্তায় পড়ে যান ওঁরা। কী করা যায়!
নানি বললেন, থাক না হয়, এটাকে কোরবানি দেওয়ার দরকার নেই। ছোট বাচ্চার আদরের প্রাণী। ওর মনটা ভেঙে যাবে।
নানা বললেন, না, এটা কোরবানি দেওয়ার নিয়ত করা হয়েছে। নিয়ত করলে নিয়ত পালন করতে হয় জানো না? তুমিও কি রাফসানের মতো বাচ্চা হয়েছ নাকি?
রাফসানের আম্মু ডলি বললো, আব্বা, আরেকটা না হয় কিনে নিয়ে আসো। এই ছাগলটা রাফসানের অনেক প্রিয়। ও অনেক কষ্ট পাবে! এটার বদলে অন্য একটা কোরবানি দাও।
নানাভাই খুব পরহেজগার মানুষ। বললেন, তুমি কি জানো না মা মনি, প্রিয় জিনিসই কোরবানি দিতে হয়!
ডলি তার বাবার কথায় কিছু বলে না। চুপ করে থাকে।
চলবে…।
আগের পর্ব: কাচ্চুম, পর্ব ১
কিডজ পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |