গুপ্তধন

কোন এক সময় এক ছোট্ট গ্রামে বাস করতো এক বুড়ো ও বুড়ি। অভাব-অনটনের সংসারে তাদের সারাদিন কাটতো কাজে আর সন্ধ্যায় পেটপুরে খেয়ে হাসিহাসি মুখ করে ঘুমিয়ে যেতো।

মাজহার সরকারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 March 2022, 11:18 AM
Updated : 3 March 2022, 11:43 AM

অন্য সবকিছু ঠিক আছে, বুড়ির কেবল ওই একটাই দোষ, কথা পেটে রাখতে পারতো না। বাড়ির ভেতর যা কিছু ঘটে, যা কিছু বলাবলি হয়, অথবা বুড়ো যদি বাইরে থেকে কোনো খবর নিয়ে আসে তা একযোগে পুরো গ্রামে জানতে পারে। প্রায়ই এমন হতো যে বুড়ি বাইরে গেলেই সব কথা ফাঁস করে দেয়, আর এজন্য বুড়োকে চড়া মাশুল গুণতে হয়।

একদিন কাজের খোঁজে বুড়ো গেলো বনে। বনের এক প্রান্তে পৌঁছে ক্লান্ত বুড়ো পিঠ থেকে ঝোলাটা রেখে হাঁটতে লাগলো। হঠাৎ একটা নরম জায়গায় পড়ে তার পা মাটিতে ডুবে গেল।

এটা কী হলো? বুড়ো ভাবল। আমি কি একটু খুঁড়ে দেখবো নাকি কেন পা ডুবে গেলো!

বুড়ো তাই খুঁড়তে লাগলো। খুঁড়ে খুঁড়ে শেষ পর্যন্ত সোনা ও রূপাভরা একটা পুরনো কলসির সন্ধান পেলো।

আহা, কী ভাগ্য আমার! কিন্তু এই গুপ্তধন কীভাবে আমি বাড়ি নিয়ে যাবো! বুড়ির কাছে তো এ খবর কিছুতেই লুকোনো যাবে না, সে যদি একবার এটি জেনে যায় সমস্ত বিশ্বকে বলবে, তারপর আমি আবার সমস্যায় পড়ব।

বুড়ো বসে বসে ভাবতে লাগলো, ভেবে ভেবে অবশেষে একটা পরিকল্পনা করলো সে। বুড়ো আবার মাটি আর মরা ডালপাতা দিয়ে গুপ্তধনের কলসি ঢেকে দিলো। তারপর শহরের দিকে হাঁটতে শুরু করলো, বাজার থেকে কিনে নিলো একটা জ্যান্ত বোয়াল এবং একটা তরতাজা মোরগ।

তারপর বুড়ো আবার বনে ফিরে গেল। বোয়াল মাছটাকে একটি মান্দার গাছের আগায় ঝুলিয়ে দিল আর একটা মাছ ধরার জালে মোরগটা বেঁধে ছোট স্রোতের কিনারে বসিয়ে রাখলো।

ঝোলা কাঁধে নিয়ে বুড়ো দুলতে দুলতে আনন্দের সঙ্গে বাড়ি চলে এলো।

বউ! ঘরে ঢুকেই বুড়ো ডেকে উঠল। অ বউ! আমাদের কপাল খুলে গেছে!

কী! কী! আমাকে এক্ষুনি সব খুলে বলো।

না, না, তুমি গিয়ে সবাইকে বলে দেবে।

না, সত্যিই! এমন কথা ভাবতে পারলে তুমি! একটুও কষ্ট হলো না তোমার! তুমি যদি চাও তবে নুন খেয়ে শপথ করতে পারি।

আচ্ছা ভালো! তুমি যদি সত্যিই এবার বুঝে থাকো তবে শোন।

বুড়ি কানটা এগিয়ে দিলো আর বুড়ো ফিসফিস করে বললো, আমি বনে সোনা-রূপা ভর্তি একটি কলসি পেয়েছি! চুপ!

ঘরে নিয়ে আনলে না কেন?

কারণ সেখানে আমরা একসঙ্গে যাবো আর কলসিটা সাবধানে সঙ্গে করে নিয়ে আসবো।

বুড়ো আর বুড়ি বনে চলে গেল।

যেতে যেতে বুড়ো বলল, কী অদ্ভুত কথা শুনছো বউ! ওইদিন শুনলাম যে মাছ গাছে চড়ে আর মোরগ পানিতে সাঁতার কাটে। দুনিয়াটা সত্যি বদলে গেছে।

এ আবার কেমন কথা! লোকেরা মাঝে মাঝে কিযে বাজে কথা বলে, আর তুমিও সেসব কথা শুনে বিশ্বাস করে বেড়াও!

বাজে কথা নয়, সত্যি! বিশ্বাস না হলে এই মান্দার গাছটার ওপরে তাকাও। আর ভালো করে দেখে বলো আমি ভুল কিছু শুনেছি কিনা!

গহীন বনে দাঁড়িয়ে মান্দার গাছের আগায় তাকিয়ে বুড়ি স্তব্ধ হয়ে গেলো। সত্যি তো, বোয়ালটা গাছে চড়লো কেমন করে? মানুষ তাহলে সত্যটাই বলে!

কিন্তু বুড়ো কেবল মাথা নাড়ল আর কাঁধ ঝাঁকালো। তারপর মুখটা হাঁ করে এমনভাবে তাকালো যেন সে সত্যিই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে দেখছোটা কী, বোকা?, বলল বুড়ি। তাড়াতাড়ি গাছে উঠো আর বোয়ালটা পেরে আনো, আমরা আজ রাতে বোয়াল মাছের ঝোল খাবো।

বুড়ো গাছে উঠে বোয়ালটা নামিয়ে আনল, তারপর ঝোলায় ভরে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো।

স্রোতের কাছাকাছি এসে বুড়ো থমকে দাঁড়ালো।

তুমি আবার কিসের দিকে তাকিয়ে আছো? বুড়ি অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলো।

আমার পুঁতে রাখা জালে কিছু একটা নড়ছে বলে মনে হচ্ছে। দাঁড়াও দেখে আসি এটা কী।

বুড়ো দৌড়ে কাছে গেলো আর পানি থেকে জালটা টেনে তুলে চিৎকার করে বুড়িকে ডাকতে লাগলো।

এই দেখ! ভালো করে চোখ কচলে তাকিয়ে দেখ, দেখলে তো! আমি বললাম বিশ্বাস করলে না, এখন নিজের চোখে দেখো। জলে মোরগ সাঁতার না কাটলে জালে আটকালো কেমন করে!

এ কেমন দুনিয়া দেখালে ঈশ্বর! বুড়ি স্তব্ধ হয়ে ফিসফিস করে উঠলো । কীভাবে মোরগ তোমার জালে এলো? সত্যিই তো এটা একটা লালঝুঁটিওয়ালা মোরগ, তোমাকে আর কষ্ট করে প্রমান করতে হবে না যে এটা মোটেও মোরগ নয়। আসলে বাজারের লোকেরা সবকিছুতেই মিথ্যা বলে না।

কিন্তু বুড়ো কেবল মাথা নাড়লো আর কাঁধ ঝাঁকালো এমনভাবে যেন সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

এখন কিসের জন্য দাঁড়িয়ে আছ, বোকা?, বুড়ি রেগে উঠল। মোরগটা জাল থেকে ছাড়িয়ে নাও। আজ রাতে আলু দিয়ে ঝাল করে রান্না করে দেবো, খেও।

মোরগটা কোলে তুলে নিলো বুড়ো, কয়েকবার কক কক ক করতে করতে বুড়োর কব্জিতে ডুবে রইলো মোরগটা আর এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো।

তারপর তারা সেই জায়গায় চলে এলো যেখানে গুপ্তধন মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল। শুকনো ডালপালা সরিয়ে, মাটি খুঁড়ে, পুরনো মরচেপড়া কলসিটা বের করে আনলো আর তা নিয়ে বাড়ি চলে গেলো।

এখন বৃদ্ধ দম্পতির প্রচুর টাকা-পয়সা, তাদের সংসারে অভাব-অনটন দূর হলো। বুড়ি প্রতিদিন প্রতিবেশি কাউকে না কাউকে ডেকে কথা বলে, খেতে দেয় আর বলে, তোমরা যেন আবার ভেবে বসো না আমরা গুপ্তধন পেয়েছি! মানুষকে খাওয়াতে কলজে লাগে বুঝছো, গুপ্তধন লাগে না!

এতে বুড়ো বেশ অধৈর্য হয়ে ওঠলো। বুড়োর নিষেধ বুড়ি কানে তুললো না।

আমাকে বক্তৃতা শোনাবে না, বুঝছো, বুড়ি বলে। আমরা একসঙ্গে গুপ্তধন খুঁজে পেয়েছি, এবং আমরা একসঙ্গে এটা খরচ করব।

বুড়ো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, তুমি যা খুশি তা-ই করতে পার, কিন্তু আমি তোমাকে আর একটা পয়সাও দেব না।

বুড়ি খুব রেগে গেল। শখ কতো! সব টাকা নিজেই ভোগ করবে! তাই না, তবে একটু অপেক্ষা করো আর দেখো আমি কী করি।

বুড়ি তার স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে গেলো গভর্নরের কাছে। আমাকে আমার লোভী স্বামীর হাত থেকে রক্ষা করুন! যখন থেকে সে গুপ্তধন খুঁজে পেয়েছে তার কোন কাজ নেই। সে কেবল শুয়ে-বসে খায় আর ঘুমায়, কোন কাজ করে না আর পুরোটা গুপ্তধন নিজের কাছে লুকিয়ে রাখে।

বুড়ির কথা শুনে গভর্নরের দয়া হলো। তিনি তার মুখ্য সচিবকে বিষয়টি দেখার নির্দেশ দিলেন। সেক্রেটারি গ্রামের প্রবীণদের ডেকে নিয়ে বুড়োর বাড়িতে গেলেন।

শুনলাম, আপনি বাড়িতে গুপ্তধন লুকিয়ে রেখেছেন?

বুড়ো কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, কী ধন? আমিতো কিছুই জানি না।

ওহ, তুমি এখন কিছুই জানো না? লুকানোর চেষ্টা হচ্ছে বুঝি! ওসব করে পার পাবে না বুঝলে, তাড়াতাড়ি বের করে আনো গুপ্তধন। যদি না আনো তাহলে গভর্নরকে যথাযথ নোটিশ না দিয়ে ধন সংগ্রহের সাহসের জন্য তোমার বিচার করা হবে।

আমাকে ক্ষমা করুন, মহামান্য। এই গুপ্তধনটা আসলে কী? আমার স্ত্রী নিশ্চয়ই এটা স্বপ্নে দেখেছে, আর ভদ্রলোকেরা তার আজেবাজে কথা শুনে বিশ্বাস করেছেন।

আজেবাজে কথা! বুড়ি এবার নীরবতা ভেঙ্গে কথা বলে ওঠলো। একটা সোনা-রূপা ভরা কলসি আমরা দুজনে খোঁজে পেয়েছি, এটাকে তুমি আজেবাজে কথা বলছ?

তোমার ঠিক মনে নেই, তুমি হয়তো তোমার কোন স্বপ্নের কথা বলছো, বুড়ো শান্ত স্বরে বললো। স্যার, আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। দয়া করে তাকে জিজ্ঞাসা করুন কীভাবে পুরো ঘটনা ঘটেছিল। সে যদি আপনাকে বলতে পারে তবে আমি আমার জীবন দিয়ে পুরো টাকা ফেরত দেবো।

একদিন...একদিন...গল্প বলার শুরুতে বুড়ি একটু কেঁদে নিলো। একদিন...আমরা বনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম, একটি মান্দার গাছের আগায় একটা বোয়াল মাছকে চড়তে দেখলাম। 

কী, বোয়াল মাছ? গাছে চড়ে আছে!’ চেঁচিয়ে উঠলেন সচিব। আপনি কি রসিকতা করছেন  আমাদের সঙ্গে?

আসলে, আমি রসিকতা করছি না! আমি খালি সত্য কথাটাই বলছি।

এখন বিবেচনা করুন ভদ্রলোকেরা, বুড়ো বললো, তাকে এখনও আপনারা বিশ্বাস করতে করেন যে কিনা এভাবে বকবক করে?

বকবক! আমি বকবক করছি! তুমি ভুলে গেছো, আমরা কীভাবে একটি লাল মোরগকে নদীতে সাঁতার কাটতে দেখলাম?

সবাই হাসিতে ফেটে উঠল, সেক্রেটারি মুচকি হেসে তার দাড়িতে আঁচড় কাটতে লাগলেন।

বুড়ো বললো, এসো, এসো বউ, সবাই তোমাকে দেখে হাসছে।

তারপর সমাবেশের লোকজনের দিকে তাকিয়ে বললো, এখন আপনারা নিজেরাই বলেন গুপ্তধনের কথা আপনারা বিশ্বাস করেন?

হ্যাঁ, সত্যিই, গ্রামের প্রবীণরা বললেন, এই প্রথম শুনলাম মাছ গাছে চড়ে আর মোরগ সাঁতার কাটে!

সেক্রেটারি শহরে ফিরে গেলেন। বুড়ো-বুড়ি ধনভান্ডারের কিছু অংশ বেচে দিয়ে জিনিসপত্র কিনে শহরে চলে গেলো। সেখানে তারা একটা মুদিদোকান খুললো, অলস জীবন ছেড়ে তারা আবার কাজকর্মে ফিরে গেলো আর শান্তিতে দিন কাটাতে লাগলো।

ফেইরিটেইলজ ডটকম থেকে অনুবাদিত

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!